একটা দেশ কিংবা রাষ্ট্রে সংকট দেখা দিতেই পারে । সে সংকট কখনও সৃষ্টি হয় আভ্যন্তরীন নানাধরনের দুর্যোগ নিয়ে, আবার কখনো বা আন্তর্জাতিক কোন দুর্যোগ-যুদ্ধ দেশটাকে প্রভাবিত করতেই পারে । উপসাগরীয় যুদ্ধকালীন সময়ে ইউরোপের কিছু দেশ সংকটে পড়েছিলো । মিত্র শক্তিগুলোর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় অর্থনিতীতে প্রভাব পড়তে পারে । পড়েছেও ব্রিটেনে । ইরাক-ইরান যুদ্ধ কিংবা এ শতাব্দির শুরুর দিকেও ব্রিটেনের মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয় । কিন্তু সে সময়গুলোতেও কোন সরকারই হাল ছাড়ে নি । রাষ্ট্রের নাগরিকদের একটা বড় অংশ রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করলেও নতুন নেতারা এসে দেশটাকে তোলে এনেছেন আবারও।
এরকমই একটা সময় চলেছে ব্রিটেনে গত কয়েক বছর থেকে । এ সংকট যতটুকু না সৃষ্টি করেছিলো সরকার, তার সমান দায় নিতে হবে কতিপয় অবিমৃষ্যকারী রাজনৈতিক নেতাদের, এমনকি রাষ্ট্রের জনগণও এর দায় থেকে মুক্ত নন । ব্রিটেনের বাইরের দেশগুলো অর্থাৎ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে স্রোতের মত আসা মানুষগুলোর তখন স্থায়ী আবাস গড়া এর একটা কারন হতে পারে । এমনিতেই সংকট ছিল জাতীয় স্বাস্থ্য সেবায় এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে । আর এই সময়টাকে ব্যবহার করেছিলেন নাইজেল ফারাজ কিংবা বরিস জনসনের মত নেতারা । দেশের সাধারন জনগণের একটা বদ্ধমুল ধারনা ছিল যে, স্কুলে নিজস্ব এলাকার(লোকাল) ছাত্র-ছাত্রীদের জায়গা হচ্ছে না কিংবা স্বাস্থ্য সেবায় মানুষ সেবা পাচ্ছে না—এরকম পরিস্থতি সৃষ্ঠির পেছনে ইউরোপের দেশগুলো থেকে আসা মানুষদের দায়ী করতে পেরেছেন নেতার । তাঁরাও ইউরোপের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধা অভিবাসন নীতি তখন সামনে নিয়ে আসেন । নাইজেল ফারাজ কিংবা বরিস জনসন এই ধারনাটা মানুষের কন্ঠে তুলে দিয়েছিলেন তখন । শুধু তারা দুজনই নন, বরিস জনসন তখন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, তাঁর নেতৃত্বে কনজারভেটিভ দলের কিছু এমপি ও প্রভাবশালী মানুষও এতে নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের দাবীকে তারা গণভোটে পাশ করে নিয়ে আসেন । হেরে যান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যমেরুনের নেতৃত্বে ব্রেক্সিটের বিপক্ষের(রিমেইন) অংশ। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেনের চমক লাগানো নেতাদের মাঝে একজন তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যমেরুনের দুঃখজন বিদায় ঘঠলে তেরেসা মে ক্ষমতায় আসেন । কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেট যদিও, তবে তিনি ‘চ্যলেন্জিং ব্রেক্সিট’ মোকাবেলা করতে পারেন নি । ইউরোপীয়ান দেশগুলোর নেতাদের যাচ্ছেতাই কথাবার্তা, আভ্যন্তরীনভাবে রাজনৈতিক নেতাদের দুদোল্যমানতার কাছে থেরেছা মে-কেও বিদায় নিতে হয় । আসেন বরিস জনসন । তাঁর একগুয়েমী মনোভাব রাষ্ট্রের তখন প্রয়োজন ছিল । ব্রেক্সিটের সুফল কিংবা ব্যর্থতা হয়ত আগামীর ইতিহাস মূল্যায়ন করবে, কিন্তু জনগণের দেয়া ম্যান্ডেটকে সার্থক পরিণতি দেয়া একটা সরকারের দায়ীত্ব এবং এই দায় নিয়ে বরিস ঠিকই ব্রেক্সিট করতে পেরেছিলেন । ব্রেক্সিট সম্পাদনই তাঁকে কিছুটা একরোখা করে তুলে, এবং একের পর এক তাঁর সরকার সমালোচিত হতে থাকে । এসময়ই দুর্যোগ আসে —–করোনা ভাইরাসে পৃথিবী সয়লাব হয় । ব্রিটেন বিধ্বস্থ হতে থাকে । জনগণকে এসময় ভয়হীন করা, বেঁচে থাকার জন্য নির্ভরতা দেয়া তখন একটা সরকারের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় । বরিসের সরকার এ কাজটা করতে পেরেছে । সমলোচনা ছিল হয়ত, কিন্তু নাগরিক তাঁর উপর থেকে আস্থা হারায় নি । অর্থনৈতিক প্রনোদনায় নাগরিকদের মাঝে কিছুটা হলেও স্বস্থি ছিল । ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে যে বিশাল প্রনোদনা তা দিয়ে খাদ থেকে তোলে আনতে সচেষ্ট ছিল সরকার ।
