ঢাকা ০৫:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে সামলাবে কীভাবে ইসি?

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ১১:৩১:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
  • / 113

ভোট

অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নতুনভাবে পরিকল্পনা সাজাতে হচ্ছে। প্রায় ৩৪ বছর পর আরেকটি গণভোট, তার ওপর দেশের ইতিহাসে প্রথমবার একই দিনে দুটি ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। এ ছাড়া এবারই প্রথম পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটগ্রহণ হবে। দেশে প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের পাশাপাশি বিদেশে থাকা লাখ দশেক ভোটারকে যুক্ত করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে পুরো আয়োজন সামলাতে ইসির সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ দাঁড়াতে পারে—তা এখন সামনে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করেছেন মঈনুল হক চৌধুরী

ইসি ইতোমধ্যে জানিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যেই গণভোটের বিষয়টি যুক্ত হওয়ায় তাদের সার্বিক পরিকল্পনায় সমন্বয় আনতে হবে। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় ধরে তফসিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করার কথাও জানিয়েছে ইসি। দেশে ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে তিন দফা গণভোট হলেও কখনো জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হয়নি।

বিগত দুই গণভোটে দায়িত্বে থাকা ইসির দুজন কর্মকর্তা বলেন, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি ভোটকক্ষ বৃদ্ধি, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। ভোটার সংখ্যার অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ অন্যান্য সরঞ্জামও বাড়াতে হবে গণভোটের জন্য। প্রবাসী ভোটার ব্যবস্থাপনাও নতুন চ্যালেঞ্জ।

তাদের মতে, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা প্রতীক নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালালেও গণভোটের বিষয়ে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সচেতনতামূলক প্রচার প্রয়োজন। একই দিনে দুই ভোট হলে ব্যয় ২০ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে।

গণভোট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি ও বিধি তৈরির পরই সার্বিক চিত্র পরিষ্কার হবে বলে মন্তব্য করেন তারা।

এবার সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রায় ২৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। গণভোট আলাদাভাবে হলে বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছিল। এখন একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হলে ব্যয় কিছুটা সাশ্রয় হবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

একই দিনে সংসদ ও গণভোট আয়োজনে যেমন ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন আছে, তেমনি কোন ভোট আগে গোনা হবে—সেটির সিদ্ধান্তও প্রয়োজন। গণভোটের ফল গণনায় সময় বেশি লাগবে।

বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আমরা সকল বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে।”

দুই ভোট একসঙ্গে করার যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “তাতে নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।”

একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের চ্যালেঞ্জ এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইসির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া নিজেদের অভ্যন্তরীণ আলোচনার পর আসবে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ প্রচারের পর বিকেলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জানার পর কমিশন বৈঠকে আলোচনা করে মতামত দেবে।

দ্বিগুণ কর্মযজ্ঞের ভোট, ইসির চ্যালেঞ্জ

ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে ইসির।

পৌনে ১৩ কোটি ভোটার ও প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার বিবেচনায় ব্যালট পেপার মুদ্রণের পরিকল্পনা করেছে ইসি।

প্রায় ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে ২ লাখ ৪৫ হাজারের মতো ভোটকক্ষ থাকবে। ভোটে নিয়োজিত থাকবে ৯ থেকে ১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং ৭ থেকে ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।

রিটার্নিং অফিসারদের তত্ত্বাবধানে ৩০০ আসনে সার্বিক নির্বাচন পরিচালনা হয় ইসির নির্দেশনায়।

ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সংলাপের শেষ ধাপ চলছে।

সংসদ নির্বাচনের আগে এক পক্ষ গণভোট আগে চেয়েছে, অন্য পক্ষ নির্বাচনের দিনেই গণভোট চেয়েছে—এমন মতবিরোধ চলে আসছিল বহুদিন।

অবশেষে দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে দেরির মাঝে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা এলো—একই দিনে হবে দুই ভোট।

এমন পরিস্থিতির জন্য ইসির প্রস্তুতির ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা সভায়। সেদিন আমন্ত্রিতদের উদ্দেশে এক নির্বাচন কমিশনার বলেন, জুলাই সনদ অনুযায়ী গণভোট করতে হলে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে এবং সে অনুযায়ী মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা তোলেন তিনি।

যখন প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ প্রচার হচ্ছিল, তখন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ছিলেন।

সংলাপের শেষদিকে সাংবাদিকরা সিইসির কাছে জানতে চান—একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হলে তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কি না, চ্যালেঞ্জিং কি না।

