শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
https://blu-ray.world/ download movies
সর্বশেষ সংবাদ
দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ আর নেই  » «   লন্ডন মুসলিম সেন্টারে দুই শতাধিক মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হলো ‘ফেইথ ইন এনভারনমেন্ট’ সামিট  » «   রোবটিক্স বিজ্ঞানী ড. হাসান শহীদের নেতৃত্বে কুইন মেরি ইউনভার্সিটি অব লন্ডনে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মাল্টিরোটর সোলার ড্রোন উদ্ভাবন  » «   লন্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমির অফস্টেড রিপোর্টে ‘গুড’ গ্রেড অর্জন  » «   টাওয়ার হ্যামলেটস এডুকেশন অ্যাওয়ার্ডস : ১৮৫ জন শিক্ষার্থীকে সম্মাননা  » «   ব্যারিস্টার নাজির আহমদের “ইন্সপায়ার এ মিলিয়ন”নামে চ্যারিটি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা  » «   সম্মিলিত সাহিত্য ও  সাংস্কৃতিক পরিষদের ২০২৫-২৬ পরিচালনা পর্ষদ গঠন  » «   গ্রেটার ফতেহপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ইউকের সাধারণ সভা ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত  » «   আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মিল আর গুজব রাজনীতি  » «   পাচারকৃত টাকা বাংলাদেশে ফেরত আনার ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন ডা. শফিকুর রহমান  » «   প্যারিস-বাংলা প্রেসক্লাব ফ্রান্সের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন  » «   শেখ হাসিনা ও সাবেক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা  » «   ব্রিটিশ-বাংলাদেশী হুজহু’র ১৫তম প্রকাশনা ও এওয়ার্ড অনুষ্ঠান ১২ নভেম্বর  » «   বিসিএর ১৭তম এওয়ার্ড : উদযাপিত হলো বাংলাদেশী কারি শিল্পের সাফল্য  » «   কবি ফয়জুল ইসলাম ফয়েজনূরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসার আগ্রাসন’র মোড়ক উন্মোচন  » «  
সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন

 ডোন্ট গেট ওল্ড
লণ্ডন : অনুভূতি কথা



সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বৃটেনের  অন্যতম বড় ও আধুনিক প্রযুক্তির হাসপাতাল- রয়েল লন্ডন হসপিটাল এ ইমারজেন্সি বিভাগে এক্স রে ইউনিটে বসে আছি। শরীর এমনিতেই খারাপ।তার উপর খুব দুর্বল লাগছে। হাটতেও পারছিনা। তবুও দ্বিতীয়বার আসতে হলো। এক্স রে করে নার্স বলেছে- এই ওয়েটিং ইউনিটে , ডাক্তারের  জন্য অপেক্ষা করতে।

হাসপাতালটি খুব গোছানো,পরিপাটি,সৃজনশীল সুন্দর। ওয়েটিং চেয়ারে আমি একমাত্র বসে আছি। আশপাশে চারজন পেশেন্ট বেডে শুয়ে আছেন।

হাসপাতাল, রক্ত, ইনজেকশনে আমার মারাত্নক ফোভিয়া আছে। এরই মাঝে আমি বসে আছি।বাইরে আজ হীম ঠান্ডার সাথে প্রচন্ড ঝড় বাতাস। জিরো ডিগ্রী কোট থেকে মুঠো ফোন বের করে পুরনো ছবি দেখছি।

-হ্যাপি নিউ ইয়ার।উইশ ইউ হেভ লাভলী টাইম।

আমি কিছুটা চমকে তাকাই। চোখ যায় সামনের বেডে। দেখি একজন বৃদ্ধা বেড থেকে আমার দিকে চেয়ে আছেন এবং আমাকে উদ্দেশ্য করেই  বলছেন।

আমি বৃদ্ধার দিকে চেয়ে মায়াময় স্মিথ হাসি। মনে হলো  বৃদ্ধা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।

আমার ধারণা তাঁর আশি বা ছুই ছুই বয়স হবে। এবার তার মুখে যেন খই ফুটতে শুরু করেছে- বাংলায় তার তরজমা হলো- বাইরে কি খুব ঠান্ডা, না স্বাভাবিক। ক্রিসমাসে এবারও নাকি স্নো পড়েনি।তুমি কি দেখেছ? নিউ ইয়ার্স ইভ সেলিভ্রেশন কি টিভিতে দেখেছিলে না বাইরে আনন্দ করেছ?

