পাখির ধাক্কা না যান্ত্রিক ত্রুটি—কেন ভেঙে পড়ল এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজ?
- আপডেট সময় : ১১:৩১:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫
- / 308

ভারতের গুজরাটের আহমেদাবাদ থেকে ২৪২ জন যাত্রী নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পরপরই জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি উড়োজাহাজ।
বৃহস্পতিবারের এই দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা ২৪২ আরোহীর মধ্যে ৫৩ জন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। এখন পর্যন্ত কেবল একজন যাত্রীর জীবিত থাকার খবর মিলেছে। উড়ানের কিছু সময়ের মধ্যেই কেন এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
সরকারি সূত্র থেকেও এখনো পর্যন্ত দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে কিছু জানানো হয়নি। তবে বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা ভিডিও ফুটেজ দেখে সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন।
বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ মূলত দুটি দিক ঘিরে। প্রথমত, একাধিক পাখির ধাক্কায় উড়োজাহাজ নির্ধারিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, এটি হতে পারে যান্ত্রিক ত্রুটির ফল।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে আহমেদাবাদের সর্দার বল্লভভাই পটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটটি উড্ডয়ন করে। তবে রানওয়ে ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
উড্ডয়নের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানটি দ্রুত নিচে নেমে আসে এবং জনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। রানওয়ে ছাড়ার পরপরই বিমানটি বিপদ সংকেত পাঠিয়েছিল, যার ফলে প্রশ্ন উঠেছে—ঠিক কী ঘটেছিল আকাশে?
বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ সম্পর্কে কী জানা গেছে?
দুর্ঘটনায় পড়া উড়োজাহাজটি ছিল বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলের। ভারতে এই মডেলের বিমানের এটি প্রথম বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যদিও অতীতে এই মডেলের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সমস্যা নিয়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ১৮ বছর আগে মডেলটির যাত্রা শুরু হয়। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া উড়োজাহাজটির বয়স প্রায় ১২ বছর।
বাজারে ছাড়ার সময় বোয়িং একে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ উড়োজাহাজ বলে দাবি করেছিল। এমনকি মাত্র ছয় সপ্তাহ আগেই সংস্থাটি জানায়, ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলটি একশ কোটি যাত্রীর পরিবহন সম্পন্ন করেছে।
তবুও, এ মডেলটি শতাধিকবার যান্ত্রিক ত্রুটির মুখে পড়েছে। প্রায় এক দশক আগে এই উড়োজাহাজে ব্যবহৃত ব্যাটারিতে ত্রুটি ধরা পড়ে।
তখন বোয়িং দ্রুত নতুন নকশা ও সুরক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিল। তবে আহমেদাবাদের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পর সেই ত্রুটি পুরোপুরি মেরামত হয়েছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
যান্ত্রিক ত্রুটিই কি দায়ী?
‘হিন্দুস্থান টাইমস’-এর এক প্রতিবেদনে সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, কিছুদিন আগেই উড়োজাহাজটির সংস্কারকাজ করা হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল। যদিও সরকার বা সংস্থার পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।
পাখির ধাক্কা, না ফ্ল্যাপের গোলযোগ?
দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনও নিশ্চিত নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, উড্ডয়নের সময় বিমানের ডানার ফ্ল্যাপ সঠিকভাবে কাজ না করায় এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
বিবিসির যাচাই করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের পরপরই নিচের দিকে নামতে থাকে এবং মাটিতে আছড়ে পড়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে।
বিমান চলাচল বিশ্লেষক জিওফ্রি থমাস বলেন, “আমি ভিডিওতে যেটা দেখছি, তখনও ল্যান্ডিং গিয়ার নিচেই ছিল, তবে ফ্ল্যাপগুলো গুটিয়ে নেওয়া হয়েছিল।” তিনি আরও বলেন, উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাপ গুটিয়ে ফেলার ঘটনা সাধারণ নয়।
অন্য এক বিশেষজ্ঞ টেরি টোজার বলেন, “ভিডিও দেখে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন, তবে দেখে মনে হচ্ছে ফ্ল্যাপ খোলা ছিল না। এর মানে স্পষ্ট, উড়োজাহাজটি ঠিকভাবে উড্ডয়ন সম্পন্ন করতে পারেনি।”
বাকিংহ্যামশায়ার নিউ ইউনিভার্সিটির সাবেক পাইলট ও অধ্যাপক মার্কো চ্যান বলেন, “যদি ফ্ল্যাপ সঠিকভাবে সেট না হয়ে থাকে, তবে তা মানবিক ভুলের দিকেই ইঙ্গিত করে। তবে ভিডিওর রেজুলেশন এতই খারাপ যে এটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”
