সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ৭ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
https://blu-ray.world/ download movies
সর্বশেষ সংবাদ
প্রধান উপদেষ্টাকে সংগ্রামের গল্প শোনালেন ১৫ উদ্যোক্তা  » «   ‘ভুইফোঁড়’ সংগঠনের দাবিতে গ্রাফিতি সরানো হল কেন? সমাবেশে প্রশ্ন  » «   সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে আওয়ামীপন্থিদের জয়  » «   ইমরান খান ও স্ত্রী বুশরা বিবির ১৪ বছরের কারাদণ্ড  » «   প্রতিদিন ফ্যাসিবাদ পুনরুৎপাদিত হচ্ছে: সলিমুল্লাহ খান  » «   বন্ধু নেতানিয়াহুকে বিদায়লগ্নে উপায় খুঁজতে বললেন বাইডেন  » «   শিশুর বাম চোখের পরিবর্তে ডান চোখে অস্ত্রোপচার, চিকিৎসক গ্রেফতার  » «   ‘মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত’ বাবর ১৭ বছর পর কারামুক্ত  » «   সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে মামলা  » «   ছাগলকাণ্ডে আলোচিত মতিউর স্ত্রীসহ গ্রেফতার  » «   জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট: আপিলে খালেদা-তারেকসহ সবাই খালাস  » «   বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমানননা ও লাঞ্ছনার তীব্র প্রতিবাদ  » «   অফস্টেডে ‘আউটস্ট্যান্ডিং’ টাওয়ার হ্যামলেটস : সরকারের রিপোর্ট বলছে, “শিশুরা পায় চমৎকার সহায়তা”   » «   সাত বছরের শিশুর ধর্ষণের বিচারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে এক মা  » «   বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষ কর্মী নিতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি আহ্বান  » «  
সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন

ঐতিহাসিক ৭ জুন—বিয়ানীবাজারে মনু মিয়ার স্মৃতিস্থম্ভ



সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

৬৬ তে ছয় দফার দাবীতে শুরু হয় উত্থাল গন আন্দোলন। শুরু হয়ে যায় অসহযোগ । এ এক ভিন্ন চিত্র, পাকিস্থানী শাষকগুষ্ঠি দিশেহারা হয়ে যায়। অসহযোগ আন্দোলনে মানুষের শতস্ফুর্ত রাস্তায় নেমে যাওয়ায় যেন পাল্টে যেতে থাকে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্থান। সেময়েরই একটা দিন বাঙালি জাতির জন্যে এক ঐতিহাসিক দিন। ৬৬’র ৭ জুন । ছয় দফার দাবীতে ছিলো হরতাল । কারখানায় হয় শ্রমিক ধর্মঘঠ । দিশে-হারা পাকিস্থানী শাসকগুষ্ঠি পথ না পেয়ে নৃশংসতার পথ বেছে নেয়। আন্দোলনের মানুষগুলো দমাতে সারা বাংলায় চালায় নির্যাতনের ষ্টীম-রোলার। অন্তত ১১ জন মানুষের রক্তে সেদিন বাংলাদেশ রঞ্জিত হয়। বলতে গেলে সেই থেকে শুরু। আর পেছনে ফেরেনি বাঙালি জাতি। একটা স্বাধীন আর সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সেই যাত্রা থেকে আর পিছপা হয়নি বাঙালি। একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ আত্নাহুতি দিয়েছে, সে যেন সেই ৭ জুনের প্রেরণা।

মৃত্যু মানেই হদয় ছোঁয়ে যাওয়া। আন্দোলন-সংগ্রামে জীবন ঢেলে দেওয়া মানে আগামীর ডাক দিয়ে যাওয়া। একটা প্রজন্মকে পথ দেখিয়ে দেয়া। বেঁচে থাকার প্রত্যয় সৃষ্টি করা। কোন কোন আত্নাহুতি তো আমাদের পথ দেখায়-এগিয়ে যাবার।

