বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরকারের জরুরি বৈঠক: ‘বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম’
- আপডেট সময় : ১১:২৫:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
- / 62
বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কম—এমন মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়েও তারা জোর দিয়েছেন। দেশের শীর্ষ বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের নিয়ে সোমবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এ বৈঠক করেন, যেখানে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠকে আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞরা জানান, সাম্প্রতিক কম্পন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেন তারা।
শুক্রবার ও শনিবার চার দফা ভূমিকম্পের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার প্রধান উপদেষ্টা নিজ দপ্তরে এ বৈঠক ডাকেন।
এসময় তিনি বিশেষজ্ঞদের বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যেই সরকারের করণীয় সম্পর্কে লিখিত সুপারিশ দিতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা হাত গুটিয়ে রাখতে চাই না। আবার অবৈজ্ঞানিক কোনো পদক্ষেপও নিতে চাই না। আপনাদের পরামর্শগুলো দ্রুত লিখিত আকারে আমাদের দিন। সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।”
তিনি জানান, বিশেষজ্ঞ কমিটি বা একাধিক টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। পরামর্শ পেলেই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের প্রেস উইং জানায়, জরুরি বৈঠকে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, দুর্যোগ ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রীয়াজ উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এমআইএসটির অধ্যাপক মো. জয়নুল আবেদীন, বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী, অধ্যাপক তানভীর মনজুর, অধ্যাপক তাহমীদ মালিক আল-হুসাইনী, অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান ও অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার, দুর্যোগ গবেষক মো. শাখাওয়াত হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম, আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মমিনুল ইসলাম, আবহাওয়াবিদ মো. রুবাইয়্যাত কবীর এবং ভূতত্ত্ববিদ রেশাদ মো. ইকরাম আলী।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “কয়দিন আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পে যাদের মৃত্যু হলো, যারা আহত হলেন—এটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। এমনটি যেন আর না হয়, তার জন্য আমাদের অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আপনারা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, অভিজ্ঞতা ভাগ করেছেন। এই আতঙ্ক থেকে জনগণকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা প্রয়োজন, সরকারকে তা জানান। কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে, কোন কোন বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে—সব জানান। দুর্ঘটনা যেভাবেই আসুক, যেন আমরা সব পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারি।”
তিনি জানান, ভূমিকম্পের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কী ধরনের মহড়া প্রয়োজন—বিশেষজ্ঞদের মতামত জরুরি।
তার বক্তব্য, পাশাপাশি বর্তমান প্রস্তুতির স্তরও মূল্যায়ন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও সমন্বয় বাড়াতে হবে। “ভূমিকম্প নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদের বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করতে হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘শুভেচ্ছা’ নামে একটি অ্যাপ করেছি। এই অ্যাপের মাধ্যমে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের সাথে যুক্ত হোন। অ্যাপটিতে আরও কী ধরনের ফিচার আনা যেতে পারে, সে বিষয়েও আমাদের পরামর্শ দিন।”
বিশেষজ্ঞরা জানান, ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গুজব ছড়িয়েছে—৪৮ ঘণ্টা, ১০ দিন বা ১ মাসের মধ্যে বড় ভূমিকম্প হবে বলে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। তারা স্পষ্ট করে বলেন, ভূমিকম্পের নির্দিষ্ট দিন–তারিখ–সময় কেউ বলতে পারে না। পূর্বের ভূমিকম্পের মাত্রা ও সময়কাল পর্যবেক্ষণ করে কেবল একটি সম্ভাব্য সময়সীমা অনুমান করা যায়।
বৈঠকে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, “ভূমিকম্পের উৎস ও উৎপত্তিস্থল বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে—বাংলাদেশ ও আশপাশে কয়টি সোর্স আছে এবং সেগুলো থেকে শেকিং লেভেল কত হতে পারে তা নির্ধারণ করতে হবে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ আমরা স্বল্প ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। তবে যথেষ্ট প্রস্তুতি আমাদের রাখতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, “জনসচেতনতা তৈরিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। ইনডোর, আউটডোর, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান—এই চার স্তরে করণীয় পরিকল্পনা সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। তরুণদের কাজে লাগিয়ে ন্যাচারাল হ্যাজার্ড প্ল্যান ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নিলে সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারবে।”
অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “মন্ত্রণালয়গুলো তাদের আওতাধীন স্থাপনাগুলোর মূল্যায়ন করতে পারে। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ—এসব ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্পবিষয়ক প্রোগ্রাম চালু হলে আতঙ্ক নয়, বরং সচেতনতা বাড়বে।”
এমআইএসটির অধ্যাপক মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, “সবাইকে বোঝাতে হবে—আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আমাদের সামর্থ্যের মধ্যেই কাজ করতে হবে। করণীয় সম্পর্কে আরও স্পষ্ট তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছানো জরুরি। খোলা জায়গাগুলোর চিহ্নিতকরণ, কোথায় মানুষ জড়ো হতে পারে—এসব জানাতে হবে এবং সে অনুযায়ী মহড়া করতে হবে। বাসাবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহড়ার ব্যবস্থা খুব প্রয়োজন।”
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা, ভবনগুলোর গুণগতমান ও জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল) মো. খালেকুজ্জামান চৌধুরী জানান, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ছবি সংগ্রহ করতে একটি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক ভবনের মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফাটল দেখা গেছে পার্টিশন দেয়ালে।
এই সফটওয়্যার দ্রুত মূল্যায়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়ক বলে তিনি জানান।
বৈঠকের সিদ্ধান্তে জানানো হয়, বিশেষজ্ঞদের লিখিত পরামর্শের ভিত্তিতে সরকার দ্রুত আলোচনা করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করবে। এতে সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেবেন।
