-আমি কিছুটা ভড়কে যাই। তারপর বলি- আজ বাইরে প্রচন্ড বাতাস বইছে।হ্যাঁ, এবারও ক্রিসমাস ছিল স্নো বিহীন।গত বছরের মতো আঁতশবাজি ছিল। বাসায় টিভিতে দেখেছি, নতুন কিছু নেই বলে মনে হয়েছে।

বুঝা যাচ্ছে বৃদ্ধার শ্বাস কষ্ট আছে।একটু সময় নিয়ে বললেন, ধন্যবাদ তোমাকে।ডিসেম্বর থেকে হাসপাতালে আছি,কিছুই জানিনা। আমার ছেলে জন ফ্রান্সে থাকে। গতবার বলেছিল এই ক্রিসমাসে আসবে, এবারও আসেনি। গতবছর ছিল স্বামী এডামের সাথে শেষ ক্রিসমাস, এডাম আমার আগেই মারা গেল! এখন বাসায় একা থাকি। হাসপাতালে আমাকে কেউ দেখতে আসেনি। ধন্যবাদ তোমাকে।

বলতে গেলে আমি ব্যাথায় অনেকটা কাতর। পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা তার সাথে মাথা ঘুরচ্ছে। কয়েকদিন থেকে ঘুমও যেন ছুটিতে গেছে।

বৃদ্ধা দম নিয়ে আবারও কথা বললেন- এখানে  ডাক্তার নেই। কেউ আসবে বলেও মনে হয় না। তুমি কী এখানে থাকবে? শ্বাস কষ্ট নিয়েও তিনি কথা বলেই যাচ্ছেন।

বললাম, ডাক্তার বলেছে এক্স রে রিপোর্ট দেখে আমার সাথে কথা বলবে। নার্স এখানে বসতে বলেছে।

আমার ডান দিকে বেডে অবচেতনভাবে আছেন আরেক বৃদ্ধা। ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন। শক্তিহীন কণ্ঠে নার্সকে ডাকছেন, নার্স, পেইন কিলার প্লিজ –বার বার উচ্চারণ করছেন তিনি।মনে হচ্ছে ব্যাথায় ঘুরে মধ্যেই কথা বলছেন।

তার ঠিক পেছনের বেডে একজন বৃদ্ধ । অক্সিজেন লাগানো।আমার চোখে চোখ পড়তেই যেন আটকে গেল- শুধু চেয়ে আছেন,হয়তো কোন কিছু বলতে চাচ্ছেন,পারছেন না। আমি এক সময় চোখ নামিয়ে নিলাম। একটু পরে আবার চেয়ে দেখি- তিনি অপলকে আমার দিকে চেয়ে আছেন।

আরেকজন বৃদ্ধ একই লাইনে পেছনে।সম্ভবত তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, নাক ডাকার শব্দ শুনা যাচ্ছে। একজন নার্স  তার পায়ের নিচের বালিটটা নিদৃষ্ট জায়গায় আবার বসিয়ে দিয়ে ইউরিন ব্যাগটি খালি করছেন।

আগের বৃদ্ধা আমার মনযোগ নিতে জিঙ্গেস করলেন- এখন কটা বাজে? বললাম কোয়াটার পাস থ্রি।

বিনয় নিয়ে বললেন-থ্যাংকস। শুধু জানতে চাইলাম আরকি! এখানে সময়, দিন গুনতে নেই।বিশেষ করে আমার মতো বৃদ্ধদের।