বাঙালি জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার সেই দিক নির্দেশনা দিতে যারা সেদিন রাজপথে ঢেলে দিয়েছিলো নিজেদের লাল টগবগে রক্ত, তাদের একজন হলেন শহীদ মনু মিয়া। ঢাকার তেজগাঁওয়ের এক কারখানায় সে সময় তিনি ছিলেন একজন শ্রমিক। শ্রমিক আর মেহনতি মানুষ যেমন অকৃত্রিম ভালোবেসে যায় তার দেশ কিংবা মাতৃভুমিকে, সেভাবেই নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে মনু মিয়া দেখেছিলেন তার চারপাশ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তিনিও সেদিন দেশ আর জাতির জন্যে রাস্তায় নেমেছিলেন, আত্নাহুতি দিয়েছিলেন দেশ আর জাতির জন্যে।

 

মনু মিয়া ছিলেন নিরেট একজন খেটে খাওয়া মানুষ। নয় ভাইবোনের একজন ছিলেন তিনি। ২৩ বছর বয়সে যিনি হাল ধরতে চেয়েছিলেন একটা পরিবারের। কিন্তু ভাগ্য তার এমনই নির্মম যে, পরিবারের হাল ধরতে পারেন নি তিনি। যদিও প্রকারান্তরে একটা দেশের স্বপ্ন জিইয়ে রেখে গিয়েছিলেন কোটি-কোটি মানুষের হৃদয়ে। আর সে হিসেবে তিনি এক ভাগ্যবান -শহীদ মনু মিয়া।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাকে নিয়ে বিশাল কিছু না হলেও তার নামটি ঘিরে একটা স্কুল হয়েছে। শহীদ মনু মিয়া দিয়ে যখন গুগুলে খোঁজতে গেছি, শুধু এসেছে একটা স্কুলের নাম। শহীদ মনু মিয়া স্কুল। তেজগাঁওয়ের একটি স্কুল। অন্তত আর কিছু না হোক মনু মিয়ার লালিত স্বপ্ন একটা বাংলাদেশ হয়েছে। সেই বাংলাদেশে তাকে নিয়ে বক্তৃতার ঝংকার উঠে না কোথাও ঠিকই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় বাংলাদেশে তাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া স্কুলে এখনও কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা নেয়। একটা ঝলঝলে নামের এই স্কুল ঘিরে শত-সহস্র-লাখো প্রাণ আগামীর দিনগুলোতেও এখানে শিক্ষা নেবে, একজন মনু মিয়া জীবন্ত থাকবেন এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে অনন্তকাল।

আমরা যারা মনু মিয়ার নাম জানি, মনু মিয়ার কিশোর-যৌবন কেটেছে যে আঙ্গিনায় কিংবা যে আটপৌর শহরে, সেই শহর এখন সমৃদ্ধ এক জনপদ। অর্থ আর বৈভবে সমৃদ্ধ এই জনপদে গেলে এখন আমরা থমকে যাই- এই কি আমাদের মিছিলের সেই ছোট্ট রাজপথ। আমরা বিস্মযে তাকিয়ে থাকি সুরম্য প্রাসাদের দিকে। সিলেটের একটা ছোট্ট শহর বিয়ানীবাজার। বিয়ানীবাজার পৌরসভারই উপকন্ঠে ছোট্ট একটা গ্রাম। নাম ‘নয়াগ্রাম’। সেই গ্রামে যান আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মাঝে মাঝেই । কারণ সেখানেই তার বর্তমান গ্রামের বাড়ি। এই গ্রামেরই সন্তান বাংলাদেশের এক স্বপ্নময় পুরুষ মনু মিয়া, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, এবং আত্নাহুতি দিয়েছিলেন দেশের জন্যেই। কিন্তু ক’জন মানুষ জানে আমাদের এই বীর সন্তান মনু মিয়ার নাম।

সেই গ্রামেরই লনু ভাইকে আমরা জানতাম। আমরা যখন সমাজতন্ত্র আর শোষনহীন সমাজের কথা বলে রাস্তা চৌচির করতাম,তখন লনু ভাইকে জানতাম অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ‘কুড়ে ঘরে’র লোক। তাকে আমরা সমীহ করতাম অন্য একটা কারণে, কারণ  তিনি হলেন মনু মিয়ার ভাই। এই মনু মিয়াকে নিয়ে কোন বড় কিছুই হয় না আমার এলাকায়। যেমন হয় না এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন দার্শনিক অধ্যাপক জিসি দেবকে নিয়েও। দুজনই স্বাধীনতার জন্যে আত্নোৎসর্গকৃত। একজন রাজপথের কর্মী হিসেবে, অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বুদ্ধিজীবী হিসেবে। যদিও ড. জিসি দেব মাঝে মাঝে উচ্চারিত হন, কিন্তু মনু মিয়ার নাম নেই আমাদের এই এলাকায়।

