লিওনেল মেসি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের এক বিস্ময়কর নাম।ফুটবল মাঠে বল পায়ে মেসি এ পর্যন্ত যা করেছেন তাএক কথায় বর্ণনাতীত। মেসির ফুটবল কারিকুরি নিয়ে ধারাভাষ্যকার থেকে সাবেক ফুটবলার সকলেই একপর্যায়ে প্রায় হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হোন তাদের বিশেষণ এবং বিশ্লেষন ।শব্দের বর্ণনায় অনবদ্য ,অবর্ণনীয় হয়ে উঠে মেসির প্রতিটি ড্রিবলিং।
এজন্য ফুটবল ডিকশনারিতে একের পর এক শব্দ যুক্ত হতে থাকে নতুন বিশেষন। সাথে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়তে থকে মেসির অবিশ্বাস্য সব স্কিল এবং রহস্যময় ইনভেনশন।মেসির এই অবিশ্বাস্য, অতিমানবীয় স্কিলের কাছে, ড্রিবলিং এর কাছে কিংবা মাঠে তার নীরব বিচরণের কাছে কখনও স্লো রানের কাছে পরাস্ত হয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের প্লেয়াররা। প্রতিপক্ষ থেকে নিজেরাই হয়ে যান দর্শক; কখনো বা মাঠের মধ্যে হয়ে যান নিস্তব্ধ নির্বাক স্ট্রাচু ।
ডাগ আউটে বসে থাকা প্রতিপক্ষ কোচ এবং তাদের ডাটা এনালাইসিস কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে নিজ দলের কোচিং স্টাফ পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে যান- মেসির আনবিলিভেবুল মুভ দেখে গতি কিংবা গতি পথের বাকবদল দেখে। ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া এমন অসংখ্য গোল্ডেন মোমেন্ট সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন।
যেমন পেনাল্টি কিক নিতে গিয়ে যখন পাস দিয়ে দিলেন তখন মেসির কোচ এনরিখের ছবি দেখে কে বুঝবে ভিতরে অবস্থা কিংবা সিটি ডিফেন্ডারদের যখন নাগমুট করে বল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তারই গুরু পেপ গার্দিওয়ালার চেহারায় ছিল অসহায়ত্বের ছাপ ও অবিশ্বাসের দাগ। ডি বক্সের আশেপাশে সবচাইতে ভয়ংকর হলো মেসির ফলস রান। যা শুধু কোচ আর প্রতিপক্ষকেই বিভ্রান্ত করে না রেফারী এবং লাইনসম্যানদের মাথা ফাকাঁ করে দেয়।
মেসির ফুটবল কারিকুরিতে প্রতিনিয়তই এক মায়াবী বিভ্রমে পড়েছেন প্রতিপক্ষের ফুটবলার থেকে কোচিং স্টাফ পর্যন্ত কারণ তাদের ম্যাচ পূর্ববর্তী রণকৌশল মাঠের মেসিকে কখনোই রুখে দিতে পারেনি। এজন্যই প্রফেসর কোচ আর্সেন ওয়েংগার বলেছিলেন- মেসি হলো প্লে স্টেশনের ফুটবলার অর্থাৎ আপনি ভিডিও গেমে যা দেখেন মেসি সবুজ গালিচায় তাই করে দেখায়।
মাঠের মধ্যে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের মধ্য দিয়ে ম্যাজিশিয়ান মেসি যখন বল নিয়ে দ্রুতগতির সাপের মত আঁকাবাঁকা গতিপথ তৈরি করে এগিয়ে যান এক পর্যায়ে উম্মুক্ত করে দেন গোল মুখ তখন প্রতিরোধ প্রান্তের শেষ ভরসা গোলকিপারের আতংকিত হয়ে পড়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে মেসি নিজের সবচাইতে আপডেটেড ভার্সন নিয়েই যেন হাজির হয়েছিলেন মরুর বুকের সবুজ চত্তরে।ডাটা এনালাইসিসরা অসংখ্য ফুটবল বিশ্লেষক ভিডিও বানিয়ে দেখিয়েছেন ৯৯ শতাংশ প্লেয়াররা যেদিকে বল পাস করবেন বলে মনে করা হয়ে থাকে মেসি ঠিক অপজিট প্রান্তে কিংবা ভিন্ন ডিরেকশনে বল পাস করেছেন কিংবা বল নিয়ে নিজেই বেরিয়ে গেছেন।
