বিলেতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিলেতে বাঙালির ইতিহাস লিখতে হলে রেস্টুরেন্ট ছাড়া সে ইতিহাস লেখা অসম্ভব। ব্রিটেনে বাঙালির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শুধু নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত গড়তে ও ব্রিটেনের রেস্টুরেন্ট ব্যবসার অবদান অপরিসীম।
বাংলাদেশের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ ও বিখ্যাত ব্যারিস্টাররা ও এদেশে এসে ছাত্র অবস্থায় রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন এবং পরে দেশে গিয়ে রাজনীতি ও আইন ব্যবসাতে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন. জনশ্রুতি আছে বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাস, বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, সাবেক উপ রাষ্ট্রপতি ও সাবেক আইনমন্ত্রী সহ অনেকেই এই দেশে রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন ছাত্র থাকা অবস্থায়।
এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমাদের বাপ- দাদারা দিন রাত পরিশ্রম করেছেন। একসময় বাংলাদেশি খাবার ও রেস্টুরেন্টগুলোকে ইন্ডিয়ান নামে চিনতো এদেশের মানুষ।
কিন্তু আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম গিল্ড অব বাংলাদেশ নামে সংগঠন করে সবাইকে সংগঠিত করে একে একে রেস্টুরেন্ট এর নামগুলোকে বাংলায় নামকরণ করতে থাকেন। খাবারগুলো পরিচিত করেন বাংলাদেশি খাবার হিসাবে। আজকে বিলেতের আনাচে -কানাচে বাংলাদেশের ফুল, পাখি কিংবা প্রত্যন্ত গ্রাম বা শহরের নামে রেস্টুরেন্টের নাম দেখতে পাবেন। যুক্তরাজ্যে রেস্টুরেন্ট সেক্টরে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের অবদান বিলেতের মূলধারায় স্বীকৃত। ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত রেস্টুরেন্ট ব্যবসা অবস্থান নিয়েছে একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম হিসাবে।
এখন এই ব্যবসাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে নতুন প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়াতে হবে এবং রেস্টুরেন্ট স্টাফদের মানোন্নয়নে ভূমিকা নিতে হবে। এবং এটা করতে হলে রেস্টুরেন্টে ঈদের ছুটিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বেশ কযেক বছর ধরে দুই ঈদে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা কিংবা ঈদে রেস্টুরেন্টের স্টাফদের ছুটি দেয়ার ব্যাপারে একটা ক্যাম্পেইন চলছে। আমি এই সচেতনতামূলক ক্যাম্পাইনের শতভাগ সমর্থন করি।
সারাবিশ্বে “স্টাফ বা কর্মীদের অধিকার” একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করে তাঁদের স্টাফদের সুযোগ -সুবিধা দেয়ার জন্য এবং এটাকে মার্কেটিং করে তাঁদের ব্যবসাকে প্রসারিত করেন । এবং কাস্টমাররা এটাকে ইতিবাচক হিসাবে নেন।
কিছুদিন আগে লন্ডনের সাউথ উডফোর্ডে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম, রেস্টুরেন্টের মালিক বললেন তাঁরা দুই ঈদে তাঁদের স্টাফদের ছুটি দেন এবং রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখেন। এতে তাঁদের ব্যবসার ক্ষতি নয় বরং তাঁদের কাস্টমাররা এটাকে ইতিবাচক হিসাবে নেন । তাদের রেস্টুরেন্টকে স্টাফ বান্ধব হিসাবে প্রশংসা করেন এবং মালিক এটাকে কাজে লাগান। নিজেদের ব্যবসাকে ব্র্যান্ডিং করতে কাস্টমারদের কাছে তাঁরা তুলে ধরেন, তাঁরা কীভাবে তাঁদের স্টাফদের মৌলিক তথা ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট। এতে তাঁদের রেস্টুরেন্টের সুনাম বৃদ্ধি হয়।
এখন সোশ্যাল মিডিয়া ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্ট এর যুগ চলছে। দুই ঈদে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রেখে “আমরা স্টাফদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট” স্লোগান দিয়ে নিজেদের ব্র্যান্ড কাস্টমারদের কাছে তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। এতে রেস্টুরেন্টের লস হওয়ার পরিবর্তে ব্যবসা বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
কারণ মূলধারার মিডিয়া বলেন আর স্থানীয় মিডিয়া বলেন, তাঁরা এটাকে ইতিবাচক হিসাবে নিয়ে আপনার মার্কেটিং এ সহযোগিতা করবে বলে আমি মনে করি।
ঈদের দিন ঘরভর্তি আত্মীয়- স্বজন রেখে কাজে যেতে কার মন চায়? অনেকেই কাজে যান ঠিকই কিন্তু মন পড়ে থাকে প্রিয়জনের কাছে। মুসলমানদের পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের দিন ঈদ, এই দিনে আমাদের থাকে মন খারাপ। মন খারাপের দিনে মন দিয়ে ব্যবসাও হয় না। শুধু শুধু আমরা মিস করি আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান।
ঈদের দিন অনেক বাসায় গেলে দেখি ছোট বাচ্চাদের মন খারাপ। কারণ একটু পরে বাবা কিংবা চাচা কাজে চলে যাবেন। সারাদিন তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনের সাথে ঈদের স্বর্গীয় আনন্দ ভোগ করতে পারবে না, এই বাচ্চাটা রেস্টুরেন্ট ব্যবসাকে ঘৃণা করেই বড় হবে- বলতে গেলে এটা এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য হুমকি স্বরূপ।
ট্যাক্সিসহ আরও বিভিন্ন নমনীয় কাজে ঝুঁকছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। অনেকে তাঁদের দামি কাজও ছেড়ে দিচ্ছে তাঁদের ধর্মীয় ও পারিবারিক কমিটমেন্ট রক্ষার জন্য। তাই রেস্টুরেন্টের কাজকে আকর্ষণীয় করে তোলা এখন সময়ের দাবি।
জীবনটা কয়েকটা বছরের সমষ্টি। আর এই বছরগুলোর মধ্যে ঈদের দিনগুলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের । ঈদ হচ্ছে পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে কাটানোর দিন। এই দুইটা দিন আমরা ব্যবসার মধ্যে বিলিয়ে না দিয়ে যদি নিজেদের পরিবারের মধ্যে এবং স্টাফদের তাঁদের পরিবারের সাথে সময় কাটাতে সাহায্য করি, তাহলে হয়তো আমরা আরশের অধিপতির সুনজরে পড়েও যেতে পারি । এই কারণে এবং এই বিষয়টাকে নিয়ে মার্কেটিং করে ব্যবসার ধস নয় বরং প্রসার ঘটানো সম্ভব । শুধু প্রয়োজন আমাদের সদিচ্ছা। জয় হোক ‘ঈদের ছুটি চাই’ ক্যাম্পেইন।
সাজু আহমদ ,বিশেষ প্রতিনিধি ,বাংলা সংলাপ ।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক ,শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব