বাংলাদেশের মানুষ ক্রীড়ামোদী। ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় যে টাইটেল টেস্ট স্ট্যাটাস সেটাও এসেছে যতটা না প্লেয়ারদের পারফরমেন্সে তার চাইতে বেশি সাবের হোসেন চৌধুরীর চৌকুস নেতৃত্ব এবং তৎকালীন আইসিসির প্রেসিডেন্ট ডাল মিয়ার বদৌলতে।
বাংলাদেশের বড় সাফল্যে প্লেয়ারদের চাইতে দর্শকদেরই ভূমিকা সম্ভবত বেশি ছিলো-এজন্যই বাংলাদেশের সকল দর্শক তাদের মতামত ব্যক্ত করেন যেকোন জয় পরাজয়ে।
একই সূত্রে ফুটবলের ক্ষেত্রে বলা যায়- পৃথিবীর সবচাইতে বেশি ফুটবলপ্রেম এবং ফুটবল বিশেষজ্ঞ ব্রাজিলে এবং সেই ব্রাজিলের প্রতিটি মানুষই ফুটবল নিয়ে তাদের মতামত দেয়।
দুটি উদাহরণ টানার অন্যতম কারণ মূল বক্তব্যে যাওয়ার আগে একটি রেফারেন্স দেওয়া।
২০০২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলে রোমারিও এর অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট রিকোয়েস্ট করেছিলেন কোচ স্কলারিকে এবং স্কলারি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আপনার মন্ত্রিপরিষদ গঠনে আমি তো কোন মতামত দেই না। সুতরাং দল যদি পরাজিত হয় সেটার দায়ও আমি নেব কিন্তু রোমারিও কে দলে নেব না।’
পরবর্তীতে জানা যায় রোমারিও এর পারফরম্যান্স নয় তার বাদ পড়ার সবচাইতে বড় কারণ ছিল- শৃঙ্খলা ভঙ্গ কিংবা টিমের ডিসিপ্লিন নষ্ট করার ক্ষেত্রে রোমারিও একজন ফ্যাক্টর।
বাংলাদেশ টিমে মাশরাফি বিন মর্তুজা -তামিম ইকবাল সহ অন্যদের মধ্যে এই দলীয় ডিসিপ্লিন ভাঙ্গার অনেকগুলো অভিযোগ আছে এবং ড্রেসিং রুমের খবর বাহিরে বের করে দেওয়ার নজির রয়েছে। বিশেষ করে- তাদের কিছু সাংবাদিক আছে, যারা দল নির্বাচনের আগেই দল ঘোষণা করে দেয় কিংবা ব্যাটিং অর্ডার বলে দেয় বাইরে থেকেই, যেটি কোচ পর্যন্ত জানেন না। শুধুমাত্র হয়তো ক্যাপ্টেন আলোচনা করেছেন সেই আলোচনার ভিত্তিতেই তাদের ভিউ ব্যবসা।
আজ থেকে এক – দেড় যুগ আগে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রার আগেই বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং ক্রীড়া ম্যাগাজিনগুলো তাদের বিশেষ সংখ্যাগুলো প্রকাশ করতো। নিয়মিত লেখকদের পাশাপাশি অতিথি লেখকদের লেখাও খুব গুরুত্ব সহকারে স্থান পেত ক্রোড়পত্র এবং বিশেষ সংখ্যাগুলোতে।
কেমন হতে পারে দলের পারফরমেন্স ?কে হতে পারেন দলের টপ রান স্কোরার ? কে হবেন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি কিংবা কে হবেন মেন অফ দ্যা ম্যাচ কিংবা কাদের উপর থেকে চোখ সরানো যাবে না।
এমন ফিচার আর দৃষ্টিনন্দন এবং চিত্ত হরণকারী কাভারেজে ভরপুর থাকতো পত্রিকার পাতা – খেলাধুলার পাতার আকার বড় হয়ে যেত বিশ্বকাপ এলে। কিন্তু আজ প্রযুক্তি বলেন আর সংবাদপত্র কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রাচুর্য বলেন, অথবা যাই বলেন; সবকিছু প্রত্যাশার চাইতে বেশি বৃদ্ধি হলেও বাস্তবতার আয়নায় তারা সেই ধান্দা নিয়ে আছে- কখন ক্রীড়াপ্রেমিদের ইমোশনকে নিয়ে ভিউ ব্যবসা -কখনো চেতনার বুলি উড়িয়ে অবচেতন মনকে নাড়িয়ে দেওয়া, কখনো বা কোন প্লেয়ারকে নায়কের জায়গার চাইতেও মহানায়ক বানিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা।
