বিয়ানীবাজার উপজেলার বুক চিরে আজ থেকে শত শত বছর পূর্বে আমার জন্ম। এই উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদী ও উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুনাই নদীর, আমার জন্মের মধ্যে দিয়ে তাদের সংযোগ হয়েছিল। শুধু সংযোগ নয়, আমার কারণে মানুষের কাছে তাদের গুরুত্ব বেড়েছিল অনেক বেশী । সৃষ্টিকর্তা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন এই অঞ্চলের মানুষজন তথা প্রকৃতির কল্যাণে। আমি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করেছি।
আমার জন্ম থেকে আমি শান্ত প্রকৃতির । আজও বদি এরকমই আছি। আমি এদেশের অন্যান্য নদীর মতো কারো ঘর-বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে নিয়েছি তা এই অঞ্চলের মানুষ বলতে পারবেনা। আমার যখন যৌবন ছিল তখন আমার বুক দিয়ে বয়ে যেত স্টিমার, লঞ্চ, বিশাল পালতোলা নৌকা। এবং ঘুনটি নৌকা চড়ে খুশ গল্প করতে করতে প্রতিদিন কত নাইয়রি যেতেন আমার বুক ধরে।
আমার গর্ভে ছিল সবধরণের মাছের অবাধ বিচরণ। এই অঞ্চলের মাছ শিকারিরা অবাধে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকার চাহিদা মিটাত। শীত মৌসুমেও আমার বুকভরা পানি থাকত । এই পানির কারণে আশপাশের জমিগুলো স্যাঁতসেঁতে থাকত। তাই শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ ফসল ফলাতে সক্ষম হতো কৃষকরা । এছাড়াও দূরের জমিগুলোতে খাল কেটে সেচের ব্যবস্থা করতে পারত।
আজ থেকে ৭০-৮০ বছর পূর্বে আমার অনেক নাব্যতা ছিল । এবং এসময় অন্যান্য অঞ্চলের খালগুলোতেও নাব্যতা বিদ্যমান ছিল। বলতে গেলে খালগুলো তার প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে স্বাভাবিক ছিল। মাথিউরার কানিগাঙ্গ এর সাথে বিভিন্ন খালের মাধ্যমে আমার সংযোজন ছিল বিধায় শীত মৌসুমেও কৃষকরা ধান সহ অন্যান্য ফসলাদি অল্প খরছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে জলপথে স্থানান্তরের মাধ্যমে উপকৃত হতো।
আমি অর্থাৎ লুলা গাঙ্গ এর মাধ্যমে মানুষ এবং প্রকৃতি উপকৃত হচ্ছে তা দেখে ও অনুভব করে পুলকিত ও আনন্দবোধ করতাম। কিন্তু আজ আর আমার সেই জৌলুশ নেই। আজকাল শীত মৌসুমে বিভিন্ন জায়গায় আমার বুকের উপর দিয়ে পায়ে পানি না লাগিয়ে অনায়াসে এপার থেকে ওপারে মানুষজন পাড়ি দিতে পারে।
আজ আমার বর্তমান রূপ দেখে হয়তো কথাগুলো এই প্রজন্মের মানুষের কাছে কাল্পনিক মনে হবে। আমার রূপ যারা দেখেছেন বা আমাকে যারা ব্যবহার করেছেন, যাদের বয়স এখন ৭০/৮০ বছর এর কাছাকাছি, আমার বিশ্বাস -নি: সন্দেহে তারা এর সত্যতা বলতে পারবেন। তারা ইতিহাসের স্বাক্ষি ।
বিগত কয়েক বছর থেকে এই প্রজন্মের মানুষজন আমার অতীত রূপ বা গৌরবগাঁথা ইতিহাস না জেনে আমার প্রতি যে বিদ্বেষ ও বদনাম রটাচ্ছেন তার জন্য আজ বিয়ানীবাজার উপজেলার মানুষের সামনে দু-চারটি প্রশ্ন ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি।
বিগত কয়েক বছর থেকে বর্ষা মৌসুম আসলে বৃষ্টির পানিতে বিয়ানীবাজার সদর সহ এই অঞ্চলে পানি জমে যায়। তাই মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে আমাকে দোষারোপ করেন। বলেন- কেন আমি অর্থাৎ লুলা গাঙ্গ দ্রুত পানি নিষ্কাশন করতে পারিনা ? আমি আমার স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ পালনে ব্যর্থ হওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষ দূর্ভোগে শিকার হচ্ছে। আমি এই বক্তব্যগুলো দীর্ঘদিন থেকে শুনে আসলেও এর জবাব দেইনি। আজ এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি এই অঞ্চলের সচেতন জনগণের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখছি ইতিহাসকে স্বাক্ষি রেখে ।
