আজ পহেলা মে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস তথা মে দিবস। এমন একটি পরিস্থিতিতে বছর ঘুরে আমাদের সামনে “মে” দিবস এসে হাজির হয়েছে যখন এক অদৃশ্য ভাইরাস সোয়া দুই লাখের অধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। প্রতি মুহুর্তেই লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। মৃত্যুও কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এ এমন এক মৃত্যু যে মৃত্যুতে সন্তান স্পর্শ করতে চায়না পিতার লাশ, জানাযায় আসতে চায়না স্বজনরাও। এই লেখাটি লিখতে লিখতে হয়তো কয়েকজন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে অনিচ্ছায়। সারা দুনিয়াজুড়ে সবার মধ্যেই এক অজানা আতংক বিরাজ করছে। বলতে গেলে প্রায় সারা পৃথিবী লকডাউন হয়ে আছে। ঐ অর্থে ঘুরছেনা গাড়ীর চাকা। অধিকাংশ কল-কারখানা বন্ধ আছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে দিনমজুর শ্রেণীর শ্রমজীবি মানুষ।
বাসের চাকা ঘুরলে যাদের জীবনের চাকা সচল থাকতো সেই বাস ড্রাইভারের পরিবারের দিন কাটছে অনেক কষ্টে। একমাসের অধিক সময় ধরে বন্ধ থাকায় কোন রকমে জীবন পার করছে ছাপাখানার শ্রমিক, কাপড়ের দোকানের সামান্য মাইনের কর্মচারী কিংবা রেস্টুরেন্টের ষ্টাফসহ অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ। শ্রম দিয়ে যাদের জীবন চলে যেত, যারা কোনদিন মানুষের কাছে হাত পাতেনি সেই শ্রমজীবি মানুষগুলো আজ বড়ই বিপদে। পরিশ্রম করে জীবন চালানোর মধ্যে এক ধরণের আত্মতৃপ্তি আছে, সম্মান আছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা শ্রমিক কোন ক্রীতদাস নয়, একইভাবে মালিকও কোন মনিব নয়। উপযুক্ত, পারলে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী শ্রম দিয়ে তবেই একজন শ্রমিক তার প্রাপ্য মজুরি নেয়। কিন্তু সেই প্রাপ্য মজুরি পেতে গিয়েও তাকে পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। অনেক ক্ষেত্রে সেই ভোগান্তি আবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে রুপ নেয় অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। কাজ শেষে পারিশ্রমিকের জন্য মালিক পক্ষের দ্বারস্থ হলে শুরু হয় টালবাহানা। তাদের ভাব দেখে মনেহয় যেন তারা দয়া-দাক্ষিন্য করছে।
অথচ ইসলাম ধর্মেও এই কথা বলা আছে যে, কাজ শেষে শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করা উচিত। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক যত আন্তরিক হবে তুলনামূলক মালিক পক্ষই এর সুফল বেশী ভোগ করবে। একজন শ্রমিক যদি মালিক পক্ষের উপর সন্তুুষ্ট হয়ে মনের আনন্দে কাজ করে তাহলে সে সবসময়ই চেষ্টা করবে তার সর্বোচ্চটা দিতে। প্রায়শই এমনও দেখা যায়, কোন শ্রমিক তুলনামূলক কম বেতনে অনেক মালিকের অধীনে কাজ করে আবার এমনও মালিক আছে যারা বেশী পারিশ্রমিক দিয়েও শ্রমিক পায়না। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শ্রমিক সে শুধু অধিক টাকার জন্যেই কাজ করেনা বরং কাজের পাশাপাশি মানবিক দিকগুলোও তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সে চায় একটি সুন্দর কাজের পরিবেশ, মালিকপক্ষের একটু ভাল আচরণ আর শ্রমের ন্যায্য মজুরি। এটা কোন অন্যায় আবদার নয়। এটা একজন শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার। কিন্তু বিপত্তি হলো সমাজের অনেক অর্থলিপ্সু মালিক আছে যারা আধুনিক সভ্যতার এই যুগে এসেও সেই সেকেলে ধ্যান ধারনা পোষন করে শ্রমিককে মানুষ মনে করেনা বরং শ্রমিক তাদের কাছে কেবলই পণ্য। শ্রমিক তাদের বড় হওয়ার কেবলই হিরন্ময় হাতিয়ার।
