কয়েকদিন আগে বাসার সামনের দোকান থেকে এক ডজন ডিম কিনলাম। দোকানে দুই ধরনের ডিম আছে। একটি একটু ছোট, দাম ডজনপ্রতি ৯৫ টাকা; আরেকটা একটু বড়, দাম ১০৫ টাকা। বড় ডিম দেওয়ার সময় দোকানি খুব আস্থার সঙ্গে বলে দিলেন, প্রতি ডিমে দুটি করে কুসুম পাবেন।
আমি বিশ্বাস না করেই ডিম নিয়ে বাসায় ফিরলাম। এ জীবনে ডিম তো আর কম খাওয়া হয়নি। কখনো এক ডিমে দুটি কুসুম পেয়েছি- এমনটা মনে করতে পারছি না। বা হলেও এটা একেবারেই হাতেগোনা ব্যাপার। কিন্তু সেদিন দোকান থেকে আনা প্রতিটি বড় ডিমেই যথারীতি দুটি করেই কুসুম পেতে থাকলাম। ‘বিবাহিত-ব্যাচেলর’ লাইফে ডিমের এই বিচিত্র ভালাবাসা আমাকে বাড়তি আনন্দ দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
একদিন পরিবারের লোকজনকেও ব্যাপারটা বললাম। তাঁরা প্রথমেই এটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা শুরু করে দিলেন। একজন তো বলেই ফেললেন, আমি বোকা বলে দোকানদার আমাকে এইভাবে ঠকিয়ে দিয়েছে। আরেকজন বললেন, ‘এ নির্ঘাত প্লাস্টিকের ডিম। ডিম ভাঙলেই দুটি কুসুম একসঙ্গে মিশে যাবে। আলাদা করে পাবেন না।’ তিনি আরো বললেন, প্লাস্টিকের চালও নাকি আছে।
আরেকজন বললেন, এটা চীনাদের কাজ। প্লাস্টিক চালে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে বলে তিনি শুনেছেন। কোনটা যে আসল আর কোনটা যে নকল চাল- তা নাকি রান্নার পর ভাতের ফেন দেখে বোঝা যায়। ভিডিও শেয়ারের প্লাটফর্ম ইউটিউবে নাকি প্লাস্টিকের চাল, প্লাস্টিকের ডিম বানানোর প্রভূত ভিডিও আছে।
২০১৭ সালে বিষয়টি নিয়ে বিবিসির করা একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বললাম যে, প্লাস্টিক ডিম বা চাল বলতে আসলে কিছু নেই। এটা একটা মিথ্যা তথ্য। এই অদ্ভূত প্রোপাগান্ডা চীন দিয়ে শুরু। পরে নাইজেরিয়া, সেনেগাল, ঘানা, গাম্বিয়া প্রভৃতি দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এই গুজবের মাত্রা এতোটাই ছিল যে, অনেক দেশের সরকারকে পর্যন্ত এ নিয়ে কথা বলতে হয়। আর প্লাস্টিক দিয়ে চাল বা ডিম তৈরি করা অনেক বেশি খরচ সাপেক্ষ। এই গুজবের মূলে হচ্ছে, মানুষ যাতে আমদানি করা চাল না কিনে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চাল কেনে।
তবে এতে তাঁরা সন্তোষ্ট হলেন বলে মনে হলো না। শেষ পর্যন্ত আমার দুই কুসুমের সাধের যে কয়টা ডিম ঘরে ছিল, সেগুলোর মধ্যে দুটো ভেঙে প্রমাণ দিতে হলো। সবার সামনে ডিম ভাঙা হলো, যথারীতি দুটো কুসুম আর সেগুলো আলাদা। প্রকৃত কুসুমের মতোই।
এর মধ্যে আবার গাইবান্ধায় প্লাস্টিকের চাল পাওয়ার ঘটনা ঘটল। সেই চাল নাকি আগুনে দিলেই প্লাস্টিকের মতোই হয়ে যায়! এটা শুধু পরিবার বা লোকজনের কৌতুহলের সীমাবদ্ধ নয়। একেবারে পুলিশ, প্রশাসন পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। যৌথ অভিযান হয়েছে, একেবারে ধরধর-মারমার অবস্থা।
কিন্তু আসলেই প্লাস্টিকের চাল বা ডিম কী আছে? কিংবা নেই। বিষয়টি নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণাদি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কথা বলা উচিত। এটা পুলিশ বা উপজেলা প্রশাসনের ব্যাপার নয়। গোটা খাদ্য মন্ত্রণালয়, যারা খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করেন, যারা এদেশে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন- সবার এ ব্যাপারে দায় আছে। এটা গুজব বা প্লাস্টিকের চাল/ডিম- যাই হোক, দুটোই জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
চন্দন সাহা রায় ; সাংবাদিক,কলামিস্ট