তাদের পারফরমেন্স এর চাইতে নেতৃত্ববোধ কিংবা কন্ট্রিবিউশনের চাইতে তাদের এই সার্জারি, সেই সার্জারি এগুলো নিয়ে তৈরি করা কন্টেন্ট তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু ওই ভিউ ব্যবসা ।
খেলাধুলার ক্ষেত্রে মানদন্ডই হবে পারফরমেন্স এবং মাঠে পারফরমেন্সের ক্ষেত্রে ফিটনেস সবচাইতে বড় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। টাকা -পয়সা কিংবা প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়ে বিসিসিবি যতটা না পেশাদার হয়েছে কিংবা সেই মিডিয়া যতটা না পেশাদারিত্বের আবরণ তৈরি করে ইমোশনের ব্যবসা করে যাচ্ছে তার চাইতেও বড় ব্যাপার হচ্ছে এই ক্রিকেট বোর্ড কিংবা এই ক্রিকেট সাংবাদিকতার মাঝে কিন্তু আসল ক্রিকেটটাই নেই। এই বিশ্বকাপ যাত্রার প্রাক্ষালে তার জলন্ত উদাহরণ।
এভাবেই ক্রিকেট বোর্ড যেমন ইমোশন কে নিয়ে খেলছে কিংবা মিডিয়া ফোকাস হবার জন্য বোর্ডের কর্তারা বারবার মিডিয়ার সামনে আসছেন। অন্যভাবে বলা যায়- দেশের অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রেখে মিডিয়া হাউসগুলো যেভাবে তাদের সংবাদকর্মীদের ক্রিকেট কিংবা ক্রিকেট বোর্ডের পিছনে লেলিয়ে দেয় এবং দেশের বড় একটি অংশকে ক্রিকেটের মত একটি ব্যাপারকে নিয়ে জাতীয় ইস্যু বানিয়ে রাখে এর শিকড়ে আছে সেই অগণতান্ত্রিক চর্চা।
অধিক উন্নয়ন আর কম গণতন্ত্রের সংজ্ঞা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে যখনই বলে দেওয়া হয়, সেখানে ক্রিকেট কিংবা বিনোদন সেক্টরগুলোকে দিয়ে আফিমের মত মজিয়ে রাখতে রাষ্ট্রই মদদ দেয়।
একজন সাংবাদিক যখন তামিমের অবসর নিয়ে আকুল কণ্ঠে আবেদন করেন শেষ ভরসার জায়গা প্রধানমন্ত্রী কী শেষ কলটি দেবেন এবং সেই সূত্রে মাশরাফির মাধ্যমে সেই কান্ডটি যখন ঘটে এবং প্রধানমন্ত্রী বলেন, তুমি বিশ্বকাপ খেলতে যাও ,তামিম তখন উত্তরে বলেন- মাশরাফি ভাইকে মেন্টর হিসেবে নিয়ে যেতে চাই।
এই যে প্রধানমন্ত্রী কাউকে দলে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন আবার সে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে আরেকজনকে মেন্টর হিসেবে নিয়ে যেতে চাচ্ছে এইগুলো পৃথিবীর আর কোন স্পোর্টিং ইভেন্টে দেখবেন না ।
ব্রাজিলের স্কলারির বক্তব্য তো আগেই শুনিয়েছি অন্যান্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড কিংবা ফুটবল ফেডারেশনেও এমন নজির নেই ।
ক্রিকেট বোর্ড,কোচ,নির্বাচক, ফিজিও সবকিছু থাকার পরও প্রধানমন্ত্রী বলছেন! এইটা তো সেই তামাশার শুরু মাত্র।
সাকিবের বক্তব্য থেকে ক্লিয়ার -টিমের ছোট বড় সবাই জানতেন তামিম ইকবাল বিশ্বকাপে ক্যাপ্টেন্সি করবেন না এবং বাস্তবে সেটাই হয়েছে। তামিম কেন টিমের মধ্যে এই গুঞ্জনটির চর্চা শুরু করিয়েছিলেন সেটার উত্তর তামিমেরই দেওয়া উচিত।
