বিশ্ব ফুটবলের এই মৌসুমের এবং আগামী মৌসুমের সব চাইতে বড় দলবদল হয়ে গেল।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার পর পিএসজি তাদের নতুন দল গঠনে মেসিকে নিয়েই চিন্তা ভাবনা করছিল এবং সে অনুযায়ী চুক্তি নবায়নের অফার করেছিল কিন্তু কিছুদিন নীরবতার পর মেসি চুক্তি নবায়নে সম্মত হননি। পরবর্তীতে জাভির সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের পর এবং নিজের প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনার প্রতি তার অতীত ,বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ভালোবাসা থেকে বার্সেলোনা ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন ;যার সূত্রেই জাভির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
বার্সেলোনায় মেসির ফিরতে অনেকগুলো ইকুয়েশন ছিল এর মাঝে সবগুলোই আর্থিক রিলেটেড।
তবে সেটা মেসির স্যালারি দিয়ে নয় । সেগুলো ক্লাব এবং লা লিগার বিভিন্ন হিসাব-নিকাশের ।
তারপরও মেসি নিজের স্যালারির প্রতি কোন প্রকার ডিমান্ড ছাড়াই ফিরতে চেয়েছিলেন শুধুমাত্র প্রিয় ক্লাব এবং সমর্থকদের ভালোবাসার টানে।
প্রিয় জায়গা এবং বাচ্চাদের বেড়ে উঠার আতুড়ঘর বার্সেলোনা। কিন্তু বার্সা বোর্ড এবং প্রেসিডেন্ট আবারো দুই বছর আগের সেই হাইড এন্ড সিক খেলায় মনোযোগী হয়ে যান এবং তারা অনেকগুলো দু’টানার মধ্যে দিয়ে ক্লাব সমর্থক এবং ক্লাব অফিসিয়ালদের মধ্যে একটি অদৃশ্য খেলা শুরু করে দেন।
একদিকে সমর্থকদের চাপ অন্যদিকে বোর্ডের দু একজন সদস্যের দুদুল্যমান অবস্থান এবং বাকিদের আর্থিক হিসাব-নিকাশের স্বচ্ছতা মেসির চুক্তিটি কে বিলম্বিত করছিল।
সেই ঐতিহাসিক প্রবাদের মতো- ন্যাড়া বেলতলায় কয় বার যায়- মেসি ঠিক এখানেই স্ট্রাইক করেন; তিনি নিজেকে অন্যের হাতের খেলা বানাতে এবার আর সুযোগ দেননি।
সাক্ষাৎকারে সেটা উল্লেখ করেছেন লিওনেল মেসি । কারণ দুই বছর আগে ক্লাব ছাড়ার একদিন আগেও বুঝতে পারেননি ক্লাব ছাড়তে হবে তাকে।
যার জন্য ম্যানচেস্টার সিটির সব ধরণের প্রপোজাল থাকার পরও ম্যানচেস্টারে যাওয়া হয়নি এবং পেপ গার্দিওয়ালার প্লানে প্রথমে থাকলেও পরে স্বীকার করেছেন যেহেতু মেসি বার্সেলোনা ছাড়বে না সম্ভাবনা ও নেই কিংবা বার্সেলোনা মেসিকে ছাড়বে না সেজন্য আমি লিওনেল মেসিকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আর সময় নষ্ট করিনি ।
মজার ব্যাপার ছিল- গ্রীলিজ কে চুক্তিবদ্ধ করার পরদিন মেসির ক্লাব ছাড়ার কারনে তখন ইচ্ছা থাকলেও পেপ কিছু করতে পারেনি।
পিএসজিতে মেসি যাওয়ার সময় তাহার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল হঠাৎ করে বাচ্চাদের স্কুল পরিবর্তন ।এবার মেসির সামনে তিনটি অপশন ছিল -সৌদি আরবের ক্লাব আল হিলাল , স্পেনের বার্সেলোনা এবং আমেরিকার ইন্টার মায়ামি । তাছাড়া মেসির বক্তব্য অনুযায়ী ইউরোপের অন্য কিছু ক্লাবের অফার ছিল । কিন্তু সেগুলো মেসি তার বিবেচনা দিয়ে রাখেননি । কারণ হয় বার্সেলোনা , না হয় ইউরোপের বাইরে মুভ করার ইন্টার্ন্যাল সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই রেখেছিলেন।
অর্থের দিক থেকে সৌদি আরবে যাওয়া ছিল একজন পেশাদার ফুটবলার হিসাবে মেসির জন্য স্বাভাবিক; কারণ ক্যারিয়ারের শেষ সময় কিন্তু এখানেই মেসি তার চিরাচরিত বক্তব্যটি রাখেন যেখানে তিনি ক্রিকেট এর আরেক লিজেন্ড শচীন টেন্ডুলকারকে মনে করিয়ে দেন অর্থাৎ আমি টাকার পিছনে নয় জীবনের পিছনেই ; জীবনকে ইনভেস্ট করতে চাই।