২. লন্ডনে যেমনটা দেখেছি শ্রমিকের বেতন সরকার কর্তৃক ঘন্টা প্রতি নির্ধারন করা আছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এবং আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলো মাথায় রেখে বেতন কাঠামো এমনভাবে করা হয়েছে যাতে মালিক-শ্রমিক উভয়েই খুশি। ঘন্টা প্রতি পারিশ্রমিক হওয়ার ফলে একজন শ্রমিক প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করার পরও সে খুশি, মালিক খুশি এমনকি সরকারও খুশি। কারণ বেশী সময় কাজ করার ফলে শ্রমিকের বেশী আয়ের সুযোগ হচ্ছে, বেশী সময় কাজ করার ফলে উৎপাদন বেশী হচ্ছে যাতে মালিক খুশি হচ্ছে আর মানুষের আয় বেশী হচ্ছে মানে সরকার বেশী পরিমাণ ট্যাক্স পাচ্ছে এমনকি উৎপাদিত পণ্য বেশী পরিমাণে বাজারজাত হওয়ার ফলে সরকার এখান থেকে শুল্কও পাচ্ছে। কাজেই একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে অধিক সময় কাজ করতে শ্রমিকের কোন আপত্তি নেই যদি সে বাড়তি শ্রমের জন্য বাড়তি মজুরি পায়। আমাদের দেশের স্বল্প বেতনের শ্রমবাজারকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার মানুষ আমাদের শ্রমিকের উৎপাদিত পণ্য কম মূল্যে ব্যবহার করছে যেটা তাদের দেশে উৎপাদন হলে খরচ হতো দ্বিগুন। এই সুযোগটাকে যেমন কাজে লাগাচ্ছে বিদেশীরা, তেমনি আমাদের মালিক ভাইয়েরা আর সরকার এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছে।
এদেশের সরকার কখনো শ্রমিক শ্রেণীর জন্য গড়ে উঠেনি বরং যেহেতু তারা নিজেরাই মালিক কিংবা প্রভু শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কাজেই কিভাবে মালিকের মুনাফা হবে সেই ব্যবস্থা খোদ রাষ্ট্র যন্ত্রই করে দেয়। শ্রমিক শ্রেণী সচ্চল হোক এমন নীতি এদেশে কখনই প্রচলন হয়নি। বরং শ্রমিক যদি তার অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে তবে তাদেরকে পুলিশের লাটিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস কখনো কখনো গুলিতে লাশ হয়ে ফিরতে হয়। এদেশে রাষ্ট্র তথা সরকার, কেবল বর্তমান সরকার নয় যেকোন সরকার কখনোই শ্রমিকের হয়ে কথা বলেনি অথচ এই খেটে খাওয়া শ্রমিকের ভোটেই তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন, এই খেটে খাওয়া শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে, রক্তে, ঘামে এগিয়ে চলেছে আমাদের অর্থনীতির চাকা- আমরা আজ মধ্যম আয়ের দেশের দাবীদার।
১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সেই আন্দোলন, পুলিশের গুলিতে বিশ্বের অগণিত শ্রমিকের প্রতিনিধিত্বকারী ১১ জন শ্রমিক সেদিন প্রাণ হারিয়ে ছিল। আর আন্দোলনের সময় ঘটনাস্থলে একটি বিস্ফোরণ ঘটলে সেখানে অনেকের প্রাণহানি ঘটে। সেই সাথে একজন পুলিশ ঘটনাস্থলে এবং পরবর্তীতে আরো সাতজন পুলিশ নিহত হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়। এই ঘটনার অভিযোগে পুলিশ শ্রমিক নেতাদের মধ্য থেকে এ্যলবার্ট পারসন, অগাস্ট স্পাইস, স্যামুয়েল ফিলডেন, অস্কার নিব, মাইকেল শোয়াব, জর্জ ইগেল, এডলফ ফিশার এবং ল্যুইস লিং নামক ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতার করে। প্রহসনের বিচারে এদের মধ্য