“ফেনোমেনন ” শব্দের বাংলা অর্থ আরো জটিল কিংবা কঠিন। অনেকগুলো অর্থ সমষ্টির যোগফল থেকে এক শব্দে বেরিয়ে আসতে হলে আমার মনে হয় “ব্যাখ্যাতীত ” শব্দটি তুলনামূলকভাবে সহজ বাংলা।
এই শব্দটির প্রচার কিংবা ব্যবহার যার কারণে বা যার দ্বারা বিকশিত তিনি রোনালদো লিমা। ব্রাজিলিয়ান ফুটবল স্টার।
ক্রিকেটার ক্রিস গেইলকে যেমন বলা হয় বিশ্বব্যাপী ভ্রাম্যমাণ এক ক্রীড়া বিনোদিয়া, রোনালদো তেমনি ক্লাব ফুটবলে এক বিনোদিয়া। ন্যাশনাল টীমের ক্ষেত্রে আরো বেশী চিত্তবিনোদন দাতা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফুটবল যখন শুধুই বিশ্বকাপ কেন্দ্রিক এক মহা আয়োজনের নাম বিশেষ করে মফস্বল শহরে ফুটবল মানেই বিশ্বকাপ, ঠিক সময়ে রোনালদো তান্ডবে ছারখার হচ্ছিল ইতালি এবং স্পেনের ক্লাব প্রতিপক্ষগুলোর ডিফেন্স লাইন।
মৌসুমগুলোতে যখন ত্রিশ গোল করাকেই হিমালয় মনে হতো, তখন রোনালদো নিয়মিত চল্লিশের কোটা অতিক্রম করছিলেন। ক্যাবল লাইনের অপ্রতুলতার মাঝেও কলেজ জীবনের সেসময় এ ক্লাব ফুটবলের এই স্কোরারকে ভালো লেগে যায় মারাত্মকভাবে। বাতিস্তুতাকে সরিয়ে রোনালদো-ই হয়ে উঠে এক প্রিয় স্ট্রাইকার।
ম্যারাডোনা পরবর্তী যুগে একজন পূর্নাঙ্গ ফুটবলার ছিলেন জিনেদিন জিদান আর একজন পূর্ণাঙ্গ স্ট্রাইকার ছিলেন রোনালদো লিমা। অথচ সেসময়ে ব্রাজিলের ফুটবল দলে স্টারদের ছড়াছড়ি ছিল- দেখার মতো। শুধু মাত্র একটি উদাহরণ দেই – রোমারিও কে প্রধানমন্ত্রীর চাপে ও দলে নেননি কোচ। বুঝুন রোমারিও র বিকল্পও দলে ছিলো!
রোনালদোর পরিসংখ্যানই আপনাকে তার সফলতার হিসাব মিলিয়ে দেবে কিংবা লাইভ ম্যাচ না দেখার কারণ আপনি যেটি মিস করে গেছেন বা যাবেন সেটি হলো -ম্যাচের প্রেক্ষাপট, টুর্নামেন্টের অবস্থা, দলের অবস্থান, স্নায়ু এবং মিডিয়া চাপ।
এতো কিছুকে এতো অল্পবয়সী রোনালদো যেভাবে টপকিয়ে গেছেন সেটাকে একমাত্র তার নিজের বডিডজ এর সাথেই তুলনা করা যায়।
গোল স্কোরিং এর সময়ে রোনালদো যেভাবে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের বডি ডিজের মাধ্যমে অবলীলায় টপকিয়ে যেতেন সেটি অতীতে কিংবা বর্তমানে তেমন করে আর কেউ পারেনি। এইটাই ছিল রোনালদোর ট্রেড মার্ক এর সাথে যুক্ত করুন দ্রুতগতিতে দু পায়ে ড্রিবলিং এর এক অনুপম প্রদর্শনী।
