এক রাতে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ: ২ সংবাদপত্র বন্ধ, সম্পাদক আক্রান্ত, ৩২ নম্বর, ছায়ানট, ভারতীয় হাই কমিশনের ৩ শাখায় আগুন
- আপডেট সময় : ০৭:৩১:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
- / 13
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর ঘোষণা আসার পর বৃহস্পতিবার রাতে সারা দেশে নজির ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। আক্রান্ত দেশের দুই জনপ্রিয় সংবাদপত্র প্রথম আলো ও হোটেল স্টার শুক্রবার প্রকাশিত হয়নি। তাদের অনলাইন কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউজ সম্পাদক নুরুল কবির। আক্রান্ত হয়েছে দেশের প্রধান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতেও ভাঙচুর হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ভারতীয় হাই কমিশনের তিনটি শাখা
ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতভর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভবনে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
একদল হামলাকারী দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের অফিসে ভাঙচুর করে আগুন দেয়, এতে দুটি অফিসেই অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার কারওয়ানবাজারে অবস্থিত প্রথম আলোর চারতলা ভাবনটি পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু জায়গা থেকে তখনও ধোয়া উঠতে দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিসের একটি টিমকে ঘটনাস্থলে দেখা গেছে।
প্রসঙ্গত, ভবনটিতে প্রথম কয়েকটি বিভাগের কার্যালয় ছিল। হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে ডেইলি স্টার অফিসের নিচ তলা ও দোতলা পুড়ে গেছে। অফিসের ভেতরে ভাঙচুর করে ফেলে রাখা জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখা গেছে। শুক্রবার সকালে ডেইলি স্টারের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে কারওয়ানবাজারে অবস্থিত দেশের দুটি শীর্ষ গণমাধ্যমের অফিস ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। এসময় সেখানে অবস্থানরত সংবাদকর্মীরা আটকা পড়েন।
পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তাদের ক্রেনের সাহায্যে উদ্ধার করেন এবং আগুন নেভান। হামলাকারীদের সংবাদমাধ্যমের অফিসের ভেতরে লুটতরাজও করতে দেখা গেছে।
এসময় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীর ঘটনাস্থলে গেলে তাকেও হেনস্তা করা হয়।
পরে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। তবে শুক্রবার সকালে প্রথম আলোর সামনে র্যাবের একটি টিম এবং কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকলেও কোনো সেনাসদস্যকে দেখা যায়নি।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, “পুরো ঘটনায় আমরা খুবই মর্মাহত। সাংবাদিকতরা জন্য এটা একটা আঘাত।
ডেইলি স্টারের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হামলাকারীরা ভবনের প্রায় প্রতিটি তলায় হামলা ও ভাঙচুর চালায় এবং মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করেছে।
ডেইলি স্টারে কর্মরত একজন জানিয়েছেন, হামলাকারীরা তার ক্যামেরা, ভিভাইস, হার্ডড্রাইভ সব লুট করে নিয়ে গেছে। কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে তিনি জানান, তার সারা জীবনের সব কাজ এবং স্মৃতি ওগুলোয় সংরক্ষিত ছিল।
গতকাল রাতের ভয় ও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই বলেও জানান কয়েকজন কর্মী।
এছাড়াও রাত একটার দিকে ধানমন্ডিতে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয় এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
হামলার পর রাত সাড়ে ৩টার দিকে ছায়ানটের ফেসবুকে দেওয়া এক ঘোষণায়, ভবনটিতে পরিচালিত ‘ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের’ ক্লাসসহ সংগঠনের সব কার্যক্রম পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আবারও ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয় আগে দুইবার গুড়িয়ে দেওয়া ধানমন্ডি-৩২’এ থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি। সকাল সাড়ে আটটার দিকেও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া লাইভে কয়েকজনকে ইট দিয়ে বাড়ির অবশিষ্ট দেয়াল ভাঙতে দেখা যায়।
কেবল রাজধানীতেই না, হামলার শিকার হয়েছে চট্টগ্রামের ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ও। কার্যালয়ের সামনে ইনকিলাব মঞ্চের অবস্থান কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর কিছু লোক এসে ভবনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।
পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়লে হামলাকারীরা ইট-পাটকেল মারে। পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে ধরিয়ে দিলে রাত দুইটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এছাড়াও রাত সোয়া ১১টার দিকে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনের বাসায় আগুন দেওয়া হয়। গুড়িয়ে দেওয়া হয় রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস।
বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে যা যা ঘটেছে :
১। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের প্রধান কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
২। ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে ফের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
৩। খুলনা ও চট্টগ্রামে ভারতের হাইকমিশনের কার্যালয় ও বাসভবনে হামলা।
৪। ছায়ানটের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
৫। ইন্দিরা গান্ধী কালচালার সেন্টার ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
৬। রাজধানীর উত্তরায় ৩২টি দোকান ভাঙচুর ও আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ।
৭। রাজশাহীতে ডেইলিস্টার, প্রথম আলোর কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
৮। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ময়মনসিংহে এক হিন্দু যুবককে গাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হত্যা ও আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে!
৯। চট্রগ্রামের প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় ফের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
১০। বান্দরবানে সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট।
১১। নিউজ এজ সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক নুরুল কবীরের উপর হামলা।
১২। কাঁচপুরে প্রথম আলোর ছাপাখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
১৩। সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় অসংখ্য আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ।
১৪। প্রথমা প্রকাশনী ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য বই।
১৫। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয় বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সারা দেশে টিকে থাকা আওয়ামী লীগ অফিসে ফের আগুন দেওয়া হয়েছে।
নেতাদের প্রতিক্রিয়া
সারারাত এসব ঘটনার চলার পর শুক্রবার পত্রিকা ব্যক্ত করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগীরও। নিজের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে তিনি লেখেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুস্কৃতিকারিরা আবারো দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। দুস্কৃতিকারিদের নির্মম হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি নিহতের ঘটনা সেই অপতৎপরতারই বহিঃপ্রকাশ”।
“দুস্কৃতিকারি সন্ত্রাসীদের কঠোর হস্তে দমনের বিকল্প নেই” বলেও পোস্টটিতে লেখেন তিনি।


















