জলপ্রপাত বলতে দেশে একটা সময় কেবল মাধবকুন্ড ঝর্ণার নামডাক ছিল। তবে বর্তমানে অনান্য কয়েকটি স্থানে বিশেষত পাবর্ত্য অঞ্চলে আরো বেশ কিছু ঝর্ণার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এখনো মাধবকুন্ড দেশের অন্যতম বৃহৎ জলপ্রপাত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটে বেড়াতে এসে মাধবকুন্ডে ভ্রমণ করেননি এরকম লোকের সংখ্যা হাতেগোনা। পাথারিয়া পাহাড়ের বুক জুড়ে বয়ে চলা মাধবকুন্ড সহ এখানকার সুউচ্চ পাহাড়, পাহাড়ী অরণ্য, ঝিরি-ছড়া, কমলা-লেবু ও চা বাগানের শান্ত-স্নিগ্ধ ছায়াময় সুনিবিড় প্রকৃতি হাতছানি দেয় বারে বারে। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ মাধবকুন্ডে এসে মনে হবে কবির এই অনন্য চরন আসলেই সার্থক।
পাথারিয়া পাহাড়ের প্রায় ২৭২ ফুট ওপর হতে অবিরাম বর্ষণে জলরাশি নিচে পতিত হওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে মাধবকুন্ড। এই কুন্ডের প্রবাহমান স্রোতধারা উচ্ছল বালিকার মত মাধবছড়া হয়ে ছুটে যাচ্ছে দূর হতে বহুদূরে । পৌরাণিক যুগে এই মাধবছড়া ও কুন্ডের নাম ছিল গঙ্গামায়া । সময়ের বিবর্তনে তা পরিবর্তিত হয়ে ওপরের ছড়ার নাম মাধবছড়া এবং নিচের দিকটা মাধবকুন্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে । মাধবকুন্ডের নামকরণ নিয়ে নানান কথা প্রচলিত আছে। তবে সবচে’ নির্ভরযোগ্য তথ্যটি হল, শ্রীহট্রের রাজা গঙ্গাধ্বজ বা গোধ্বর্ন পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নিমার্ণ করতে গেলে সেখানে মাটির নিচে ধ্যানমগ্ন একজন সন্যাসি দেখতে পান। ঐ সন্যাসী ঝর্ণায় বিসর্জিত হওয়া মাত্র তিনবার মাধব-মাধব-মাধব দৈববানী উচ্চারিত হয়। ধারণা করা হয় এই দৈববানী থেকেই মাধবকুন্ড নামের উৎপত্তি হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়-অরণ্য, হাওর, চা বাগান অধ্যুষিত উপজেলা বড়লেখা। এর পূর্ব সীমান্তে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে পাথারিয়া পাহাড় দেয়ালের মত বড়লেখাকে প্রতিবেশী আসাম হতে আড়াল করেছে। পাথারিয়া পাহাড়ই মাধবকুন্ডের উৎসস্থল। পাহাড়ের গা জুড়ে গাছগাছালি, লতাগুল্ম ঢাকা সবুজের আচ্ছাদন। প্রকৃতির নিগূঢ় খেয়ালে এরই ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ী ঝর্ণা। মাধবছড়ার নিস্ক্রান্তি বা শেষ পতন অংশটিই মাধবকুন্ড জলপ্রপাত। মাধবকুন্ডের প্রকৃত রুপ উদ্ভাসিত বর্ষা মৌসুমে। এই সময়ে ঝর্ণার বিস্তৃতি থাকে সবচেয়ে বেশি। ঝর্ণার পতনস্থল থেকে ছুটে আসা শোঁ শোঁ শব্দ আর বিন্দু বিন্দু জলের কুঁয়াশা মিলে সৃষ্টি হয় এক স্বপ্নীল পরিবেশের। বিন্দু বিন্দু কুঁয়াশার বৃষ্টি যখন আপনাকে ভিজিয়ে দেবে তখন চোখ বুঁজে তন্ময় হয়ে চলে যাবেন অন্য কোন জগতে। মাধবকুন্ড ও তৎসংলগ্ন এলাকায় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩৯০০ মি.মি. হয়ে থাকে। এ সময় কখনো কখনো ঝর্ণার স্ফীতি এত বড় আকার ধারণ করে যে, আপনার মনে হবে নায়াগ্রার পাশে দাড়িয়ে আছেন কিনা! ঝর্ণার পূর্ণ যৌবন পর্যটকদের জন্য অনাবিল আনন্দ, তৃপ্তি আর অ্যাডভেঞ্চার বয়ে আনে।