এই যে প্রতিপক্ষকে প্রতিনিয়তই বিভ্রান্ত করার এক এবং অদ্বিতীয় কারিশমা; সেটি ম্যারাডোনা পরবর্তী যুগে এভাবে ফুটে ওঠে উঠেনি।
আরেকটি ব্যাপার এবারের বিশ্বকাপে খুবই আলোচিত হয়েছিল সেটি হচ্ছে মেসি মাঠে হাঁটেন।ক্যারিয়ারের শুরু এবং শেষ মিলালে এমনই তো হবার কথা ।
সাবেক আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার হুয়ান রিকুয়েলমে যাকে সর্বশেষ পার্ফেক্ট নাম্বার টেন বলা হয় তারার স্লো মুভের এই বৈশিষ্টটি মেসি নিজেই আয়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন বলেই এমন আপডেটের মেসিকে দেখেছে বিশ্ব ।
অলস সৌন্দর্যের এক পসরা সাজিয়ে মেসি হাজির হয়েছিলেন কাতার বিশ্বকাপে।বল পাওয়ার আগ পর্যন্ত স্লো মোশনে থাকা মেসি বল পাওয়ার পর চিতার ক্ষিপ্রতায় যেভাবে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের এলোমেলো করে দিয়েছেন প্রতিটি ম্যাচেই; সেটি রিপ্লেতে দেখলে কল্পনাকে টাচ করে যায়।এসব ও কি সম্ভব!
সবুজ গালিচায় লিওনেল মেসির এই ফুটবল ম্যাজিককে আপনি তুলনা করতে পারেন পাবেলো পিকাসোর তুলির মসৃ ছোঁয়ার সাথে কিংবা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাবলীল লিখে যাওয়া কবিতার ছন্দকে মাঠে রূপান্তর এর প্রক্রিয়ার সাথে।
কবিতায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি ফুটবল মাঠে উইথ দ্যা বল মেসির উদ্ভাবনী সব কৌশল দেখে ফুটবল মাঠেও কবিতা দেখেন; একজন ফুটবলারের বল পায়ে কবি হয়ে উঠা দেখেন।
একজন বিজ্ঞানমনস্ক দর্শক তেমনি মেসির ফুটবল স্কিল দেখে বল পায়ে একুরিসি দেখে কিংবা প্রতিপক্ষের শক্ত বাধাঁ অবলীলায় বালুর বাধেঁর মতো মিশিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া দেখে ফুটবল মাঠে বিজ্ঞান কেই যেন আবিষ্কার করেন। এ যেন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ধরে চলা কিংবা রসায়নের বিক্রিয়ায় কঠিনকে তরলে রূপান্তরের এক রোমান্টিক মুহূর্ত আবিস্কার করেন। গানিতিক জ্যামিতিকরা ভাবতে বাধ্য হন মেসির পাস কিংবা এসিস্ট গুলি তাহলে কোন কম্পাসের মাধ্যমে এতো নিখুঁত ভাবে কেন্দ্র হতে বৃত্তের রেখার নাগাল পেয়ে যায়।
তুলি শিল্পীরা মেসির বাঁ-পায়ের কারুকাজ দেখে শিল্পের ছোঁয়ায় দেখেন,এত অবলীলায়; স্বাভাবিকভাবে এত অল্প সময়ে যেভাবে তিনি বিভ্রান্ত করে দেন প্রতিপক্ষের সকল বাধাঁ শিল্পীর কল্পনা অথচ মাঠে লিওনেল মেসির বাস্তবতা এবং নিয়মিত বাস্তবায়ন।
