ছিলো স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন। কিন্তু পরিণত হলো যেন শোকগাঁথায়। উপস্থিত অতিথি, এলাকাবাসী, পরিচিতজন ও স্বজনদের আবেগঘন স্মৃতিচারনা বার বার জানান দিচ্ছিলো প্রয়াত মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এমপি’কে হারানোর বেদনা এখনো কতটা দগদগে। তিনি মানুষের হৃদয়ে কতটা জীবন্ত!
অনুষ্ঠানে বক্তাদের কথায় বরাবরই উঠে আসে প্রয়াত মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর সততা, সাহসিকতা, মানবিকতা ও সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বগুণের কথা। তাঁরা বলেন, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও জনদরদী। সেকারণেই তিনি যুক্তরাজ্যের অভিজাত জীবন ফেলে বাংলাদেশে গরিব-দুঃখী মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন।
সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলা, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা এবং বালাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-৩ নির্বাচনী এলাকা। এই এলাকার পর পর তিন মেয়াদে নির্বাচিত এমপি ছিলেন মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে তৃতীয় মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি ২০২১ সালের ১১ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াত মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এমপি’র জীবন ও কর্মকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রকাশিত হয়েছে ‘হৃদয়ে মাহমুদ উস সামাদ’ স্মারকগ্রন্থ।
গত ১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার পূর্ব লন্ডনের সুপিসর ইস্ট লন্ডন একাডেমি মিলনায়তনে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইটির পাঠ আলোচনা করেন কবি ও গবেষক ফারুক আহমদ। আনুষ্ঠানিকভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। তাঁর সঙ্গে অতিথি ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব লর্ডস সদস্য পলা মঞ্জিলা উদ্দিন, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক, সোলসব্যারি কাউন্সিলের মেয়র কাউন্সিলার আতিকুল হক, রেডব্রিজ কাউন্সিলের মেয়র কাউন্সিলার জোছনা ইসলাম।
একটি কমিউনিটি উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে নেতৃত্বে ছিলেন চ্যানেল এস-এর চেয়ারম্যান আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি। তিনি প্রয়াত মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এমপি’র ছোট ভাই। অতিথি ও কমিউনিটির বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি এ অনুষ্ঠানের যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহর থেকে ছুটে আসেন অনেকেই। ভিডিওচিত্রে তুলে ধরা হয় মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর কর্ম ও তাঁর প্রতি এলাকার মানুষের ভালোবাসার নানা চিত্র।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে চ্যানেল এস-এর চেয়ারম্যান আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি আবেগঘন কণ্ঠে ভাই হারানোর বেদনার কথা তুলে ধরেন। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমরা কেবল ভাই ছিলাম না। আমরা ছিলাম বন্ধু। আমাদের পরিবার সব সময় মানুষের সেবায় নিয়োজিত থেকেছে। একইভাবে আমরা দুই ভাই যুক্তরাজ্যে একসাথে বড় হয়ে নানা ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও সিদ্ধান্ত নিলাম- এক ভাই বাংলাদেশে গিয়ে মানুষের সেবা করবো। তিনি বাংলাদেশে গেলেন। এক সময় রাজনীতিতে যোগ দিলেন। প্রতিদিন আমাদের মধ্যে কথা হতো। এলাকার উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে আমরা একে-অপরের সাথে পরামর্শ করতাম। কীভাবে এলাকার উন্নয়ন করা যায়, কীভাবে এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করা যায় তা ছিলো তাঁর ধ্যানজ্ঞান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে দিয়ে ‘শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ’ শুরু করান। প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী ছিলেন একজন বিরল ব্যক্তিত্ব যার উদাহরণ দেয়া যায় না। তাঁর মিশন এবং ভীশন ছিলো বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং উন্নয়ন। সততা ও নিষ্ঠার সাথে তিনি কাজ করে গেছেন। তিনি ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতেন। যার উদাহরণ সিলেট-৩ আসনের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মের মধ্যে পাওয়া যায়। আমার ভাইয়ের নেশা ছিলো মানুষের জন্য কাজ করা।
আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জানান, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এমপি’র মৃত্যুর পরপর একটি স্মরণসভায় প্রস্তাব এসেছিলো স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের। সেই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কাজ শুরু করেন। যার ফল এই ‘হৃদয়ে মাহমুদ উস সামাদ’ গ্রন্থটি। গ্রন্থ প্রকাশ ও প্রকাশণা অনুষ্ঠানে সহযোগিতার সঙ্গে যুক্ত সকলের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন ব্রিস্টল শাহজালাল জামে মসজিদের ইমাম হাফিজ আজিজুর রহমান খান। নানা স্মৃতিকথা ও কবিতার পক্তিমালার গাঁথুনিতে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন চ্যানেল এস-এর প্রেজেন্টার ফারহান মাসুদ খান ও সংবাদ পাঠক মুনিরা পারভীন।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ডঃ হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বইটির মোড়ক উন্মোচন করার কথা ছিলো। কিন্তু জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশে ফিরতে হওয়ায় তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। যে কারণে আগেরদিন একটি ছোট আয়োজনে তিনি বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত একটি ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, জীবনের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে কাটানোর পরও মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী দেশে গিয়ে যেভাবে গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন তা সত্যিই অভাবনীয়। তিনি এলাকায় প্রচর উন্নয়ণমূলক কাজ করেছেন। যখন জনপ্রিয়তার একেবারে তুঙ্গে তখন তিনি করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি করোনায়ও মানুষের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁকে হারনো অত্যন্ত দুঃখজনক।
অনুষ্ঠানে ব্যারোনেস পলা মঞ্জিলা উদ্দিন বলেন, সামাদ পরিবারের সঙ্গে তাঁর বেশ ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর সততা, মানবিকতা ও নতৃত্বগুন সম্পর্কে তিনি অবগত। ‘হৃদয়ে মাহমুদ উস সামাদ’ বইটি তাঁর স্মৃতির প্রতি একটি উত্তম প্রতিদান বলেন মন্তব্য করেন হাউজ অব লর্ডসের এই সদস্য।
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বলেন, প্রয়াত মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কেবল একজন এমপি ছিলেন না। তিনি প্রতিরক্ষা ও ধর্মসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের সামরিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী যুক্তরা্জ্য ও বাংলাদেশে মানুষের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন মন্তব্য করে হাইকমিশনার। তিনি স্মারক গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এতে যুক্তরাজ্যে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্ম প্রয়াত মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে পারবে এবং যুক্তরাজ্যে বড় হয়েও যে বাংলাদেশের গিয়ে নিজের মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় সে বিষয়ে অনুপ্রাণিত হবে।