মাধবকুন্ডের একটি অন্যতম আর্কষণ হচ্ছে এর পাথরের গুহা। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই পাথরের গুহাটি কুন্ডের ডানপাশে অবস্থিত। স্থানীয় অধিবাসীরা এ গুহাকে ‘কাব’ বলে থাকে। আলো-আঁধার মাখা গুহার ভেতরে সাহস করে ঢুকে গেলে মনে হবে পাথারিয়ার হাজার হাজার টন পাথর বুঝি এই চাপা দিল! ফ্লাইওভারের মত গুহাটি ওপরের মত ওঠে গেছে। অনেকের কাছেই অজানা আরেকটি ঝর্ণা আছে মাধখকুন্ডের ওপরে পাথারিয়ার জঙ্গলে। এর নাম পরীকুন্ড ঝর্ণা। নামের সাথে পরী থাকলেও পরীরা ওই ঝর্ণায় নামতো কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি! তবে দূর্গম অবস্থান ও গহীন জঙ্গলের কারণে সাধারণের পক্ষে একে খুঁজে বের করা দুরুহও বটে। তবে অতি উৎসাহী অ্যাডবেঞ্চার প্রিয়রা স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিতে পারেন। তবে শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল ট্রেইল বলে সাবধান। মাধবকুন্ডের এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কিছু এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে মুরাইছড়া ইকোপার্ক। মাধবকুন্ডে যাবার পথে পাহাড়-টিলাময় সবুজ অরণ্যের মাঝে চোখ জুড়াবে খাসিয়া আদিবাসীদের পুঞ্জি। জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে আগত খাসিয়ারা সিলেটের অনান্য পাহাড়ী এলাকাার মত এখানে ও বসত গড়ে তোলেছে। পুঞ্জিতে গিয়ে পরিচিত হতে পারেন তাদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্টানের সাথে। তবে এক্ষেত্রে নম্রতা ও ভদ্রতা প্রদর্শন অবশ্য কাম্য। মাধবকুন্ডে যাবার পথে রাস্তার পার্শ্ববর্তী টিলাগুলোতে রয়েছে তরে তরে সাজানো চোখ জুড়ানো চা বাগান। জলপ্রপাতের পাশাপাশি চা বাগানও বেড়ানোর অন্যতম উপকরণ। মাধবকুন্ড সংলগ্ন এলাকায় কমলা বাগানও রয়েছে। সংখ্যায় কম হলেও এই কমলা বাগানগুলো যে কোন ভ্রমণার্থীর চোখ জুড়াতে সক্ষম।
পর্যটনের পাশাপাশি মাধবকুন্ড ধর্মীয় ক্ষেত্রেও সমগুরুত্বপূর্ণ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মাধবকুন্ড অত্যন্ত পবিত্র স্থান। এখানে প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন দুইটি শিবমন্দির রয়েছে। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশী পূর্ণিমা ও চৈত্র মাসের ৭-৮ তারিখ বারণীকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে উৎসব পালন করেন। শিবপুজা, মধুকৃষ্ণ, ত্রয়োদশী স্নান ও মেলা এই উৎসবের মূল্য উপজীব্য।
মাধবকুন্ডের উত্তর দিকে পাথারিয়া পাহাড়ে রয়েছে একটি তেলকূপ। বার্মা অয়েল কোম্পানী (বিওসি) এই পাহাড়ে গড়ে তোলেছিল একটি তেল উৎপাদনকেন্দ্র। কিন্তু উৎপাদন করতে গিয়ে অদক্ষতার কারণে তারা এর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। পরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে আছে।
মাধবকুন্ডে বেড়াতে যেতে চাইলে প্রথমে ঢাকা থেকে সিলেট বা মৌলভীবাজার বাসে বা ট্রেনে যেতে হবে। মৌলভীবাজার থেকে রাজনগর-কুলাউড়া-জুড়ি-কাঠালতলী হয়ে দূরত্ব এর ৭০ কিলোমিটার। অন্যদিকে সিলেট থেকে গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার-বড়লেখা হয়ে এর দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার।
এক সময়ের দূর্গম, অরণ্য ঢাকা হিংস্র জন্তুর হুংকারে প্রকম্পিত মাধবকুন্ড এখন রুপ নিয়েছে নতুন এক মাধবকুন্ডে। এখানে রয়েছে ইকোপার্ক, ওয়াচ টাওয়ার, ডাকবাংলো, হোটেল-রেস্টহাউজ সহ পর্যটনের নানান সুবিধা। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ঝর্ণার গান শুনতে চাইলে যেতে পারেন মাধবকুন্ডে। ঝর্ণার স্রোতের উচ্ছাসময় আহবানে হাতছানি দিয়ে ডাকছে মাধবকুন্ড।
ছবি শেখ রাফি
লেখক : ভ্রমণ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক এবং ব্যাংক কর্মকর্তা।
shimulkhaledbd@gmail.com