থেকে চারজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আর একজন প্রহসনের এই বিচারের প্রতিবাদে ফাঁসি দেওয়ার আগের দিন আত্মহত্যা করে। দীর্ঘ ছয় বছর পর বাকি তিনজন ক্ষমা প্রার্থনা করে মুক্তি লাভ করে। এইসব শ্রমিকের রক্তের বিনিময়ে বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকদের জন্য একটি দিবস আমরা পেয়েছি যেটাকে শ্রমিক দিবস কিংবা মে দিবস হিসেবে বিশ্ববাসী পালন করে। কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সেই আন্দোলনের ১৩৪ বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রমিকের অধিকার এখনও চাকুরী বাঁচানোর জন্য লকডাউন ভেঙ্গে পায়ে হেটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গার্মেন্টেসে পৌঁছাতে হয় কিংবা যদি বলি রানা প্লাজার ধংসাবশেষের নীচে চাপা পড়ে, তাজরীন গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে, কোন বাসায় কাজ করতে গিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়, শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরির জন্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় বাদ দিয়ে রাস্তায় আন্দোলন করে- পুলিশের লাটিচার্জের শিকার হয় কোন কোন সময় গুলিতে লাশ হয়। শ্রমিক এখনও পায়নি তার নিরাপদ কর্মস্থল। এখনও দেশে গড়ে উঠেনি শ্রমিকের অধিকার আদায় করার জন্য কোন সত্যিকারের ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা কোন কার্যকর সংগঠন।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের বয়স খুব বেশী দিন নয়। কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বলছিনা–এই সময়ের মধ্যে অনেক গ্যারেজ মালিক হয়ে গেছেন গার্মেন্টস মালিক কিন্তু শ্রমিক সে শ্রমিকই রয়ে গেছে, বদলায়নি তার ভাগ্য রেখা যদিও এইসব শ্রমিকের বদৈলতে বদলেছে অনেকের কপাল। যারা একদিন রিক্সায় চড়ার মধ্যে সুখ খুজঁতো তারা এখন মার্সিডিজ বেঞ্চ চালিয়েও তৃপ্ত না, তাদের চাই বেনট্লি, জাগোয়ার ইত্যাদি। বদলেছে সমাজ বদলেছে রাষ্ট্র বদলেছি আমরাও কিন্তু বদলায়নি হতভাগা শ্রমিকের জীবন।
এরকম অসংখ্য পরিবার আছে যারা বিশ বছর আগে শ্রমিক ছিল, এখনও তারা সেই শ্রমিকই রয়ে গেছে। এমনও আছে কারো দাদা শ্রমিক ছিল, তার বাবা শ্রমিক ছিল এমনকি সেই হতভাগা নিজেও শ্রমিকই রয়ে গেছে। কেউ জানেনা তাদের পরবর্তী প্রজন্মও কি শ্রমিকই থেকে যাবে কিনা। অথচ তাদের শ্রমে-ঘামে অনেকেই এখন শূন্য থেকে সমাজের অধিপতি। বদলেছে সেইসব অধিপতিদের জীবন। এমনকি গত বিশ বছরে বদলেছে রাষ্ট্রের চিত্রও। শুধু, শুধুই বদলায়নি শ্রমিকের জীবনধারা। বদলায়নি শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সেই পুরনো আন্দোলন যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল আজ থেকে শত শত বছর আগে। বদলায়নি শ্রমিকের উপর শোষন, নিপীড়ন এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে নির্যাতনও। শ্রমিক দিবস, মে দিবসকে ঘিরে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে হয়তো অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক কথা হবে, টক শো হবে, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখা হবে কিন্তু শ্রমিক, সে সারাজীবনই ভূপেন হাজারিকার সেই কালজয়ী গানের পঙতিমালাই রয়ে যাবে- “মানুষ মানুষকে পণ্য করে, মানুষ মানুষকে জীবিকা করে”।