আমি এবার কোন কথা বলিনা। প্রমিত হাসি ছড়িয়ে আই কনট্রাক -এ থাকি।

তিনি বললেন, তুমার কি ফ্যামলি আছে।

আমি বলি- হ্যা।পরিবারের কথা  একটু কথা তবে একলাইনে বলি।না বললে অভদ্রতা দেখায়,তাই বলা। মনে হলো এই বলাও বিব্রত অবস্থা  ডেকে আনল।

তিনি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। কি করবো আমি বুঝে উঠতে পারছি না। তার চাপা কান্না বাড়ছে,হাতের টিস্যু দিয়ে মুখ চেপে ধরেছেন।

অসুস্থতার জন্য এমনিতেই হাটতে পারছিনা। কিন্তু পারলেও এদেশে অজানা পেশেন্টদের কাছে যাওয়ার নিয়ম নেই। ব্যক্তিগত প্রাইভেসির বিষয়টি বৃটেনের ডাইভার্স সোসাইটি এবং যে কোন প্রফেশনে সর্বোচ্চভাবে মেনে চলতে হয়। বৃটেনে কনফিডেনশিয়ালিটি  ও ডাটা প্রটেকশন এ্যাক্ট খুবই কার্যকর,  কাজের অভিজ্ঞতা থেকেও জানি।

এবার পাশের বেডের বৃদ্ধা নিরব স্বরে বলতে লাগলেন- ইউ আর লাকি, ডোন্ট গেট ওল্ড, সান!

পাশের কামরা থেকে নার্স এসে বৃদ্ধার মাথায় হাত রেখে বললেন- ম্যারি, বলছিনা এসব নিয়ে না ভাবতে, প্লিজ। আমরা তো আছি। এখানে আমরাই তোমার স্বজন,পরিবার। ইউ অল আওয়ার সানশাইন।

বলতে গেলে আমি কিছুটা অস্বস্তি থেকে মুক্তির চেষ্টায় আছি। এশিয়ান নার্স আমার কাছে এসেছে নিছু স্বরে বললেন, ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার কথা আমি শুনছিলাম। ডাটা প্রটেকশন এ্যাক্ট এর কারণে আর কিছু বলতে পারবোনা। শুধু বলে রাখি- ওদের স্বজন আছে, অনেকের পরিবারের সদস্যও আছেন, কিন্তু কেউ তাদের দেখতে আসেননি অনেক দিন। তাই  তাদের মন খুব খারাপ থাকে সব সময়।

এখানে অনেকক্ষণ তাদের হয়তো থাকতে হতে পারে, কারণ হঠাৎ লিফটি খারাপ হয়ে গেছে।আপনার সঙ্গ তাদের আবেগে  ইতিবাচক নাড়া দিয়েছে।

আমি কষ্ট লুকিয়ে, হাসি ছড়িয়ে নার্সকে বললাম- আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। রোগীদের আন্তরিক সেবা, সঙ্গ দেবার জন্য।

পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা করছে, হাটতে পারছিনা। বসেই ডাক্তারের অপেক্ষায়ি আছি। এক্সট্রা কেয়ার  ও সেলটেড একোমোডেশন সার্ভিসে দীর্ঘ দিনের কাজের অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে এরকম অসংখ্য অনুভূতি কথা জমে আছে।বলতে গেলে  প্রবীনদের দেখলে  অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। আভিজাত্য,চাকচিক্য, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে বৃটেনের সমাজ ব্যবস্থার ভিতরের চিত্রটি ভালো করে জানি কাজের মাধ্যমেই। তাদের দেখলে পারিবারিক-সামাজিক বন্ধনের ভিতরের ক্ষতগুলো মূলত সামনে ভেসে উঠে।