আপনি ক্যাপ্টেন থাকবেন না – তাহলে এক বছর আগেই কেন সরে যাবেন না ? দ্বিতীয়ত পৃথিবীতে এমন কোন প্লেয়ার নেই যারা খেলতে খেলতে ফিট হয়ে যান । পেশাদার ক্রিকেটার হয়ে তামিম কিভাবে বলতে পারেন- আমি খেলতে খেলতে ঠিক হয়ে যাবো।
সাকিব আল হাসানের সাথে তামিমের সমস্যা এবং সেটি নিরসনের চেষ্টা করেছেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট কিন্তু পারেননি, এটাই বাস্তবতা ।
দুজন পেশাদার ক্রিকেটার বন্ধু থেকে হঠাৎ দুশমন হয়ে যাবে, একই দলে খেলবে এবং তারা একে অন্যের সাথে কথা বলবে না -ফলে দলে অটোমেটিক্যালি দুটি বলয় সৃষ্টি হয়ে যাবে। তাহলে এই দলের ডিসিপ্লিন কীভাবে থাকবে, সেটার উত্তর তারা দুজনেরই দেওয়া উচিত।
কিংবা তাদের ‘মেন্টর ভাই‘ নিয়মিত বোর্ডের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন কিন্তু এদের দুজনকে মিলিয়ে দেননি কেন? এখানে তামিম কিংবা সাকিব কে আলাদা করার দরকার নেই, সমস্যা দুজনের মধ্যেই ।
সাকিব ক্যাপ্টেন্সি করবে না সেটা ক্লিয়ার বলে দিয়েছেন তাহলে কি অন্য অপশন ছিল না ?
হ্যাঁ ,অপশন ছিল মিরাজ- লিটন কিন্তু অন্য অপশনগুলো এজন্যই ছিল না কারণ মুশফিক এবং মাহমুদুল্লাহর ক্যারিয়ার শেষ পর্যায়ে এবং তারা দলের নিয়মিত নয় । অথচ এই তামিমের নেতৃত্বে সবাই অলিখিত একটি নিয়ম তৈরি করেছিলো -টিমের মধ্যে সিনিয়রদের বাদ দিয়ে জুনিয়রদের নেয়া হবে না । সিনিয়রদের নিয়ে এই বলয়ে ক্যামনে ক্যামনে জানি সাকিব মিসিং আর এই মিসিং এর সূত্র আপনি খুজলে খুব সহজে উত্তরটি পেয়ে যাবেন ।
কয়েক বছর আগে উৎপল শুভ্রকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাকিব অকপটে বলে ফেলেছিলেন, পঞ্চপান্ডব বলে কিছু নেই পান্ডব একজনই আর সে আমি।
এর পরে আসলে দল দুটিভাগে বিভক্ত হয়ে যায় মাশরাফি- তামিম -রিয়াদ -মুশফিক অন্যদিকে সাকিব আল হাসান এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই জুনিয়র প্লেয়াররা সাকিবের ছায়ায় কমফোর্ডজোনে।
কারণ সাকিব দলে ছিলেন পারফরম্যান্স করে, কোন গুটিবাজি করে নয় এবং জুনিয়র যারা দলের সুযোগ পাচ্ছিল না তাদের জন্য সাকিবের পক্ষালম্বন করাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ দলে ঢোকার যে রাস্তা মুশফিকরা বন্ধ করেছিলেন সে ফটক তো সাকিবই খোলা রাখছিলেন।
অপেশাদারিত্ব যেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে চর্চা হচ্ছে সেখানে ক্রিকেট বোর্ডে এসব হবে- এটাই স্বাভাবিক আর সেই ক্রিকেট বোর্ডের সবচাইতে স্মার্ট কিংবা চতুর প্লেয়ার সাকিব সেই ফায়দা নেবে না- সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য কিংবা অস্বাভাবিক। এবং সাকিব সেটা কড়ায় গন্ডায় নিয়েছে , নিচ্ছে। সাকিবের আসলে সবচাইতে সৌভাগ্য হলো কিংবা তার অর্জন হলো- সে দলে কখনো বোঝা হয়ে থাকেনি এবং এই অ্যাডভান্টেজটি সে প্রবল অগুছালো বোর্ডের মধ্যেও বজায় রাখতে পেরেছে।
