বিদেশে ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান: ৫২ জন চিহ্নিত
- আপডেট সময় : ০৬:০০:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / 146
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিপুল সম্পদের নতুন তথ্য সামনে এনেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে ৫২ জন বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তারা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছেন। তবে আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বিষয়টি তদন্ত করছে।
গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সিআইসির বিশেষ টিম সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, লন্ডন, নিউইয়র্ক, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা ও কুয়ালালামপুরে বিপুল সম্পদের সন্ধান পায়। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই ও লন্ডনে সবচেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে। এ পর্যন্ত ব্যক্তি ও কোম্পানির নামে মোট ৩৪৬টি সম্পত্তি শনাক্ত হয়েছে।
শুধু সম্পদ নয়, বিদেশি নাগরিকত্বও
সিআইসি আরও জানিয়েছে, বিদেশে সম্পদ গড়ার পাশাপাশি অন্তত ৩৫২ জন বাংলাদেশি অর্থের বিনিময়ে বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন। দেশগুলো হলো— অ্যান্টিগুয়া ও বারবুডা, অস্ট্রিয়া, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, নর্থ মেসিডোনিয়া, মাল্টা, সেন্ট লুসিয়া ও তুরস্ক। এ ক্ষেত্রে ১২ লাখ ডলার খরচ করে পাসপোর্ট কেনার প্রমাণ মিলেছে।
কর ফাঁকি ও জরিমানা
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, কর ফাঁকির বিষয়টি যাচাই করে মাঠ পর্যায়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শনাক্ত হওয়া কর ফাঁকিদাতাদের কাছ থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কর ও জরিমানা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে।
সিআইসির মহাপরিচালক (ডিজি) আহসান হাবিব বলেন, ‘‘দেশের বাইরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন ৫২ জন প্রভাবশালী বাংলাদেশি। তাদের পাসপোর্ট ইতোমধ্যে জব্দ করা হয়েছে।’’
তিনি আরও জানান, প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, এই ৫২ জন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন। তবে আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। সিআইসি কর অঞ্চলগুলোর সহায়তায় তাদের পূর্ণাঙ্গ আয় ও কর বিবরণী যাচাই করছে। অনুসন্ধান প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সিআইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতে, আইনি বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি কৌশলগত কারণেও নাম প্রকাশে দেরি হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহের পর তালিকা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হবে বা প্রকাশ করা হবে। এতে অন্তত এক মাস সময় লাগতে পারে।
দুদকের মামলা
সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে দুদক ইতোমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিং মামলা করেছে। পাশাপাশি সিআইডিও অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
এনবিআরের একটি বিশেষ সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের পাঁচ দেশের সাতটি শহরে বিপুল অর্থ পাচার করেছে ৫২ ব্যক্তি ও ৩৫৬টি প্রতিষ্ঠান। তারা শিগগিরই শাস্তির মুখে পড়তে পারেন।
শিল্পগোষ্ঠী ও প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততা
তদন্তে উঠে এসেছে, পাচারে দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মালিকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো, সিকদার গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, ওরিয়ন, সামিটসহ একাধিক গ্রুপের নাম আছে। এছাড়া সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ এবং বিদেশি ব্যবসায়ী আদনান ইমামের আইপিই গ্রুপের নামও তালিকায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও সংসদ সদস্যদের নামও এখানে আছে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিআইসির শনাক্ত করা ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মধ্যে টাস্কফোর্সের আওতাধীন কোম্পানিগুলোও অন্তর্ভুক্ত। বিদেশ সফরে গিয়ে সিআইসির তদন্ত দল আরও বহু প্রভাবশালীর সম্পদের তথ্য পেয়েছে।
টাস্কফোর্স ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে ১১টি সংস্থার সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যেখানে বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও যুক্ত আছেন। প্রথম ধাপে টাস্কফোর্স বেক্সিমকো, এস আলমসহ কয়েকটি গ্রুপ ও সাবেক এক মন্ত্রীর পাচারের তথ্য সংগ্রহ করেছে।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে চারটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করছে— দ্য স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি (স্টার), ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টার (আইএসিসিসি), যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আইসিএআর)। উদ্ধার করা অর্থ থেকে কমিশন দেওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে।
সিবিএস ডেটাবেজে কারসাজি
সিআইসির মহাপরিচালক অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেন্ট্রাল ব্যাংক সিস্টেম (সিবিএস) ডেটাবেজে নিজেদের লোক বসিয়ে পাচারকারীরা বিপুল তথ্য গোপন করেছিল। তবে এখন সিআইসি মুছে ফেলা তথ্য পুনরুদ্ধারের সক্ষমতা অর্জন করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা
গত আগস্টে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান এসব তথ্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অবহিত করেন। তখন ড. ইউনূস বলেন— “দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে সম্পত্তি বানানো ভয়াবহ দেশদ্রোহিতা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর দেশ গড়তে হলে এদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে— যাতে আর কেউ একই পথে হাঁটার সাহস না পায়।” তিনি সিআইসি, দুদক ও সিআইডিকে সমন্বিতভাবে আরও গভীর অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন এবং সম্ভাব্য সব দেশে অভিযান বিস্তৃত করার পরামর্শ দেন।
সিআইসির অবস্থান
মহাপরিচালক আহসান হাবিব বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত যা ধরা পড়েছে, তা মোট পাচারের তুলনায় খুবই সামান্য। আরও বিপুল সম্পদের খোঁজ রয়েছে, যা উদঘাটনে সময় লাগবে। তদন্ত শেষ হলে তালিকা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হবে।’’
