জবাবে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো জানলে, তখন আমরা ‘এক্সেরসাইজ’ করে, আমরা সব বসে, কমিশনে আলাপ আলোচনা করে একটা মতামত দিতে পারব। এ বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো মতামত দেওয়া যথার্থ হবে না।”

সংলাপে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রসঙ্গ টেনে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আজকে একটা গণভোটের ইস্যু আসলো, সেটাও কিন্তু আমাদের মাথায় আনতে হয়েছে কয়েকদিন আগে থেকে। সব কিছু মিলে আমার প্রথম দরকার ছিল রাজনীতিবিদদের সাথে বসা।

“…এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখছি না। ইসি আশাবাদী, রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রার্থীরা সহযোগিতা করলে সুন্দর নির্বাচন সম্ভব।”

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “অনেকে সংলাপে তফসিল কবে, ঘোষণা কবে, তারিখটা যেন আমরা বলি। আমরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যটা শুনিনি। আমরা শুনে পরে (প্রতিক্রিয়া)… মনে হয় সময় এসেছে এটা ঘোষণা করার। সেটা ইনশাহআল্লাহ আমরা দেখব।”

পরে সন্ধ্যায় তারা নির্বাচন ভবনে নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসেন।

কাজ বাড়বে, গণনায় সময় লাগবে বেশি

ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানোর পাশাপাশি গণভোট পরিচালনায় সঠিক প্রশিক্ষণ জরুরি।

১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালের গণভোটে দায়িত্ব পালনকারী এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, “একদিনে সংসদ ও গণভোটের ক্ষেত্রে ভোটকক্ষ বাড়িয়ে দিলে সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়। আমার ধারণা, কেন্দ্র না বাড়ালেও চলবে।

“ব্যালট পেপার গণনার জন্য দুই সেট লোকবল লাগবে—এক সেট সংসদ নির্বাচনের ব্যালট, আরেক সেট ‘হ্যাঁ’–‘না’ ভোট গণনা করবে।”

গণভোটের প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যালট পেপার ইস্যু করা থেকে শুরু করে গণনা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পরিষ্কার নির্দেশনা প্রয়োজন।

জেসমিন টুলী বলেন, “প্রিজাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের সময় আরও দুটি সেশন বাড়িয়ে গণভোটের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। সার্বিক ব্যয় ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে। প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটেও দুটি ব্যালট ইস্যু করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ নয়, বরং স্বাভাবিকভাবে করতে হবে।”

ফেব্রুয়ারিতে দিন ছোট হওয়ায় ভোটের সময় বাড়ানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, “সন্ধ্যার পর ভোট নেওয়ায় ঝুঁকি রয়েছে, অনেক এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা আছে। ভোটকক্ষ বাড়ালে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যেই ভোট শেষ করা যাবে। বয়োবৃদ্ধদের সময় লাগে; ব্যালট বাক্স যেহেতু আলাদা হবে।”

তিনি মনে করেন, প্রিজাইডিং অফিসার ও কর্মকর্তা বাড়ানো গেলে কোনো সমস্যা হবে না।

গণভোটের বিষয়বস্তু নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

১৯৭৭ সালের প্রথম গণভোটে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আট ঘণ্টা ভোট হয়েছিল। এখন সময় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা।

সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটের সময় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। চাইলে আইন সংশোধন লাগতে পারে।

প্রথম গণভোটের ফল ঘোষণা করতে ৩০ ঘণ্টা লেগেছিল।

ইসির সাবেক কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, সংসদ ও গণভোট একইদিনে হলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। গণভোটে সাধারণত ভোটাররা তেমন কেন্দ্রে যান না; প্রার্থীরাও সক্রিয় থাকেন না। দুই ভোট একদিনে হলে ভালো সংখ্যক ভোটার কেন্দ্রে যাবে।

ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হলে কেন্দ্র বন্ধ বা পুরো আসনের ভোট স্থগিত করার বিধান সংসদ নির্বাচনে আছে।

গণভোটের ক্ষেত্রে আইন কীভাবে প্রয়োগ হবে—তা অধ্যাদেশ ও বিধিতে নির্ধারিত হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একসঙ্গে তিন ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় সংসদ ও গণভোট একদিনে হলে বড় ঝামেলার কিছু নেই।

তবে তিনি মনে করেন, গণভোটের ফল গণনায় সময় বেশি লাগবে। এজন্য দক্ষ জনবল, প্রশিক্ষণ ও ‘মডেল টেস্ট’ জরুরি।

মিহির সারওয়ার বলেন, “সংসদ নির্বাচনের ব্যালট আগে গণনা হবে, নাকি গণভোটের—কমিশনকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রথমবার দুটো ভোট একসঙ্গে হচ্ছে; তাই কোন কাজ কীভাবে সহজে করা যাবে—সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।”

নিউজটি শেয়ার করুন

সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে সামলাবে কীভাবে ইসি?