সৌদি আরবের সম্ভাবনাই হয়তো বেশি ছিল কিন্তু বার্সেলোনাতে বড় হওয়া মেসি এবং তার বাচ্চাদের জন্য বসবাসের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের চেয়ে (বার্সা রিটার্ন ক্যান্সেলের পর) আমেরিকা অবশ্যই বেটার চয়েস।
যখন মেসি পূর্ব থেকেই সেই মায়ামিতে বাড়ি পর্যন্ত কিনে রেখেছেন এবং এখানেই ফিরে আসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছেন; সেখানে ইন্টার মায়ামি অবশ্যই রাইট চয়েস কারণ সৌদিতে গেলে সেই দুই বছর বা তিন বছর পর আবারো আমেরিকাতেই ফিরে আসতে হতো ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে মেসি তার বক্তব্যে যে কথা বলেছেন অর্থাৎ স্পট লাইট এর বাইরে চলে যাওয়ার কথা- সেটি আসলে কথার কথা হিসাবেই বিবেচনা করা উচিত কিংবা বলা যায় মেসির বিনয়।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো- এটাকে নিয়েই বার্সেলোনা তাদের দ্বিতীয় মিথ্যাচারের আশ্রয় নিল অর্থাৎ জাবি এবং বার্সা প্রেসিডেন্ট বলতে চাচ্ছেন মেসি কম চাপ এর জন্য আমেরিকাতে গিয়েছেন।
ফুটবলের সাথে প্রাসঙ্গিক না হলেও ক্রিকেটের কিংবদন্তি শের্ন ওয়ার্ন এর একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করার মতো – শচীন টেন্ডুলকারের বিরুদ্ধে, চাপে খেলতে পারেন না বলে একটি মিথ চালু হয়ে গিয়েছিল ; সে সময়ে একটি সাক্ষাৎকারে শের্ন ওয়ার্ন বলেছিলেন- “চিরন্তন চাপে খেলে বলেই শচীন সেরা “। আপনি অবলীলায় এই উক্তিটি ফুটবলের লিওনেল মেসির ক্ষেত্রে চালিয়ে দিতে পারেন।
কারণ সেই ১৬-১৭ বছর থেকেই মেসি স্পটলাইটের মধ্যে দিয়ে চিরন্তন চাপের মধ্যেই খেলছেন,পৃথিবীব্যাপী কোটি দর্শকদের প্রত্যাশা চাপ প্রতিনিয়তিই মেসিকে বহন করে নিয়ে চলতে হয়।
পৃথিবীতে ফুটবল সংক্রান্ত সকল প্রকার ট্রফি বর্তমানে মেসির শোকেস এরই মাঝে জমা হয়েছে, লঁরিয়াস ওয়ার্ল্ড স্পোর্টম্যান বর্ষসেরা পুরস্কার যা দেওয়া হয়- এই প্লানেটের সকল প্রকার খেলা মিলিয়ে ইন্ডিভিজুলায় সেরা কে।
অথচ লিওনেল মেসি একটি খেলার অংশ হয়ে সেটি জিতে নিয়েছেন দুই দুই বার। ফুটবলে রোনালদো একবার মনোনীত হয়েই উচ্ছাস প্রকাশ করেছিলেন।
মেসি নিজেই এখন ফুটবলের বাতিঘর। এজন্য তিনি সৌদি আরব, চায়না কিংবা আমেরিকা যেখানেই পা দিচ্ছেন, সেখানেই বেজে উঠছে ফুটবলের হুইসেল। নিজেই লাইট হয়ে জ্বলছেন। এজন্য অবলীলায় বলা যায় মেসি নিজেকে স্পট লাইটের আড়ালে নিতে চাইলেও কি সেটি সম্ভব?
কখনোই নয়!বরং ফুটবল এরিনার বাহিরে গিয়ে আরো বেশী স্পট লাইট এখন মেসির উপর।আর বয়স- সেটাও মেসি মেনেজ করে নিচ্ছেন ফুটবল মাঠে তার নিজের প্লেইং রুল চেইঞ্জ করে। এখনো প্রায় ম্যাচেই হাই রেটিং পাচ্ছেন নিয়মিত।
আসলে মেসি এবং শচীন এই প্লেয়ার কে আপনি পুরোপুরি ফুটবল এবং ক্রিকেটের দুই শতভাগ নিবেদিত প্লেয়ার হিসাবে ইতিহাসের পাতায় রেখে দিতে পারেন। মেসি ক্যারিয়ারে সব অর্জনের পর এখন অবকাশ যাপনের সাথে আনন্দময় ফুটবলকেই বেছে নেওয়ার কথা এবং আমেরিকা যাত্রায় সেটি ই হয়েছে অনুঘটক এর ন্যায়।
বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে এই প্লানেটে অর্জন করা সম্ভব এমন সব ধরনের ট্রপিই এখন মেসির ট্রপি কেসে এবং সেটা ও দুনিয়ার সকল প্লেয়ারদের চাইতে একক ভাবে সবচাইতে বেশী।
এই অবিশ্বাস্য অর্জন আর ক্যারিয়ারের জন্য লিওনেল মেসি নিজেই এখন হয়ে উঠেছেন অবিশ্বাস্য শব্দের প্রতিশব্দ।
এজন্য এখন বন্ধুদের যে কোন আড্ডায় এক বন্ধু অন্য বন্ধুর অলৌকিক কোন সাফল্য দেখলে আনমনেই বলে উঠেন তুই তো দেখতেছি মেসি হয়ে গেছিস।
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক
টরেন্টো,কানাডা। জুন ২০২৩