যুবক বয়স থেকে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় জানিয়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলাতান মাহমুদ শরীফ বলেন, যুক্তরাজ্যে এসে মানুষ দুটি কাজ করে। প্রথমটি হলো নিজের জন্য গড়ে এবং শিখে। দ্বিতীয়টি হলো মানুষের জন্য গড়ে এবং শিখে। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী দ্বিতীয় কাজটি করেছিলেন। সামাদ পরিবারের কখনো দেয়া ছাড়া নেয়ার দরকার হয় নাই। তিনি বলেন, সিলেটের মানুষদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি শুনতে হয় জমি ও সম্পদ দখলের অভিযোগ। কিন্তু মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এমপি হওয়ার পর ওই এলাকার মানুষের কাছ থেকে কখনো কোনো দখলের অভিযোগ শুনতে হয়নি। প্রয়াত মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীকে দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসীনের তুলনা করেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক বক্তব্যে তাঁর বিভিন্ন ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এমপি বহু আগ থেকেই তাঁর এলাকায় কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, রুচিশীল এবং স্মার্ট একজন এমপি।
মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর সাহস, সততা ও ত্যাগের দিকে আলোকপাত করেন চ্যানেল এস-প্রতিষ্ঠাতা মাহী ফেরদৌস জলিল। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের বিলাসী জীবন ফেলে যিনি বাংলাদেশের গরীব-দুঃখী মানুষের সঙ্গে থাকতে পারেন তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী সেই কাজটি করতে পেরেছেন। একটি ঐতিহ্যবাহী-সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি খেটে খাওয়া মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিলেন অবলিলায়। তাঁর হৃদয় ছিলো বিশাল আর কাজের রুচিও ছিলো বিরল। তিনি বাড়ির সামনে যে মসজিদ করেছেন সেই মসজিদ দেখলে তাঁর রুচি ও হৃদয়ের বিশালত্ব টের পাওয়া যায়।
সোলসব্যারি কাউন্সিলের মেয়র কাউন্সিলার আতিকুল হক এবং রেডব্রিজ কাউন্সিলের মেয়র কাউন্সিলার জোছনা ইসলামও প্রয়াত মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর স্মরণে বই প্রকাশের প্রশংসা করে বক্তব্য রাখেন। তাঁরা মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
এছাড়া, উপস্থিত অনেকেই মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা তুলে ধরেন। একজন বলেন, করোনায় তিনি দেখেছেন নিজের পুকুরের মাছ তুলে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী অন্যান্য বাজার-সদাইসহ প্যাকেট করে মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌছে দিচ্ছেন। কেউ কেউ সামাদ পরিবারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত উপকার পাওয়ার কথা স্মরণ করেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ জানুয়ারি সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে ‘হৃদয়ে মাহমুদ উস সামাদ’ স্মারকগ্রন্থের প্রথম প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়েছিলো।
কবি ও গবেষক ফারুক আহমদ কর্তৃক ‘হৃদয়ে মাহমুদ উস সামাদ’ গ্রন্থালোচনা:
মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এমপি একজন বহুমুখী প্রতিভাধর, স্বতন্ত্রে্য প্রতিষ্ঠিত একজন মহিমান্বিত জননেতা ছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই মানুষটি নিজের প্রজ্ঞা, অসদম্য সাহস আর সাধনা বলে জীবন ও জীবিকা, সমাজকর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে অনেক আলোপড়ে এমন জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তার শিকড় ছিল ঐতিহ্যবাহী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নূরপুর গ্রামে এক সুশিক্ষিত পরিবারে। নিজ এলাকা থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। ফলে তার জীবনে যেমন প্রাচ্য ও প্রশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয় ছিল, তেমনই এই দুটি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে নিজের মধ্যে ধারন করতে পেরেছিলেন। দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আইয়ুব—বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে দীক্ষা নিলেও তার গণতান্ত্রিক রাজনীতির হাতেখড়ি ও বিকাশ হয়েছে ইংল্যান্ডে, দুই দুইবার ঐতিহ্যবাহী বাথ সিটি কলেজে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়ে।