বিশেষজ্ঞরা বহু আগেই সতর্ক করেছিলেন, আকাশে পাখির ধাক্কা মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
ভারতে গুজরাটের আহমেদাবাদ বিমানবন্দর শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে পাখির সঙ্গে বিমানের ধাক্কা লাগার ঝুঁকি অস্বাভাবিক নয়।
২০১৮ সালের একটি গবেষণাতেও দেখা গেছে, আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে পাখির সঙ্গে বিমানের সংঘর্ষের আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে বেশি।
তাহলে কি পাখিদের দলই এই দুর্ঘটনার কারণ? সাবেক এক ভারতীয় পাইলট সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, একাধিক পাখির ধাক্কায় উড়োজাহাজের দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে পড়ে।”
“ফ্লাইটটি ঠিকভাবে উড্ডয়ন করেছিল। কিন্তু পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের পর সেটি দ্রুত নিচে নেমে আসে। তবে তদন্ত শেষ হলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে।”
একই মত আরেক বিমান বিশেষজ্ঞেরও। তিনি বলেন, “সম্ভবত ফ্লাইটটির পর্যাপ্ত উড্ডয়নের সামর্থ্য ছিল না। একাধিক পাখির ধাক্কা খাওয়ার পর এটি ৬-৭ মিনিটের বেশি আকাশে টিকতে পারেনি এবং ভেঙে পড়ে। যেহেতু এটি তুলনামূলক নতুন মডেল, তাই যান্ত্রিক ত্রুটির সম্ভাবনা কম।”
সব মিলিয়ে, এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনও অস্পষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিস্তারিত তদন্তেই প্রকৃত চিত্র সামনে আসবে।
নিহতের সংখ্যা ২৪০ জনের বেশি
ভারতের আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল ভবনে বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৪০ জনের বেশি।নিহতদের মধ্যে বিমানের আরোহী ও হোস্টেলের নিহত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এখনও নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
বিমানটিতে থাকা ২৪২ যাত্রীর মধ্যে অন্তত একজন বেঁচে আছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। আহমেদাবাদের পুলিশ কর্মকর্তা বিধি চৌধুরী রয়টার্সকে বলেছেন, নিহতের সংখ্যা ২৪০ জনের বেশি। এর আগে তিনি নিহতের সংখ্যা ২৯৪ জন বলে জানিয়েছিলেন। অনেকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুবার গণনা করায় সংখ্যা বেশি হয়েছিল জানিয়েছেন তিনি।
পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেছেন, আমরা একজন যাত্রীকে জীবিত পেয়েছি, যার সিট নম্বর ছিল ১১এ। সিটটি ছিল জরুরি বহির্গমন দরজার পাশে। হাসপাতালে আহতদের মধ্যে আরও জীবিত আরোহী থাকতে পারেন।
বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি ৪০ বছর বয়সী রমেশ বিশ্বাসকুমার হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেছেন, উড্ডয়নের ৩০ সেকেন্ড পরই প্রচণ্ড শব্দ হয়, তারপরই দুর্ঘটনা ঘটে। যখন জ্ঞান ফিরে আসে, দেখি চারপাশে শুধু মরদেহ। আমি দৌড়ে বের হই, কেউ একজন আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়।
তার ভাই অজয় একই বিমানে ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি তাঁকে খুঁজে পাচ্ছি না। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।
বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিমানটির পেছনের অংশ মেডিক্যাল কলেজ ভবনের ছাদে আটকে ছিল। স্থানীয় পুলিশপ্রধান জি.এস. মালিক বলেন, মৃতদের মধ্যে বিমানের আরোহী ও কলেজের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন।
নিহতদের শনাক্তে আত্মীয়-স্বজনদের ডিএনএ নমুনা দিতে বলা হয়েছে বলে জানান রাজ্য স্বাস্থ্যসচিব ধনঞ্জয় দ্বিবেদী।
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানিও নিহত হয়েছেন।
এয়ার ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিমানের আরোহীদের মধ্যে ২১৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক, ১১ শিশু এবং ২ নবজাতক। যাত্রীদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, ৭ জন পর্তুগিজ এবং একজন কানাডিয়ান নাগরিক ছিলেন।
বিমানটি ছিল বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলের। ২০১১ সালে এটি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়। ফ্লাইট রাডার২৪ জানিয়েছে, বিধ্বস্ত হওয়া এই বিমানটি ২০১৩ সালে প্রথম উড়েছিল এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এটি এয়ার ইন্ডিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
আন্তর্জাতিক বিমাননিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক বলছে, এটি ড্রিমলাইনার মডেলের উড়োজাহাজের প্রথম বড় দুর্ঘটনা।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ জানতে তদন্ত চলছে। বোয়িং ও ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে তদন্তকারী দল পাঠিয়েছে।



