একটু পরেই  ডাক্তার আমাকে দেখেন। পরবর্তি চিকিৎসা ও নির্দেশনা দেন। পাশে থাকা একজন নার্স   আমাকে ইন্ট্রাগ্রাম একাউন্ট দেখিয়ে বললেন- এটা আপনি, নাহ! আমি মুগ্ধতা ছড়িয়ে হাসতে চেষ্টা করি। ডাক্তার, নার্সদের মন ভালো করা অনুভূতি নিয়ে বাইরে আসতেই  মনে ধাক্বা লাগে। চারটি হাসপাতাল বেডে শুয়ে আছেন অসুস্থ চারজন বৃদ্ধ।মূলত মূল ক্যাবিন থেকে এখানে পোর্টাররা নিয়ে এসেছেন টিসি স্ক্যান, এক্স রে ইত্যাদির জন্য।

আমি তাদের দিকে তাকাচ্ছি। অদ্ভুদ ব্যাপার –দেখি তিনজন বৃদ্ধই আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি ভালো মানুষ না। সমাজে আমার অবদানও নেই। অনুভূতি প্রকাশে শব্দ নিয়ে একলা একলা খেলি। তবে এরকম দৃশ্যে আমার কেন জানি চোখে জল আসে।

আমাদের পাঁচজনের   দূরত্ব কয়েক গজের। পাশের বেডের অন্যজন আবার ডাকলেন নার্সকে। তাকে পাশ বদলিয়ে দেবার জন্যে। নার্স তাকে ওপাশ করিয়ে দিলেন। যেন এতেই মহা খুশী,কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন বার বার ধন্যবাদ দিয়ে।

আমি এবার উঠে দাড়াই। ইস্ট লন্ডনের বাসা থেকে হাসপাতালের দূরত্ব  খুবই কম। সুস্থ অবস্থায় হেটে আসলে ৭/৮ মিনিট লাগে। এখানে একা এসেছি বলতে গেলে সাহস করেই। পনের দিন পরিবারের সবাই দেশের বাইরে ছিলাম।বাসায় সবাই স্বর্দি-জ্বরে আক্রান্ত। খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বের হতে হবে হাসপাতাল থেকে। পরে না হয় টেক্সি  ডাকবো।

আমি তাদের দিকে চেয়ে আছি। কিছু বলতে পারছি না।

বৃদ্ধ মেরী বললেন,ভেরি কাইন্ড এন নাইস অব ইয়্যু।টেক কেয়ার, সান।

পাশেরজন মনে হলো অনেক কষ্টে বেড থেকে মাথা একটু তুলে বললেন, স্পেন্ড টাইম উইথ ইয়্যর ফ্যামলি।যে বৃদ্ধ ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন,তিনি এখনও ঘুমাচ্ছেন। অপরজন বললেন, নাইস চ্যাপ। ডোন্ট গেট ওল্ড, স্মাইল ওলয়েজ।

আমি মুখ লোকাতে চাইছি, এতক্ষণে চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। নার্সের হাত নাড়ার দৃশ্যের সাথে হাসার চেষ্টা করে লিফটের দিকে হাটতে থাকি….।

আহারে জীবন। মানুষ। স্নেহ-মায়া-বন্ধন।সম্পর্ক।ভালোবাসা। নি:সঙ্গতা।

লিফট আটতলায় এসে দরজা খোলার শব্দটি  জানিয়ে  দিচ্ছে- জীবন দৌড়ে আমাকে এবার উঠতে হবে। আশ্চর্য, লিফটে শুধু আমি। গ্রাউন্ড ফ্লোর বাটনে টিপ দিয়েছি। লিফট নিচের দিকে নামছে তার নিয়মে। আর আমার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে- ডোন্ট গেট ওল্ড…  । স্পেন্ড টাইম উইথ ইয়্যর ফ্যামলি…

আ নো য়া রু ল  ই স লা ম  অ ভি : কবি, সাংবাদিক

৪ জানুয়ারী ২০২৪, লন্ডন


সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

"এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব " -সম্পাদক