বিশ্বকাপের টিম পাওয়ার পর সাকিবের সবচাইতে বড় আকাংখা ছিল তার দলকে সে এক সুতোয় বেঁধে নিবে এজন্য সে দলটাকে এক গ্রুপ করতে চেয়েছে এবং সেখানেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা তামিম ইকবাল বাদ আর মুশফিক- রিয়াদরা সেই গ্রুপিং এ নেই কারণ নিজেদের অবস্থান ঠিক করতেই তারা এখন পেরেশান। ইতিপূর্বে জেমি সিডেন্স একবার তামিমকে চার নাম্বারে খেল্লে ভালো হবে বলাতে -তামিম উত্তর দিয়েছিলেন সিডন্সের কান্ডজ্ঞান নিয়ে। গুরু মারা শিস্য বোধহয় একেই বলে।
সাকিব আল হাসান আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলটাকে সৌরভ গাঙ্গুলীর সময়ের টীম ইন্ডিয়ার মতো চালাতে চাচ্ছে হয়তো। বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোতে তামিম ইকবালের পারফরমেন্স কিন্তু তামিমের কেরিয়ার গ্রাফের পারফরমেন্সের ধারে কাছেই নেই।তিনি যে রান করেছেন সেই হিসাবে একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় -তামিম দেশ সেরা ওপেনার হতে পারেন; বেস্ট ব্যাটসম্যান হতে পারেন কিন্তু বিশ্বকাপে তামিম না তাকাতে অপূরণীয় যে ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে সেটা সম্ভবত হচ্ছে না । দল হারুক কিংবা জিতুক তামিমের জায়গায় যে খেলবে , খেলছে তার সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল। অনিয়ম যে দেশে নিয়ম হয়ে যায় সেখানে সেসব মানিয়ে নেওয়া আরো জটিল। সাকিব এর অসংখ্য বাজে নজিরের বিপরীতেও বাজে পীচে দাড়িঁয়ে যাওয়ার যে নজির সেটা এপর্যন্ত অন্য ক্রিকেটারদের মাঝে কখনো কি দেখেছেন ? উত্তর ‘না‘ হলে বিশ্বকাপে তাদের সাথেই থাকুন পালাবদলের এই যাত্রা দীর্ঘ হলে কিন্তু দেশেরই ভালো এবং সিনিয়রদের উচিত ‘বিদায়‘ বলাটা শিখা অন্য গ্রেটদের দেখে অন্তত।
সাকিব প্লেয়ারদের বেতন বাড়ানোর, প্লেয়ারদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বোর্ডের বিপক্ষে গিয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্নীতি এবং আম্পারিং নিয়ে আওয়াজ দিয়েছেন এই সাকিব।
বিশ্বকাপের প্রোপার প্লানিং না থাকার কারণে বিসিবিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কিংবা পাইপলাইন দূর্বল হবার কারণে, বিসিবিকে সরাসরি দায়ী করেছেন -এই সাকিব। বিপিএল থেকে প্লেয়ার উঠে আসছেনা, বোর্ড প্রেসিডেন্ট বিপিএলকে বিশ্বের ২ নাম্বার লীগ বলার পর এই সাকিবই বলছিল, ৫,৬ নাম্বারেও নাই ।
সদিচ্ছা থাকলে বিসিবি ঠিকই ভাল টুর্ণামেন্ট আয়োজন করতে পারবে, বিসিবির সৎ ইচ্ছা নাই । কিংবা পাপন ভাইয়ের এভাবে বলা ঠিক হয়নি সাকিব ছাড়া একটা প্লেয়ারও বিসিবির এগেনস্টে কথা বলার সাহস পায়নি।
ছোট বেলায় শিষ দিলে যেটাকে বলা হতো বদমাইশি। আর এখন একটি অবস্থানে যাওয়ার পরে সেটিই হয়ে যায় কোয়ালিটি। সাকিব এজ এ গ্রেট প্লেয়ারের মতো একটি দাগও দেশের ক্রিকেটের। তো সেই দাগ থেকেই যদি ভালো কিছু হয় তাহলে হউক না। মন্দ কি।
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক । টরেন্টো, কানাডা।
২ অক্টোবর ২০২৩