যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব নানা পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার মাধ্যমে একটি প্রভাবশালী ও মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার ক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভাপরবর্তী আয়োজিত এক ডিনারপূর্ব ডায়লগ অনুষ্ঠানে ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম এ মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে হাইকমিশনার লন্ডন এবং বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে থেকে আসা লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব সদস্যদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি মিশনের কনস্যুলার সার্ভিসের মান বাড়াতে তাঁর সচেষ্ট থাকার কথা উল্লেখ করে “মুজিব শতবর্ষ বিশেষ সেবা সপ্তাহ” পালন করার উদ্যোগের কথা ঘোষণা করে বলেন, লন্ডন মিশন থেকে যেসব সেবা নিয়মিত দেয়া হয় এই বিশেষ সপ্তাহে সেগুলো স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুত দেয়া হবে। এছাড়া ই-পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে যাতে লন্ডন মিশন প্রথম একটি হয় সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে বলে জানান হাইকমিশনার।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র হওয়া উচিত মন্তব্য করে বলেন, আগামী বছরের ১৭ মার্চের মধ্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে?আপাতত বঙ্গবন্ধু সেন্টার প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে।
এর আগে ব্রিটেনে বাংলা মিডিয়ার প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভা মঙ্গলবার বেশ জমজমাটভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এতে লন্ডন ছাড়াও মিডল্যান্ডস ও নর্থ ইংল্যান্ডসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক ক্লাব সদস্য উপস্থিত হয়ে প্রাণবন্ত প্রশ্ন-বিতর্কে অংশ নেন।
ক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ জুবায়েরের পরিচালনায় এতে আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে কোষাধ্যক্ষ আ স ম মাসুম। এরপর নেতৃবৃন্দ উপস্থিত সদস্যদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
পূর্ব লন্ডনের লন্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমি হলে পরের পর্বে অনুষ্ঠিত ‘ডায়লগ উইথ হাইকমিশনার’ অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক বক্তব্যে সাইদা মুনা তাসনিম সামগ্রিকভাবে সমাজ ও কমিউনিটির কল্যাণে, প্রেসক্লাবের ভূমিকার প্রশংসা করেন।
ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুবায়ের’র সঞ্চালনায় বাড়তি বক্তৃতাবিহীন ‘ডায়লগ’ অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার আশেকুন্নবি চৌধুরী। তিনি সংবাদ প্রকাশে সহযোগিতার জন্য সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে হাইকমিশনারের পরিচিতি পাঠ করেন ক্লাবের ইসি মেম্বার নাজমুল হোসাইন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী এবং ধন্যবাদ বক্তব্য রাখেন ট্রেজারার আ স ম মাসুম।
বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে হাইকমিশনার -হাইকমিশনের স্টাফ সংখ্যা থেকে শুরু করে সার্ভিসের মান, নতুন প্রজন্মের সাথে যোগসূত্র, মুজিববর্ষ, লন্ডনে বাংলা সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, বেক্সিক-পরবর্তী যুক্তরাজ্যের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সুযোগ গ্রহণসহ নানা ইস্যুতে ক্লাব সদস্যদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
এছাড়া তিনি কিছুকিছু ক্ষেত্রে হাইকমিশনের পরিবর্তন ও উন্নয়ন নিয়েও কথা বলেন। বিশেষকরে ২৪ ঘন্টার একটি বিশেষ ফোন সার্ভিস চালু এবং দিনে প্রায় ৩শটি ইমেলের জবাব দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন।
তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিলো প্রবাসী ভোটাধিকার, জমি-জমা সংক্রান্ত হয়রানী, বাংলাদেশের পর্যটন এর সমস্যা-সম্ভাবনা, বিমান ও সোনালী ব্যাংকের সমস্যা, বিনা খরচে প্রবাসীদের মরদেহ দেশে পাঠানো, একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, হাইকমিশনের দাওয়াত নিয়ে নানা ইস্যু, ই-পাসপোর্ট ও স্মার্টকার্ড কার্যকর ইত্যাদি নিয়ে।
প্রায় দু‘ঘন্টাব্যাপী প্রশ্নোত্তর পর্বে হাইকমিশনার বলেন, ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে মুজিববর্ষ শুরু হচ্ছে এবং আগামী বছরের ১৭ মার্চ পর্যন্ত জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিক উপলক্ষে বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক শহরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। এরমধ্যে রয়েছে “মুজিবশতবর্ষ বিশেষ সেবাসপ্তাহ”। এসময় নতুন পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়ন, বাংলাদেশি-ব্রিটিশদের এনভিআর ইস্যু, পাওয়ার অব এটর্নি দলির সম্পাদন, জন্ম-নিবন্ধনএবংবাংলাদেশে জমিজমা সংক্রান্ত জটিলতাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে দ্রুত সহযোগিতা প্রদান। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কিছু কিছু সেবা তাৎক্ষণিক প্রদান করা হবে।
হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম জানান, বিগত এক বছরে লন্ডন মিশনে সব ধরনের সেবা প্রদানের হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন পাসপোর্ট ইস্যুর হার বেড়েছে ৩২%, ভিসা ১২%, এনভিআর ৮%, বিভিন্ন ডকুমেন্ট সত্যায়নের হার ২২% ও জন্ম-নিবন্ধন ৬%। এসময়ে মোট ৫৬,১৩৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়া হয়েছে, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ১০% বেশি।
তিনি আরো জানান, ই-মেইলেও প্রতিদিন অনেক মানুষ হাইকমিশন থেকে তথ্য সেবা নিচ্ছেন। এছাড়া কনস্যুলার শাখায় ডেস্কটপ কম্পিউটার, ফটোসার্ভিস, ফটোকপি সার্ভিস ও ইলেক্ট্রনিক টোকেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। যার ফলে সেবাগ্রহিতারা আগের চেয়ে অনেক সহজে কনস্যুলার সেবা নিতে পারছেন। বাংলাদেশি-ব্রিটিশদের দোরগোড়ায় এসব সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য লন্ডনের বাইরে বিভিন্ন শহরে এবং আয়ারল্যান্ডেও কনস্যুলার সেবার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। প্রবাসীর ভূমি দখলবিষয়ে তারা আলাদা ডেস্ক চালু করেছেন। যে কোনো অভিযোগ তারা ডিসি বা ওসির কাছে পৌছে দেন।
হাইকমিশনার বলেন, সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি হাই কমিশন গত বছর জাতীয় দিবসগুলো পালনসহ বিভিন্ন ধরনের ৩০টিরও বেশি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশ হাই কমিশনের মিনিস্টার (প্রেস) আশিকুন নবী ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ক্লাবে নেতৃবুন্দ ও সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানান।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের এক বছরে ব্যতিক্রমী কর্মসূচীসহ ১৩টি আয়োজন
এদিকে বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ ব্যতিক্রমী নানা কর্মসূচীসহ গত ১২ মাসে প্রায় ১৩টি অনুষ্ঠানের কথা তুলে ধরেন। আগামী দিনগুলোতে ক্লাবের নিজস্ব একটি প্রোপার্টি ক্রয় এবং অন্যান্য রুটিন কর্মসূচী পালনে সকলের সহযোগিতা কামনা করা হয়।
ক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, আমরা প্রেসক্লাবের যে মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার ও ঐক্যের কথা বলি সেটি রক্ষা করার ক্ষেত্রে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে সোচ্চার ছিলাম। একারণে নিয়মিত কর্মসূচীর বাইরেও কিছু চ্যালেঞ্জ মোকবেলাও করতে হয়েছে আমাদের। তবে সবক্ষেত্রেই সাধারণ সদস্যরা ছিলেন সহযোগী।
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, বর্তমান কমিটি দায়িত্ব লাভের পর পরই আমাদের ভাষার মাস ফেব্রয়ারীতে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন ও তথ্যনির্ভর উপস্থাপনার মধ্যদিয়ে উদযাপিত হয় একুশের অনুষ্ঠান। ১২ মাসে অন্তত ১৩টি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচীর আয়োজন ছিলো এবার। এরমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বাংলাদেশের তিনজন মন্ত্রীর সাথে খোলামেলা আয়োজন আর ‘কোয়েশ্চনটাইম’ ক্লাবের কার্যক্রমে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। কোনো ব্রিটিশ হাইকমিশনার কিংবা বাংলাদেশের হাইকমিশনারের প্রথমবারের মতো ক্লাবে আসা ও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টিও ছিলো আলাদা গুরুত্বের। সাংবাদিকতার ‘এথিক্স এন্ড স্ট্যান্ডার্ড’ নিয়ে বিশেষ আলোচনা, স্বাধীনতাদিবসে‘শহীদ পিতাকে ফিরে পাওয়ার গল্প’ এবং বিজয় দিবসে ‘শহীদ পিতার গল্প’ শীর্ষক আলোচনাও প্রেসক্লাবের বিশেষত্বের জানান দিয়েছে।
এছাড়াও বরাবরের মতো পিকনিক, বৈশাখী আড্ডার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ছিলো ইনডোর গেমসের আয়োজন। এছাড়া ক্লাবের নতুন অফিস বছরজুড়ে চালু রাখার নতুন দায়িত্ব যেমন আমরা পালন করেছি, তেমনি ক্লাবের বড় স্বপ্ন নিজস্ব প্রোপার্টি ক্রয়ের বিষয়টিও বিবেচনায় আছে।
সেক্রেটারি এ বছরের এজিএম-এ যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশী সদস্যের উপস্থিতিতে আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, সাধারণ সদস্যরাই ক্লাবের প্রাণ এবং তাদের সমর্থন আমাদের উৎসাহ যোগায়।
ক্লাব ট্রেজারার আ স ম মাসুম বলেন, আমরা নতুন লাইফ মেম্বারের মাধ্যমে আরো ২৫/৩০ হাজার পাউন্ড কালেকশনের চেষ্টা করছি। এর মাধ্যমে এই বছরের মধ্যে আমরা প্রোপার্টি ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে চাই।
অনুষ্ঠানে প্রেসক্লাবের লাইফ মেম্বার যথাক্রমে বিসিএ, চেম্বার, বিবিসিএ, বাংলাদেশ সেন্টারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অংশ নেন। টেলিভিশনগুলোর প্রধানদের মধ্যে অংশ নেন চ্যানেল এস চেয়ারম্যান আহমদ-উস সামাদ চৌধুরী জেপি, এটিএন বাংলার সিইও হাফিজ আলম বক্স, এনটিভির প্রধান নির্বাহী সাবরিনা হোসেন এবং টিভি ওয়ানের ডিরেক্টর গোলাম রাসুল।
ছবি: খালেদ হোসেন; আলোকচিত্রী ৫২বাংলা ।