ফুটবল যদি হয় গোলের খেলা তবে সেখানে গোল দাতার প্রতি আকর্ষণ, মিডিয়া ফোকাস থাকবে এইটাই স্বাভাবিক আর সেই গোল নামক সোনার হরিণ ডিফেন্ডারদের বডি ডজের কে খুবই স্বাভাবিকভাবে অত্যন্ত নিখুঁত আর চমৎকার ভাবে ডিফেন্ডার আর গোলকিপারদের পরাস্ত করে জালে নিয়মিত দিতে পারতেন বলেই মাত্র পাচঁ বছর আগেও ইতিহাসের কোন ড্রীমটীম তৈরী করতে হলে নাম্বার নাইন কিংবা মেইন স্ট্রাইকার হিসাবে রোনালদোর নাম না লিখা ছাড়া উপায় ছিল না । ছিল না বলার কারণ- ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কারণে এখন ইতিহাসে ড্রীম টীমে স্থান হয়তো হারাবেন কিন্তু একজন পূর্ণাঙ্গ স্ট্রাইকার এর নাম সবসময়ই রোনালদো থাকবে যিনি দশটি গোলের সুযোগ তৈরী হলে নয়টিই গোল করতে পারমঙ্গ ছিলেন।
হ্যাঁ অনেকের মতো একসময় আমারও বক্তব্য থাকতো – ক্যারিয়ার দীর্ঘ হলে কি না কি হতো ? কিন্তু এখানেই ইতিহাসের খেলা। আপনি কি ছিলেন, কি হয়েছেন, কি হতে পারতেন- এসব ভক্ত হিসাবে আফসোস এর নাম। আপনাকে লং রানে কি করতে হয় সেটি না করতে পারলে সময়ের সেরা হওয়া সম্ভব কিন্তু ইতিহাসের সেরা না।
ক্রিকেটে শচীন , ফুটবলে পেলে ম্যারাডোনা, মেসি, রোনালদো এজন্যই সেরাদের সেরা। কারণ মারাত্মক কিছু করে ম্যারাডোনা একমাত্র ব্যতিক্রম আর বাকিরা পারফরম্যান্স এর সাথে খুবই ডিসিপ্লিন লাইফস্টাইল এর অধিকারী এবং এজন্য ইতিহাসে রোল মডেল।
ল্যাটিন আমেরিকার প্লেয়ারদের মাঝে এই ডিসিপ্লিন নেই বলেই রোনালদিনহো ,রোনালদোর মতো অসংখ্য সৃজনশীল প্লেয়ারদের ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয়নি।
ধুমকেতু হয়ে জ্বলেছে কিন্তু স্থায়ী তারা হয়ে থাকতে পারেনি ফুটবলাকাশে। রোনালদো লুইজ নাজারিও, ডি লিমা যদিও ধুমকেতু নয় ; তিনি তারাই । তবে এখানেই সেই আফসোস- ধ্রুবতারা হয়তো নয়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের জন্য যিনি ক্যারিয়ারকেই ছোট্ট করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে ক্যারিয়ারের সবচাইতে বড় ক্ষত ও সেই সেরা ফর্মের সময়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে রহস্যময় এক অসুস্থতা কিংবা নিষ্ক্রিয়তার জবাব আজো মেলেনি।
তবে মিলেছিল অদ্ভুত হেয়ার কাটিং এর রহস্য। এক সাক্ষাৎকার- এ বলেছিলেন, নিজের ছোট্ট বাচ্চা টিভিতে রবার্ট কার্লোসকে নাকি বাবা ডেকে ফেলে চিনতে না পেরে। তখনকার ব্রাজিল দলে ন্যাড়া মাথার অনেক প্লেয়ার থাকাতে রোনালদো নিজের মাথার সামনে এক চাকতি চুলের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন যাতে তার বাচ্চা বাবাকে টিভিতে চিনতে পারে।
বর্তমান রোনালদোর সাথে এক সময়ে ব্যবধান উনিশ- বিশ থাকলেও এখন ক্লিয়ার উনিশ নয় বিশ -ই । শুভ জন্মদিন ফেনোমেনোন।
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক
টরেন্টো,কানাডা। সেপ্টেম্বর ২০২৩
আরও পড়ুন-