আমার সবিনয় প্রশ্ন -এই অঞ্চলের পানি নিষ্কাশন করতে প্রকৃতি আমাকে যেভাবে রূপ দিয়েছিল ,সেই রূপ পরিবর্তনের জন্য দায়ী কে বা কারা ? আমি “লুলা গাঙ্গ ” ছিলাম, আমাকে ‘লুলা খাল‘ –এ রূপান্তরিত করার জন্য দায়ী কারা ? আমার গর্ভে মাটি ভরাট করে বসত বাড়ী বানিয়েছে কারা ? আমার দীর্ঘ দুই পাড়ে গড়ে উঠা ইট ভাটার নষ্ট ইট আমার বুকে ফেলে আমার নাব্যতা কমিয়েছে কারা ? এই কাজে কারা সহযোগিতা করেছে? আমার নি:স্পাপ গর্ভে কারা দখলদারিত্ব করে আসছে? কারা প্রশাসনিক সহযোগিতা করে ? এই সবগুলোর উত্তর যদি হয়- সৃষ্টির সেরা জীব ‘মানুষ’। তাহলে এই মহান মানুষের কাছে আমার সবিনয় আবেদন- আপনারা সরকারি ম্যাপ অনুযায়ী আমি লুলা গাঙ্গ এর (শরীর) জায়গা ছেড়ে দিন। আপনাদের মল-মুত্র দ্বারা আমার বিশুদ্ধ পানি ( রক্ত) দুষিত করেছেন। আমার নাব্যতা ( হৃদপিন্ড আক্রান্ত করে ) কমিয়েছেন। এইসব কিছু অপসারণ করে আমাকে পূর্বের আদলে ফিরিয়ে দিন। তারপর আলোচনা-সমালোচনা করুন। আমি আপনাদের কাছে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি- আমি অতীতের মতো বিনা শর্তে প্রকৃতির আপন নিয়ম অনুসারে মানুষ ও সমাজকে অকৃত্রিম সেবা দিয়ে যাবো।
গত দুসপ্তাহ পূর্বে বিয়ানীবাজার পৌরসভার বাজেট অধিবেশনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব সাহেব পৌরমেয়র সাহেবকে অনুরোধ করে বলতে শুনেছি যে, বিয়ানীবাজার শহর থেকে পানি নিষ্কাশনে জন্য দু-চারটি বড় ড্রেন খনন করা প্রয়োজন। প্রস্তাবটি উত্তম। তবে এই শহর বিয়ানীবাজারের পানি যে আমার উপর দিয়ে বয়ে যেতে হবে তার জন্য প্রথমে আমার গভীরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। প্রকৃতিগত ব-দ্বীপ স্থাপথ্যের বাংলাদেশের নদী-খাল-নালা গুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারে উপযোগী করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন এদেশের বেশীরভাগ অঞ্চলের রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধি ও নেতারা। একজন সৃষ্টিশীল, আধুনিক চিন্তা- চেতনা ও জনবান্ধব মনের নেতাই পারেন আমার মত অবহেলিত নদীগুলোকে আধুনিক রূপ দিয়ে মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে।
বর্তমান সময়েও দেশের অনেক জেলায় নির্বাচিত এমপিদের প্রচেষ্টায় নদী ও খাল দখল মুক্ত করে আধুনিক রূপ দিয়ে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করেছেন। কিন্তু অত্যন্ত দূ:খবোধ নিয়ে বলতে হয়- বিয়ানীবাজার –গোলাপগঞ্জ সংসদীয় আসনের অভিভাবক এর জন্মমাটির পাশদিয়ে বয়ে যাওয়া আমি মৃতপ্রায় লুলা গাঙ্গ এর বেলায় কেন এত অবহেলা ? আমি সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় জন্ম গ্রহণ করেছি। কারো দয়া- দাক্ষিণ্যে, কারো ক্ষতির উদ্দেশ্যে বা আক্রোশের বহি:প্রকাশে জন্ম নেইনি। জন্ম থেকে সৃষ্টির সেরা মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির সেবায় সৃষ্টিকর্তাই আমাকে নিয়োজিত রেখেছেন।
আমি লুলা মাত্র কয়েক কিলোমিটারের ছোট্ট একটি নদী। আমাকে ইচ্ছা করলেই সংস্কার সহ আধুনিক রূপ দেয়া কোনো বড় বিষয় নয়। ইতিহাসের নবদ্বীপ ও পঞ্চখন্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্তমান বিয়ানীবাজার শহরে নেই বললেই চলে।
এই অঞ্চলে টাকার অভাব নেই। তেমনি সৃষ্টিশীল মানুষ ও ভালো কাজের মানুষেরও আকাল নেই । তবে এই বিয়ানীবাজার উপজেলার মানুষের বিনোদন স্পট , প্রকৃতি ও মনোরম পরিবেশ বান্ধব মুক্ত হাটা চলার মতো কোন জায়গা নেই। মুক্ত পরিবেশে বসে সময় অতিবাহিত করার মতোও যথেষ্ট জায়গা নেই বললেই চলে।