মাঝে মাঝে কেউ কেউ , হয়ত কোন সংগঠন তাকে নিয়ে নাড়া চাড়া করে। তারপর সব কিছুই নিরব হয়ে যায়। ২০০৯ সালে স্বদেশ সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিষদ নামের একটা সংগঠন তাকে নিয়ে একবার আলোচনা করেছিলো। জানিনা এখন হয় কি না। বিয়ানীবাজারে এখন সংগঠনের আকাল নেই। একটা বিশাল অংশ বিদেশ মুখী হলেও তরুনদের একটা অংশ শিক্ষা- সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছে। রাজনীতির মাঠে এখানে জন্ম নিয়েছে এক পরগাছা শ্রেণী। তরুনদের অদ্ভুত ট্রেন্ট-  মন্ত্রীর সাথে সেলফী তোলে ফেইসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় একটা পত্রিকার সম্পাদক সেদিন বললেন, সংস্কৃতির চর্চা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনায়ও গোয়ার পোষাকী রাজনীতিকদের অথিতি করতে হয়। আমার এক বন্ধু বললো, সেজন্যেই এরা জিসি দেবের আলোচনার মঞ্চে এসে তাকে বলেন ‘বিখ্যাত বিজ্ঞানী’।

এতকিছুর পরও সে সময়ের কিছু তরুন তাদের ভুলেনি। এখনও মনু মিয়া বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হন তাদের গল্পে কিংবা অতীতের স্মৃতিচারণে। এরকম একটা প্রজন্ম বাস করছেন আমেরিকায়। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তাদের শেষ কৈশোরে। কলেজের আরম্ভবেলায় যারা মনু মিয়ার নাম শোনেছিলেন, যারা তাদের বক্তৃতায় মনু মিয়াকে নিয়ে কথা বলতেন, তাদেরই কয়েকজন সেখানে মনু মিয়াকে নিয়ে করছেন বিশেষ আয়োজন। মনু মিয়ার সেই আত্নবিসর্জনের দিনটাকে সামনে রেখে তারা প্রকাশ করেছেন সমৃদ্ধ ম্যাগাজিন। যে ম্যাগাজিনে আছে তার পরিবারের এগিয়ে যাবার নিটোল বর্ণনা। আছে সেখানে মনু মিয়ার আমেরিকা প্রবাসী মেয়ের দীর্ঘশ্বাস। আছে আমাদের লনু ভাই’র হয়ত স্মৃতি।

সাথে সাথে যে কাজটি তারা করেছেন, তাহলো মনু মিয়াকে জাগ্রত রাখতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সারা বাংলাদেশের মানুষ যেন মনু মিয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে পারে, সে নিয়ে তারা মনু মিয়ার স্মৃতিস্থম্ভ করেছেন বিয়ানীবাজারে। শোষন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে একজন মনু মিয়া এই এলাকার এক অহংকারের নাম। এই অহংকারকে জাগরুখ রাখতে তরুনদের মাঝে সমাজবদলের সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে মনু মিয়ার এই স্মৃতিস্তম্ভ বিয়ানীবাজারতো বটেই, বাংলাদেশের জন্যে হবে একটা মাইলফলক। অভিনন্দন আমেরিকা প্রবাসী আমার সেই অগ্রজপ্রতিমদের- জীবন-জীবিকার যান্ত্রিকতার মাঝেও  যারা আদর্শের ঝান্ডা উড্ডীন রাখছেন, প্রাণিত করছেন আমাদের আগামী প্রজন্মকে।

(দৈনিক আমাদের সময়ে ২০১৬’র ৭ জুন তে প্রকাশিত এ নিবন্ধটি সামান্য সংযোজন-বিয়োজন করে  পুন:প্রকাশ) ।

৭ জুন, ২০১৮ সাল। লন্ডন।

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

"এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব " -সম্পাদক

,সাংবাদিক, কলামিস্ট
ফারুক যোশী; কলামিস্ট, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভিডটকম
লেখকের অন্যান্য পোষ্ট