বিগত কয়েক বছর থেকে সিলেট এর বিয়ানীবাজার উপজেলার জনসাধারণ মোটর সাইকেল চুর আতঙ্কে ভুগছেন । বিশেষ করে থানা সদরে মোটর সাইকেল চালক একটু বেখেয়ালি হলেই মুহুর্তে গায়েব হয়ে যাচ্ছে তার মোটরবাইকটি। মোটর সাইকেল চুরি বিয়ানীবাজারে এখন এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, বিষয়টি এখন কারো কারো কাছে গা সওয়া বিষয়ের মতো হয়ে গেছে।
ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রাচুর্যে ভরা অঞ্চলের নাম বিয়ানীবাজার। অসংখ্য জ্ঞানী, গুনী ও মনীষিদের জন্মভূমি বর্তমান বিয়ানীবাজারের আরও দুটি নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জল হয়ে আছে। দূরঅতীতে ভারত বর্ষের নবদ্বীপ এর পরেই এই অঞ্চলকে ‘নবদ্বীপ’ বলা হতো। অসংখ্য পন্ডিত, মনীষি ও প্রাজ্ঞজনদের আলোকিত কর্মকান্ড সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ায় বিয়ানীবাজারকেও বলা হতো নবদ্বীপ । এই অঞ্চলের আরেক নাম হলো- পঞ্চখণ্ড। এই ‘পঞ্চখন্ড‘ও ইতিহাসে বিয়ানীবাজার তথা সিলেটবাসীদের জন্য ঐ একই কারণে গৌরবউজ্জ্বল হয়ে আছে।
বিয়ানীবাজারের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসও আমাদের গর্বিত করে। সামাজিক সম্প্রীতি এবং রাজনৈতিক শ্রদ্ধাবোধ অন্য যে কোন অঞ্চলের চাইতে বহুগুন উর্ধে আছে এটা নিন্দুকেরাই স্বীকার করেন।
বিনায়ীবাজার উপজেলায় খুব কম সংখ্যক পরিবার রয়েছে যাদের ঘরে কোন প্রবাসী নেই। বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক শক্ত অবস্থান এর কথা বলতে গেলে দুটি উদাহরণ দেয়া যায়- এক. অনেকে বলে থাকেন যে, বাংলাদেশে উপজেলা পর্যায়ে বিয়ানীবাজার হচ্ছে প্রথম উপজেলা, যেখানে সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকসমূহের প্রায় অর্ধশত শাখা রয়েছে। দুই . বিয়ানীবাজারের মতো এতো বেশী মোটর সাইকেল উপজেলা পর্যায়ে দ্বিতীয়টি নেই !
বর্তমান সময়ে বিয়ানীবাজারে মোটর সাইকেল চুরির ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। পত্রিকার সংবাদ এবং স্যোসাল মিডিয়াতে প্রায় প্রতিদিন চুরির খবর প্রকাশ হচ্ছে। যা খুবই উদ্বেগজনক।
প্রশ্ন হলো জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ প্রশাসন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা থাকতে জনগণ চুর আতঙ্কে ভূগবে কেন ? প্রশাসন যদি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করে এবং পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনের কর্মকান্ডের উপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখে, তাহলে এইভাবে বার বার চুরির ঘটনা ঘটার কথা না ।
বিয়ানীবাজারে যখন কোনো মটর সাইকেল চুরি সংগঠিত হয়, তখন, পুলিশ ও ‘পুলিশের অনুগত‘ রাজনৈতিক নেতারা তৎপর হন। মাঝে মধ্যে দুই- চারটা চুর পাকড়াতে সক্ষম হন । জনগণের চাপে আটককৃত চুরকে জেলে পাঠানো হয়। চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট গডফাদারদের নাম উদ্ঘাটন করতে থানায় আবারও চুরকে রিমান্ডে আনার ব্যবস্থা করা হয় ।
প্রশ্ন হলো, এপর্যন্ত থানায় আসামীদের রিমান্ডে এনে কি ‘চুরি সংগঠিত হওয়া কোনো তথ্য‘ বা ‘চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট গডফাদার‘দের নাম চুড়ান্ত এজাহারে অন্তর্ভূত করে তা কী কোর্টে পাঠানো হয়েছে ? অথবা স্থানীয় সাংবাদিকদের ডেকে এসম্পর্কে জানতে দেওয়া হয়েছে ?
বাস্তবতা হলো দেশে বিদেশে অবস্থানরত বিয়ানীবাজারবাসী এখনও একরম কোন তথ্য (চোরদের সাথে জড়িতদের বিস্তারিত তথ্য বা চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট গডফাদারদের নাম) জানে না।
মোটর সাইকেল চুরি নিয়ে বিয়ানীবাজারবাসীর মনে এখন একটা বদ্ধমূল সন্দেহ যে, এইসব চুরির সাথে জড়িত বিশাল সিন্ডিকেটদের আড়াল করতে মাঝে মাঝে দুই -চারটা চুর ধরে জনগণের সামনে আইওয়াসের নাটক সাজানো হয় ।
বিয়ানীবাজারের জনগণ মনে করে, মোটরসাইকেল চুরদের পিছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী চক্র । সঙ্গতকারণে দীর্ঘ দিন থেকে চুরি বন্ধ না হওয়ায় মানুষের সন্দেহের তীর এখন প্রশাসন ও ‘পুলিশের অনুগত‘ রাজনৈতিক কতিপয় নেতাদের প্রতি।
জনগণ মনে করে, চোরদের মূল শিকড় উৎপাটন না করার অর্থ হচ্ছে -চুরদের কাছ থেকে প্রশাসন ও প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের বিপুল আয়ের উৎস অব্যাহত রাখা ।
বিয়ানীবাজার অঞ্চলের মানুষ রাজনৈতিক সামাজিক ভাবে অত্যন্ত সচেতন। ইতিহাস বলে অতীতেও এই অঞ্চলের মানুষ কোন অন্যায়, অবিচার, দূর্ণীতিবাজ প্রসাসন এবং কোন গডফাদার বা সিন্ডিকেটের কাছে নতি স্বীকার করে নি। বরং এসবের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ও আন্দোলনে এদেরকে চরমভাবে পরাস্ত করেছে।
বিয়ানীবাজারে বর্তমান সময়ের অন্যতম আতংক মোটরসাইকেল চুর ও সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেডদের বিরুদ্ধে সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাবিদদের সামনে থেকে জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রতিবাদি হওয়ার সময় এসেছে। বিশেষ করে পুলিশ ও ‘পুলিশের অনুগত‘ নেতাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যত দ্রুত সম্ভব হতে ততোই বিয়ানীবাজারবাসীর মঙ্গল।
ছরওয়ার আহমদ: লেখক, বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজের সাবেক ভিপি ও স্যোসাল এক্টিভিস্ট, যুক্তরাজ্য প্রবাসী।