মহৎ চিন্তা নিয়ে ভেবে দেখুন- বিয়ানীবাজার উপজেলার হৃদপিন্ডে আমার অবস্থান। আমাকে যদি একটি মাস্টার প্লানের আওতায় এনে খনন করে, দুধারের রাস্তার পাশাপাশি ওয়াকওয়ে করে তাতে সারি-সারি লাল-হলুদ কৃষ্ণচুড়া বা এই জাতীয় বৃক্ষের নিচে বিভিন্ন স্থানে বসার জায়গা, নদীতে পর্যটকদের জন্য স্পিডবোট বা নৌকার মাধ্যমে প্রকৃতিময় বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পৃথিবীর অনুন্নত অনেক দেশে এই রকম উদ্যোগ নিয়ে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রাখার খবর কম বেশী সামাজিক যোগাযোগের কল্যাণে আপনারা দেখে থাকেন। এই ব্যবস্থাটি সরকারি অথবা বেসরকারীভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা যেতে পারে। এবং আমার মতো অনেক মরা নদীকে জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে রোল মডেল হিসাবেও দাড় করিয়েছেন- এসব অনুকরণীয় উদাহরণ বাংলাদেশে রয়েছে।
আমি লুলা গাঙ্গ বলতে গেলে মানুষের অবহেলায় ও জনপ্রতিনিধিদের ‘গোত্রকেন্দ্রিক ভোট প্রাপ্তির হিসাবের কষাঘাতে‘ মৃত্যুর দার প্রান্তে দাড়িয়ে আছি। অপরদিকে অসংখ্য নিরীহ জনগণ,প্রাণী ও প্রকৃতি যুগের পর যুগ ধরে চরম অবর্ণনীয় কষ্টে ও অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে। আমি আপনাদের লুলা গাঙ্গ বাচঁতে চাই। আমি সকলের সেবায় পাশে থাকতে চাই। কিন্তু কে শুনবে আমার এই আকুতি ? আমার আর্তনাদ ?
যিনি দীর্ঘ দিন থেকে জোরজবরদস্তি করে আমার অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন , তার দৃষ্টির সামনেই তো আমি দীর্ঘদিন থেকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় জীবন পার করছি। আমাকে উদ্ধার করার ক্ষমতা যার হাতে- তিনি এই এলাকার অভিভাবক নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি। মাঝে মধ্যে তাকে বলতে গিয়েও বলতে পারিনা। মনে হয় তিনি হয়তো আমার চেয়েও অসহায়।
গত মাস দিন পূর্বে একটি সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলের তিনিই সবচেয়ে দরিদ্র লোক। তিনি কোটিপতি নয়, লক্ষপতি নয়, হাজারপতি নয়, তিনি শতপতি। একজন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী , বর্তমান এমপির মুখ থেকে এমন একটি উদ্ভট বক্তব্য প্রকাশের পর মূহুর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তা ভাইরাল হয়ে যায়। তার এই বক্তব্যটির মূল উদ্দেশ্য ছিল- মানুষের সহানুভূতি আদায়ের । যখন তিনি এই বক্তব্য রাখেন তখন সিলেটের কোনো ভিক্ষুককে শতপতির হিসাবে ধরার সুযোগ কী আছে !
সিলেটে যেকোনো ভিক্ষুকের প্রতিদিনের গড় আয় এক হাজার টাকা। আর বাস্তবে যেখানে নূরুল ইসলাম নাহিদ এমপি হিসেবে সরকার থেকে প্রতি মাসে সম্মানি ভাতা পান এক লক্ষ বাহাত্তর হাজার টাকা। এত টাকা পাওয়ার পরও যিনি জোর দিয়ে বলেন- তিনি ‘শতপতি’ । তার কাছে আমি ‘লুলা গাঙ্গ’ নিজেকে উদ্ধারের সহযোগিতা চেয়ে কতটুকু সহযোগিতা পাবার আশা রাখতে পারি?
তারপরও এই অঞ্চলের অভিভাবক হিসেবে তাকে বলি- মাননীয় সংসদ সদস্য (সিলেট ৬) আপনার মেয়াদকালে আমি ‘লুলা গাঙ্গ’ আমার প্রকৃত রূপ ফিরে পেতে জোর দাবী জানাচ্ছি। এবং বিয়ানীবাজার শহরটাকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে আমিও সহযোগি হতে চাই। সামান্য বৃষ্টি হলেই আমি ভুক্তভোগি জনগণের যেরকম অমানবিক, অনায্য গালিগালাজ সহ্য করি- তা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই। আমি এই অঞ্চলের কৃষি, ম্যস্য ও প্রকৃতির সেবক হয়ে চিরজীবী থাকতে চাই। আমার অতিরিক্ত কোন দাবী দাওয়া নেই- আমাকে আমার মূল জায়গায় (সরকারী ভূমি রেকর্ড অনুযায়ী) বসিয়ে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দিন। মাত্র কয়েকটি গোত্রের মানুষের স্বার্থের জন্য গোটা বিয়ানীবাজারবাসীকে দুর্ভোগ ও কষ্টে জীবন যাপন করতে বাধ্য করার অধিকার কারো নেই। এটি নাগরিকের মানবাধিকার লঙ্ঘন । এটি অন্যতম বড় অপরাধ।
ইতি
লুলা গাঙ্গ
বিয়ানীবাজার উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী ছোট নদী।
অনুলিখন : ছরওয়ার আহমদ
৪ জুলাই ২০২৪ ইংরেজী
আরও পড়ুন –