জেন জি বিক্ষোভ ঘিরে যা ঘটেছে
নেপালে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, নেতাদের বাড়িতে আগুন
- আপডেট সময় : ১২:০৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / 103
তীব্র গণআন্দোলন ও সহিংসতায় রক্তপাতের পর মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। তিনি ছিলেন নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফাইড মার্কসবাদী–লেনিনবাদী)–এর চেয়ারম্যান। গত বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার পর থেকে সোমবার তরুণদের নেতৃত্বে দুর্নীতি ও নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়, যা সহিংসতায় রূপ নেয়। ওই দিন পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৯ জন নিহত হন। এরপর থেকেই ওলির পদত্যাগের দাবি ওঠে।
২০২৪ সাল থেকে নেপালে ওলির দল ও নেপালি কংগ্রেসের জোট সরকার ক্ষমতায় আছে। দুই দশক ধরে চলা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর ২০০৮ সালের গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২৪০ বছরের পুরোনো রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
গণতন্ত্রে রূপান্তরের পথ সহজ ছিল না। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে পৌঁছাতে প্রাণ দিতে হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার নেপালিকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত আট হাজার ছিলেন সাধারণ নাগরিক।
তবে আগের দীর্ঘ আন্দোলনে এত প্রাণহানির পরও এবারের পাঁচ দিনের গণঅভ্যুত্থানকে সবচেয়ে সহিংস বলে মনে করছেন নেপালিরা।
দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট–কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. অরুণা উপ্রেতি বলেন, এ ঘটনাকে তিনি রাজা জ্ঞানেন্দ্রর শাসনামলের শেষ দিকের দমন–পীড়নের সঙ্গে তুলনা করছেন।
তিনি বলেন, “এই সরকার তরুণদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে জ্ঞানেন্দ্র শাহর পথই অনুসরণ করছে। এমনকি আশির দশকে পঞ্চায়েত শাসনামলের গণঅভ্যুত্থান দমনের ঘটনাকেও আজকের সহিংসতা ছাড়িয়ে গেছে।”
উপ্রেতি আরও বলেন, “ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএন–ইউএমএল ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়েছে। দমন–পীড়ন করে জনগণের মনে জমে থাকা ক্ষোভ কমানো যাবে না।”
ঘটনার আকস্মিকতায় সাধারণ মানুষ বিস্মিত। তাঁদের অনেকে ভাবেননি যে তরুণদের এই আন্দোলন এতটা সহিংস হবে এবং এত প্রাণহানি ঘটাবে। তাঁদের মতে, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ অনুসারী নয়।
আন্দোলনের নেপথ্যে অর্থনৈতিক সংকট
হিমালয় কন্যা নেপালে প্রায় তিন কোটি মানুষের বসবাস। এবারকার গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত ১৩ থেকে ২৮ বছর বয়সী তরুণরা। অনেকে এটিকে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ বলে মনে করছেন।
আন্দোলনের সংগঠকরা জানাচ্ছেন, শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ নয়—অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন।
বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, নেপালে ১৫–২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০ দশমিক ৮ শতাংশ।
সিএনএন জানিয়েছে, সম্প্রতি নেপালে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে #Nepokid হ্যাশট্যাগ, যা ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক দুর্দশায় জর্জরিত সাধারণ তরুণদের সামনে অনলাইনে সেই সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপন আরও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
অর্থনীতির বড় অংশ নির্ভরশীল প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সের ওপর। দেশটির জিডিপির প্রায় ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ আসে প্রবাসী আয় থেকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, গত তিন দশকে এই নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে।
একজন বিক্ষোভকারী রয়টার্স–কে বলেন, “প্রত্যেক নেপালিই দুর্নীতি নিয়ে হতাশ। প্রত্যেক তরুণই দেশ ছাড়তে উন্মুখ। সুতরাং, আমরা তরুণদের বাঁচাতে ও অর্থনীতির উন্নতি চাই।”
আন্দোলনের সূচনা যেভাবে
গত সপ্তাহে বিদ্বেষ ও ভুয়া খবর ঠেকানোর অজুহাতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব ও এক্সসহ কয়েকটি সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেয় সরকার। বৃহস্পতিবার রাতে ২৬টি ওয়েবসাইটও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এর পরপরই তরুণরা রাজপথে নেমে আসে। নাগরিক সমাজও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সরকারের এ হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে।
সোমবার বিক্ষোভকারীরা কাঠমান্ডুর সংসদ ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করে। তাঁদের অনেকের পরনে ছিল স্কুল–কলেজের ইউনিফর্ম। এসময় পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে। বিক্ষোভকারীরা একটি অ্যাম্বুলেন্সে আগুন ধরায় এবং রাস্তায় ব্যারিকেড ফেলে পুলিশকে ঠেকানোর চেষ্টা করে।
এএনআই–কে একজন বিক্ষোভকারী বলেন, “পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছিল।”
সে দিনই কাঠমান্ডুতে ১৭ জন নিহত হন, আরও দুজন প্রাণ হারান পূর্বাঞ্চলের ইতাহারি শহরে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ আহত হন চার শতাধিক মানুষ।
আন্তর্জাতিক মহল সহিংসতার নিন্দা জানায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় হতাহত ঘটনায় ‘হতবাক’ হওয়ার কথা জানায় এবং স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানায়।
এ ঘটনার পর একে একে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। তবে জোটের ভেতর থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধানমন্ত্রী ওলি। জোটসঙ্গী নেপালি কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক গগন থাপা তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানান।
হিমালয়ান টাইমস জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পুডেলকে লেখা পদত্যাগপত্রে ওলি দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি স্বীকার করে সাংবিধানিক রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। মঙ্গলবারও বিভিন্ন এলাকায় মিছিল ও সংঘর্ষের পর কাঠমান্ডুসহ দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এনডিটিভি, কাঠমান্ডু পোস্ট ও হিমালয়ান টাইমস।
তবে স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, কোথাও কোথাও কারফিউ ভেঙেই বিক্ষোভ চলছে। অনেক এলাকায় গ্রেপ্তারের খবরও পাওয়া গেছে।
এনডিটিভি জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পুডেল ও প্রধানমন্ত্রী ওলির বাড়িতে আগুন দিয়েছে।
পুডেলের বাড়ির ভেতরে বিক্ষোভকারীদের ঘোরাফেরা ও ভাঙচুরের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমার দাহাল প্রচণ্ড, শের বাহাদুর দেউবা ও জ্বালানিমন্ত্রী দীপক খাডকার বাসভবনেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি নেপালি কংগ্রেসের সদর দপ্তরেও আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।



