আপডেট সময় : ১১:৩১:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নতুনভাবে পরিকল্পনা সাজাতে হচ্ছে। প্রায় ৩৪ বছর পর আরেকটি গণভোট, তার ওপর দেশের ইতিহাসে প্রথমবার একই দিনে দুটি ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। এ ছাড়া এবারই প্রথম পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটগ্রহণ হবে। দেশে প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের পাশাপাশি বিদেশে থাকা লাখ দশেক ভোটারকে যুক্ত করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে পুরো আয়োজন সামলাতে ইসির সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ দাঁড়াতে পারে—তা এখন সামনে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করেছেন মঈনুল হক চৌধুরী

ইসি ইতোমধ্যে জানিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যেই গণভোটের বিষয়টি যুক্ত হওয়ায় তাদের সার্বিক পরিকল্পনায় সমন্বয় আনতে হবে। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় ধরে তফসিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করার কথাও জানিয়েছে ইসি। দেশে ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে তিন দফা গণভোট হলেও কখনো জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হয়নি।

বিগত দুই গণভোটে দায়িত্বে থাকা ইসির দুজন কর্মকর্তা বলেন, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি ভোটকক্ষ বৃদ্ধি, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। ভোটার সংখ্যার অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ অন্যান্য সরঞ্জামও বাড়াতে হবে গণভোটের জন্য। প্রবাসী ভোটার ব্যবস্থাপনাও নতুন চ্যালেঞ্জ।

তাদের মতে, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা প্রতীক নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালালেও গণভোটের বিষয়ে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সচেতনতামূলক প্রচার প্রয়োজন। একই দিনে দুই ভোট হলে ব্যয় ২০ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে।

গণভোট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি ও বিধি তৈরির পরই সার্বিক চিত্র পরিষ্কার হবে বলে মন্তব্য করেন তারা।

এবার সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রায় ২৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। গণভোট আলাদাভাবে হলে বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছিল। এখন একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হলে ব্যয় কিছুটা সাশ্রয় হবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

একই দিনে সংসদ ও গণভোট আয়োজনে যেমন ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন আছে, তেমনি কোন ভোট আগে গোনা হবে—সেটির সিদ্ধান্তও প্রয়োজন। গণভোটের ফল গণনায় সময় বেশি লাগবে।

বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আমরা সকল বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে।”

দুই ভোট একসঙ্গে করার যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “তাতে নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।”

একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের চ্যালেঞ্জ এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইসির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া নিজেদের অভ্যন্তরীণ আলোচনার পর আসবে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ প্রচারের পর বিকেলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জানার পর কমিশন বৈঠকে আলোচনা করে মতামত দেবে।

দ্বিগুণ কর্মযজ্ঞের ভোট, ইসির চ্যালেঞ্জ

ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে ইসির।

পৌনে ১৩ কোটি ভোটার ও প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার বিবেচনায় ব্যালট পেপার মুদ্রণের পরিকল্পনা করেছে ইসি।

প্রায় ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে ২ লাখ ৪৫ হাজারের মতো ভোটকক্ষ থাকবে। ভোটে নিয়োজিত থাকবে ৯ থেকে ১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং ৭ থেকে ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।

রিটার্নিং অফিসারদের তত্ত্বাবধানে ৩০০ আসনে সার্বিক নির্বাচন পরিচালনা হয় ইসির নির্দেশনায়।

ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সংলাপের শেষ ধাপ চলছে।

সংসদ নির্বাচনের আগে এক পক্ষ গণভোট আগে চেয়েছে, অন্য পক্ষ নির্বাচনের দিনেই গণভোট চেয়েছে—এমন মতবিরোধ চলে আসছিল বহুদিন।

অবশেষে দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে দেরির মাঝে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা এলো—একই দিনে হবে দুই ভোট।

এমন পরিস্থিতির জন্য ইসির প্রস্তুতির ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা সভায়। সেদিন আমন্ত্রিতদের উদ্দেশে এক নির্বাচন কমিশনার বলেন, জুলাই সনদ অনুযায়ী গণভোট করতে হলে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে এবং সে অনুযায়ী মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা তোলেন তিনি।

যখন প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ প্রচার হচ্ছিল, তখন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ছিলেন।

সংলাপের শেষদিকে সাংবাদিকরা সিইসির কাছে জানতে চান—একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হলে তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কি না, চ্যালেঞ্জিং কি না।