এরকম টানেপোড়নের মধ্যি দিয়েই বরিস জনসনের পদত্যাগ এবং লীজ ট্রাসের ক্ষমতায় আসা । কিন্তু ব্রিটেনের বর্তমান অবস্থায় লীজ ট্রাস শুধু তাঁর ব্যক্তি চৌকষতা নিয়ে মূলত কোন কাজই করতে পারেন নি। কোনপ্রকারের পরিবর্তন তো দূরের কথা, বরং অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা হলেও নিম্নগামি দেশটাকে কোন দিশা দেখাতে না পেরে শেষপর্যন্ত নিজে থেকেই বিদায় নিলেন মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় । ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে অল্প সময় ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ে তিনি প্রস্থান করেন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেনের এই রাজনৈতিক সংকটে ক্ষমতাসীন দলকে নেতা নির্ধারন করতে হয় । অনেক কাটখড় পুড়িয়ে এখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী রিসি সুনাক । রসি সুনাক নিয়ে ব্রিটেনেতো বটেই, সারা পৃথিবীতেই আছে একটা আলোচনা, যেরকম আলোচনাটি এসেছিলো আমেরীকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার বিশ্বনেতৃত্বে আসায় । কিন্তু আমেরীকার রাষ্ট্রপতি যে দল থেকে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই দলেরই এজন্ডো বাস্তবায়নে কাজ করেছেন । তিনি ইতিহাস তৈরী করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর দেশের রাজনীতিতে এমনকি আন্তর্জাতিক দৃষ্ঠিভঙ্গিতেও তিনি মানবিক হওয়ার চেয়ে তাঁর দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন ।
সেভাবেই রিষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হবার পর একধরনের উচ্ছাস আছে দক্ষিন এশিয়ার বিভিন্ন কমিউনিটিতে। এশিয়ানদের মাঝ থেকে প্রথম প্রাইম মিনিষ্টার হিসেবে তিনি ব্রিটেনে স্থান করে নিয়েছেন, সেজন্য । ভারতের জনগন বলছেন ভারতীয়, এশিয়ানদের একটা অংশ বলছেন এশিয়ান আবার অতি উৎসাহি কেউ কেউ বলছেন হিন্দু, যেভাবে ওবামা আসার পর ‘হোসেন’ তাঁর নামের সাথে সংযুক্ত থাকায় কেউ কেউ তাঁকে মুসলিম হিসেবেও চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন । কিন্তু রিষি সুনাক —তিনি কনজারভেটিভ পার্টির লিডার নির্বাচিত (মনোনীত) হয়েছেন সংখ্যা গরিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ানদের সমর্থন নিয়ে, এমনকি তাঁর পার্টির সদস্যদের ভোটেও নয় । যেহেতু তিনি লীডার সেহেতু তিনিই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছন । নিঃসন্দেহে এ এক বিশাল অর্জন ।
ব্যক্তি হিসেবে রিষি সুনাক তাঁর পার্টির এজন্ডাকে বাস্তবায়িত করবেন, এটাই বিশ্বাস রেখেছে টোরী পার্টি। বিশেষত গত করোনাকালীন সময়ে দেশটার চ্যান্সেলার হিসেবে তিনি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন, তা তাঁকে দিয়েছে বিশাল জনপ্রিয়তা । দেশটার আপামর জনসাধরনের মাঝে তাঁর একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরী হয় । প্যান্ডামিকের সময় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী অনেকই বিভিন্ন রকম সমালোচনার মাঝে জড়িয়ে পড়লেও তিনি এসব কিছুর উর্ধ্বে থাকেন । পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রীর সম্পত্তির ট্যাক্স পরিশোধ নিয়ে কথা উঠলে তা-ও তিনি সমালোচনায় যাবার আগেই গণমাধ্যম’র থাবা থেকে সরিয়ে আনতে পারেন প্রয়োজনীয় সব কিছু করেই ।