তিনি জানতেন, রাজনীতি করতে হলে প্রথমে নিজেকে আর্থিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ইংল্যান্ডে বাঙালিদের বনেদি পেশা ও ব্যবসার ক্ষেত্র হচ্ছে ক্যাটারিং সেক্টর। বিলাতের বাঙালির সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি তার ছোট ভাই আহমদ উস সামাদ চৌধুরীকে অংশীদার করে ক্যাটারিং ব্যবসা শুরু করেন এবং অতি অল্পকালের মধ্যে নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। বিশ শতকের আশির দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে আসা ভ্রমণ—পিপাশুদের কাছে বাথ শহরেএই ভাতৃদ্বয়ের প্রতিষ্ঠিত রাজপুত রেস্টুরেন্টের আকাশছোঁয়া সুখ্যাতি ছিল। তারপর তাদেরকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাথ ও বৃস্টল শহরে একে একে তারা দশটি ব্যবসা সফল রেস্টুরেন্টের মালিকানা অর্জন করেন।এই রেস্টুরেন্টগুলো শুধু সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই ছিল না, একইসঙ্গে বাথ ও বৃস্টলে অধ্যয়নরত বাঙালি শিক্ষার্থীদের আশ্রয় ও জীবিকা এবং বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
একপর্যায়ে সামাদ ভাতৃদ্বয় সিদ্ধান্ত নেন দেশের সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী তখন দেশে ফিরে গিয়ে গার্মেন্টস ফেক্টরিচালু করেন। সিলেটের সাধারণ মানুষের মুখপত্র হিসেবে নিজ উপজেলার নামে প্রকাশ করেন ফেঞ্চুগঞ্জ সমাচার। এভাবে এক পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং অতি অল্পকালের মধ্যে শুধু সিলেট বিভাগের মধ্যেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও তার নামটি বহুমাত্রিক তাৎপর্যে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে। তিনি সিলেট—৩ (দক্ষিণ সুরমা—বালাগঞ্জ—ফেঞ্চুগঞ্জ) আসন থেকে পর পর দুইবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। বিচক্ষণ, সদালাপী, বন্ধু—বৎসল এই মানুষটিকে ঘিরে সিলেটবাসী অনেক স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু করোনা মহারারী তাকে তার আরাধ্য কাজগুলো যেমন করতে দিলোনা, তেমনি অভিষ্টলক্ষেও পৌঁছতে দিল না। নিয়তির কাছে তিনি হেরে গেলেন। সিলেট হারালো তার এক সুর্য়সন্তানকে।
এ বছর (২০২৩) বহুমাত্রিক গুণাবলীর অধিকারী ক্ষণজন্মা এই মানুষটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘হৃদয়ে মাহমুদ উস সামাদ’ শিরোনামে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থের জন্য বাণী প্রদান করেছেন বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এমপি, ব্যরোনেস মনজিলা উদ্দিন, টাওয়ার হ্যামলেট্স কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র লুতফুর রহমান এবং বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনের বর্তমান এমপি রোশানারা আলী প্রমুখ। স্মারক গ্রন্থটিতে ঊনষাটটি লেখা স্থান পেয়েছে। স্থান পেয়েছে তার সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য ও কর্মযজ্ঞের তালিকা।
পরিশিষ্টে আছে মহান জাতীয় সংসদে নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন দাবি—দাওয়া নিয়ে দেয়া বক্তৃতা। আছে তার বর্ণঢ্য জীবনের স্থির চিত্র। মোটকথা, একজন মুহমুদ উস সামাদ চৌধুরীকে জানতে যা যা দরকার সবই অতি যত্ন সহকারে স্মারক গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে।
অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই স্মারক গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি। সহযোগিতায় ছিলেন রিয়াজ উদ্দীন ইসকা, নজরুল মিন্টো, আবদুল মালিক জাকা, মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন, মঈন উদ্দিন মঞ্জু, জাহাঙ্গীর আলম মুসিক ও জুলহাস আহমদ। প্রকাশ করেছেন আহমদ উস সামাদ চৌধুরী। ফরিদ উদ্দীন আজমানীর আলোকচিত্রের ভিত্তিতে চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন লুৎফুর রহমান তোফায়েল। স্মারক গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়েছে সিলেটের দোআঁশ প্রকাশনী থেকে।
মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী রাজনৈতিক সতীর্থ, অনুসারি, শুভাকাক্সক্ষীরাতো বটে, সিলেটের ইতিহাস ও ঐহিত্য সম্পর্কে যারা জানতে আগ্রহী এবং যারা সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেন, প্রবন্ধ—নিবন্ধ লেখেন তারা এই মূল্যবান স্মারক গ্রন্থটি সংগ্রহ করতে পারেন। ৪১৬ পৃষ্ঠার এই স্মারক গ্রন্থটিটি যে দলমত নির্বিশেষে সমানভাবে সমাদৃত হবে তা বলাই বাহুল্য।
ছবি: খালিদ হোসাইন,৫২বাংলা