জবাবে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো জানলে, তখন আমরা ‘এক্সেরসাইজ’ করে, আমরা সব বসে, কমিশনে আলাপ আলোচনা করে একটা মতামত দিতে পারব। এ বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো মতামত দেওয়া যথার্থ হবে না।”

সংলাপে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রসঙ্গ টেনে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আজকে একটা গণভোটের ইস্যু আসলো, সেটাও কিন্তু আমাদের মাথায় আনতে হয়েছে কয়েকদিন আগে থেকে। সব কিছু মিলে আমার প্রথম দরকার ছিল রাজনীতিবিদদের সাথে বসা।

“…এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখছি না। ইসি আশাবাদী, রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রার্থীরা সহযোগিতা করলে সুন্দর নির্বাচন সম্ভব।”

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “অনেকে সংলাপে তফসিল কবে, ঘোষণা কবে, তারিখটা যেন আমরা বলি। আমরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যটা শুনিনি। আমরা শুনে পরে (প্রতিক্রিয়া)… মনে হয় সময় এসেছে এটা ঘোষণা করার। সেটা ইনশাহআল্লাহ আমরা দেখব।”

পরে সন্ধ্যায় তারা নির্বাচন ভবনে নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসেন।

কাজ বাড়বে, গণনায় সময় লাগবে বেশি

ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানোর পাশাপাশি গণভোট পরিচালনায় সঠিক প্রশিক্ষণ জরুরি।

১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালের গণভোটে দায়িত্ব পালনকারী এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, “একদিনে সংসদ ও গণভোটের ক্ষেত্রে ভোটকক্ষ বাড়িয়ে দিলে সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়। আমার ধারণা, কেন্দ্র না বাড়ালেও চলবে।

“ব্যালট পেপার গণনার জন্য দুই সেট লোকবল লাগবে—এক সেট সংসদ নির্বাচনের ব্যালট, আরেক সেট ‘হ্যাঁ’–‘না’ ভোট গণনা করবে।”

গণভোটের প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যালট পেপার ইস্যু করা থেকে শুরু করে গণনা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পরিষ্কার নির্দেশনা প্রয়োজন।

জেসমিন টুলী বলেন, “প্রিজাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের সময় আরও দুটি সেশন বাড়িয়ে গণভোটের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। সার্বিক ব্যয় ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে। প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটেও দুটি ব্যালট ইস্যু করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ নয়, বরং স্বাভাবিকভাবে করতে হবে।”

ফেব্রুয়ারিতে দিন ছোট হওয়ায় ভোটের সময় বাড়ানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, “সন্ধ্যার পর ভোট নেওয়ায় ঝুঁকি রয়েছে, অনেক এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা আছে। ভোটকক্ষ বাড়ালে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যেই ভোট শেষ করা যাবে। বয়োবৃদ্ধদের সময় লাগে; ব্যালট বাক্স যেহেতু আলাদা হবে।”

তিনি মনে করেন, প্রিজাইডিং অফিসার ও কর্মকর্তা বাড়ানো গেলে কোনো সমস্যা হবে না।

গণভোটের বিষয়বস্তু নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

১৯৭৭ সালের প্রথম গণভোটে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আট ঘণ্টা ভোট হয়েছিল। এখন সময় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা।

সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটের সময় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। চাইলে আইন সংশোধন লাগতে পারে।

প্রথম গণভোটের ফল ঘোষণা করতে ৩০ ঘণ্টা লেগেছিল।

ইসির সাবেক কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, সংসদ ও গণভোট একইদিনে হলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। গণভোটে সাধারণত ভোটাররা তেমন কেন্দ্রে যান না; প্রার্থীরাও সক্রিয় থাকেন না। দুই ভোট একদিনে হলে ভালো সংখ্যক ভোটার কেন্দ্রে যাবে।

ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হলে কেন্দ্র বন্ধ বা পুরো আসনের ভোট স্থগিত করার বিধান সংসদ নির্বাচনে আছে।

গণভোটের ক্ষেত্রে আইন কীভাবে প্রয়োগ হবে—তা অধ্যাদেশ ও বিধিতে নির্ধারিত হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একসঙ্গে তিন ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় সংসদ ও গণভোট একদিনে হলে বড় ঝামেলার কিছু নেই।

তবে তিনি মনে করেন, গণভোটের ফল গণনায় সময় বেশি লাগবে। এজন্য দক্ষ জনবল, প্রশিক্ষণ ও ‘মডেল টেস্ট’ জরুরি।

মিহির সারওয়ার বলেন, “সংসদ নির্বাচনের ব্যালট আগে গণনা হবে, নাকি গণভোটের—কমিশনকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রথমবার দুটো ভোট একসঙ্গে হচ্ছে; তাই কোন কাজ কীভাবে সহজে করা যাবে—সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।”