মেসি হলেন ফুটবলের সেই সৌন্দর্য যেটা দেখে প্রতিপক্ষ থমকে দাঁড়ায় ;ম্যাচ পরিচালনায় থাকা রেফারির মাথা ফাঁকা হয়ে যায় সতীর্থরা মেসির পায়ে বল দিয়ে দম নেয়ার সময় পায় সর্বোপরি মেসির বল নিয়ে যখন সলো রান করেন তখন সতীর্থরা মাছের জাকের মতো এগিয়ে যায় অন্যদিকে মাছের জালের মতো প্রতিপক্ষরা এগিয়ে আসে ।
এই ক্ষুদ্র মোমেন্টামে ও দেখা যায় মেসি ঠিকই তার নিশানায় বল পাঠিয়ে দিয়েছেন খুবই অলস একটি মুভে স্বাভাবিকভাবে এমন কি ওয়ান টু ওয়ান এ যখন মেসি বল নিয়ে এগিয়ে যান তারও আগে সতীর্থ প্লেয়ারকে আগাম বলে দেন কোন জায়গাটা খালি হচ্ছে এবং কোন জায়গায় মেসি তাকে চাচ্ছেন এই দুই শূন্যে স্থান যখনই ফিলাপ হয়ে যাচ্ছে তখনই খুলে যাচ্ছে গোল মুখ।
এভাবেই মেসি একজন প্লেয়ার থেকে হয়ে উঠেছেন প্লে-মেকার।সেখান থেকে হয়ে উঠেছেন স্ট্রাইকার ।
সারা মাঠ জুড়ে বিচরণ করে হয়ে উঠেছেন নেতা; এর চাইতেও বড় বিষয় ৯০ মিনিটের খেলায় মেসি যেন হয়ে যান তার দলের নিউক্লিয়াস।
এই যে মাঠের মধ্যে প্রতিনিয়ই মেসির একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া চলমান তাকে সেটাই তাকে এই ৩৭ তম জন্মদিনে এসেও এখনো দলের প্রাণ ভোমরা হিসাবে টিকিয়ে রেখেছে।
মেসি শুধু স্কোরার হিসেবে যেমন বিশ্বের সকল স্কোরারদের সাথে টেক্কা দিচ্ছেন তেমনি একজন প্লেম্যাকার হিসেবে একই ভাবে তিনি প্রতিযোগিতা করতেছেন বিশ্বের সকল প্লেম্যাকারদের সাথে ।ফুটবলের প্রতিটি পজিশনেই যেন লড়াই করতে চান এই জিনিয়াস।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেসির সাফল্যের ট্রফি যখন দেখবে কিংবা পরিসংখ্যানে পড়বে তখন বর্তমান মাঠের প্রতিপক্ষ প্লেয়ারদের মতই পরিসংখ্যানবিদরা বিভ্রান্ত হতে বাধ্য । কারণ একই প্লেয়ার একই সাথে একই মৌসুমে সেরা প্লে-মেকার পুরস্কার পাচ্ছে ,সেরা স্ট্রাইকারের পুরস্কার পাচ্ছে; পাচ্ছে সেরা এসিস্ট কিংবা সেরা গোলের পুরষ্কারও।
এই বিভ্রান্তি মেসির বর্তমানের মত ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ফুটবল ইতিহাসের স্ট্রাইকারদের সাধারণত নাম্বার নাইন জার্সি দেওয়া হয় এবং নাম্বার নাইন মানেই দলের সেরা স্ট্রাইকার।
আধুনিক ফুটবলের টেকনিশিয়ান অনেক কোচ ফলস নাইন হিসাবে খেলিয়ে দেন প্লেয়ারদের। এই ফলস লাইনের তালিকা করতে গেলে নি:সন্দেহে বলা যায়- ফুটবল ইতিহাসের একেবারে পারফেক্ট ফলস নাইন হলেন লিওনেল মেসি অথচ ফুটবলে তিনি হয়ে আছেন এলএমটেন।
অবিশ্বাস্য কিংবা অকল্পনীয় কিছুর ব্যাখ্যায় ভবিষ্যতে যদি মেসি শব্দটি যুক্ত হয়ে যায় তাহলে অবাক হবার কিছু নেই কারণ এখনই ক্রীড়াপ্রেমীদের আড্ডায় এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে যখন পরাস্ত করতে পারে না তখন অবলীলায়, অবচেতন মনে বলে ওঠে- ‘তুই তো একটা মেসি’। দিস ইজ দা মেসি এফেক্ট এন্ড ইমপেক্ট।
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক
টরেন্টো,কানাডা। ২৪ জুন ২০২৩
আরও পড়ুন-