কিশোর গ্যাং : সমাজ ও ব্যক্তি এ দায় এড়াতে পারি না
- আপডেট সময় : ০৬:০০:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুন ২০২১
- / 1445
ইদানিং পত্রপত্রিকায় কিশোর গ্যাং বিষয়ে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু খবর বেরুচ্ছেই।সমস্যাটি যে করোনা ভাইরাসের মতোই মহামারি হতে চলেছে, খবরের সংখ্যা বেড়ে চলা থেকেই সেটি স্পষ্ট। আমাদের বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীর একটি অংশ ক্রমান্বয়ে এ গ্যাং কালচারের সাথে জড়িয়ে পড়ার কারণে অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন। অভিভাবকদের সাথে বিভিন্ন সময় আলাপের প্রেক্ষিতে তাদের নিকট থেকে জানা -অজানা অনেক দুঃখ, যন্ত্রণা,কষ্টের কথামালা প্রাতিষ্ঠানিক কাজে এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রায়শ শুনতে হয়।
কিশোর গ্যাং! এক আতংকের নাম! এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশু- কিশোরদের একটি অংশ। তারা করে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর সব অপরাধ।
এই অপরাধটি নতুন নয়। কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে যত দিন যাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণরুপে দেখা দিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো হিংস্র ধরণের অপরাধ করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে। কৈশোরে ছেলে-মেয়েদের আচরণ পরিবর্তিত হয়। তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয় ।ফলে এরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে। এই কিশোরেরা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। ঐ সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার- আচরণ সবকিছু আলাদা।
পারিবারিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়ার কারণেই থামানো যাচ্ছে না এই গ্যাং কালচার। গ্যাং কালচারের কিশোরদের অধিকাংশই মাদকসেবী।মাদক এমন এক জিনিষ যেটা ব্রেনের নার্ভকে নষ্ট করে দেয়। ফলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না বা মূহুর্তেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এসব কারণে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে এবং খুনোখুনি বেশী হচ্ছে। এই কিশোরেরা নিজেকে ক্ষমতাবান করতে চায় -এ জন্য গ্যাং গড়ে তুলে।
সমাজ ব্যবস্থা, পরিবার , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানাবিধ উপকরণ গ্যাং কালচার তৈরির উপাদান হিসেবে কাজ করে। আধিপত্য বিস্তারের নেপথ্যে মারামারি, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের ভয়ঙ্কর মহড়া, মাদক এবং ইয়াবা সেবন ও বিক্রি, চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্যক্ত করা এমনকি খুন-খারাবি সহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছে ভবিষ্যত সমাজের অপার সম্ভাবনাময়ী এ সকল গ্যাং এর তরুণেরা।
একই কমিউনিটির ভিতর যখন দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে তখন ,উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণীর সন্তানেরা নিজেদের ভাগ্যকে বঞ্চিতদের ভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করে হতাশা অনুভব করে। এই হতাশা থেকে তার অস্তিত্ব জানান দিতে সে গ্যাং তৈরি করে ।
ভিনদেশী কালচারের অনুপ্রবেশে অনুকরণপ্রবনশীল কিশোরেরা যখন সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে তখন সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ঐ কালচার রপ্ত করতে চায়।
তারকাখ্যাতি, হিরোইজম, ক্ষমতা, বয়সের অপরিপক্কতা, অর্থলোভ,শিক্ষাব্যবস্থার ঝুঁকি, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধপ্রবনণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে শিশু-কিশোরদের নৈতিক স্খলনও হচ্ছে।
পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়ায় তাদের সামাজিকীকরণ ও মানসিক বিকাশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে সমাজের বিভিন্ন গ্যাং কালচারের সাথে কিশোরেরা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে ।
নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা- মা যেমন দুজনই কাজে বেরিয়ে যান তেমনি, উচ্চবিত্তে পরিবারের বাবা- মা সন্তানকে সময় দেন না- ফলে তারা নানা ধরণের গেমস, সিনেমা দেখে এবং একাকিত্বের কারণে অপরাধী হয়ে উঠে। আর সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরাধ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারও তাদের অপরাধে প্রলুব্ধ করে।
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে সহায়তা করবে।তবে পরিবারের নজরদারি ও মূল্যবোধই এই কিশোর অপরাধ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করবে।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে ।আগেকার মতো স্কুল -কলেজে সাহিত্য, সংস্কৃতি খেলাধুলার চর্চা বাড়াতে হবে।স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এবং নেতৃত্ব তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরী তৈরি করে বই পড়ার কালচার ফিরিয়ে আনতে পারলেই কিশোর গ্যাং এর অপরাধ মূলক কাজ থেকে আমরা নিরাপদ থাকতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক: মো: কবির খান,প্রধান শিক্ষক, সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।
আরও পড়ুন:
https://52banglatv.com/2021/06/28945/