রিষি সুনাকের শুরুটা অনেক ভাল বলতেই হবে । লিজ ট্রাস আসার পরই মনে হয়েছে তাঁকে বিদায় নিতে হবে, কিন্তু সুনাকের প্রথম বক্তৃতাটাই দেশের নাগরিকদের একটা আশা দিয়েছে । দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে তাঁর দৃঢ়তার কথা নাগরিকদের আশ্বস্থ করেছে বলেই মনে হয় । লিজ ট্রাস দেশের যে বিভিন্ন পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তার প্রশংসা করে তিনি অকাতরে বলেছেন, এতেও কিছুটা ভুল ছিল এবং এটা তিনি কিংবা তাঁর সরকার সংশোধন করে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিগ্গ ।
তিনি যে তাঁর পার্টির এজেন্ডাকেই বাস্তবায়ন করবেন, সেটা তার প্রথম মন্ত্রী পরিষদ গঠনেই প্রতিয়মান হচ্ছে । এথনিক ব্যকগ্রাউন্ডের মানুষরাই এদেশে ইমিগ্রেন্ট হচ্ছে, যেমন হয়েছেলেন রিষির মাতা-পিতারাও । বৈধ কিংবা অবৈধভাবে মানুষের আসা-যাওয়া আছে এদেশটাতে । মানুষের আসা-যাওয়ার স্রোত ঠেকাতে বরিস জনসনের সরকার অভিবাসন প্রত্যাশী অবৈধভাবে আসা মানুষদের রুয়ান্ডায় পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত আদালতের মাধ্যমে ব্যর্থ হলেও হাল ছড়েন নি এমনকি ট্রাসও । তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সোয়েলা ব্রেবারম্যানকে । রিষি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ঐ মন্ত্রীকে অপসারন করা হয় রাষ্ট্রীয় এক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পাশ হবার কারণে । অথচ বিরোধী দলসহ গনমাধ্যমের শত সমালোচনার পরও ঐ মন্ত্রীকেই তিনি পুনঃনিয়োগ দিয়েছেন। কারন সোয়েলা অভিবাসন প্রত্যাশী অবৈধ প্রবেশকারীদের রুয়ান্ডা পাঠাতে বদ্ধপরিকর ।
রিষি সুনাক’র পার্টির অভন্তরেই বর্ণবাদ নিয়ে শতাধিক অভিযোগ আছে, কিন্তু এ নিয়ে তিনি কখনো কথা বলেনি , এখনও বলছেন না । তিনি এক পার্টিতে ইতিপূর্বে বলেছেন, তাঁর কোন গরীব বন্ধু নেই । ইসলামো ফোবিয়া ব্রিটেনে একটা অতিরঞ্জিত ইস্যূ । এ নিয়েও তাঁর কোন কথা নেই । বরং লেবার পার্টির এক এমপি আফজাল খান এ ব্যাপারে তাঁকে চিঠি দিলে তাতে তিনি এমনকি কোন উত্তর পর্যন্ত দেন নি ।
রিষি সুনাককে নিয়ে এশিয়ান কমিউনিটির অতি উৎসাহি হবার কোন কারন দেখি না । একজন কনজারভেটিভ হিসেবে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র ২০১৫ সালে । এবং পার্টির নীতি-ধারনা-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একজন কমিটেড কনজারভেটিভ রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই তাঁর দলের এমপিদের আস্থা স্থাপন করেছেন তিনি । সুতরাং এ দলটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনে রুয়ান্ডা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, ইসলামো ফোবিয়া জিইয়ে রাখা, বর্ণবাদ ইস্যূকে সমাধান না করা,ধনীদের আরও ধনী করার প্রয়াশ তাঁর থাকবেই । ব্রিটেনের রাজনীতিতে মিরাকল কিছু হবার নয়, কারন এখানে সব কিছুই একটা পদ্ধতির মধ্যি দিয়েই আগাতে হয় । সেজন্যই আগামী দুই বছরে সুনাক তাঁর রাজনৈতিক অগ্রযাত্রায় তা-ই করতে সচেষ্ট থাকবেন, যা তাঁর সমর্থিত এমপিরা চায় কিংবা তাঁর সম্পদশালী বন্ধুরা প্রত্যাশা করে ।
ভারতীয়রা কি চায় কিংবা এশিয়ানদের কি প্রয়োজনীয়তা তা তার বিবেচনার বাইরে থাকবে আগামী দু’বছর। বহু উচ্চারিত জাতীয় ইস্যূগুলোর বিশেষত অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, জ্বালানীসংকট দূরীকরন করাই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর বাইরে কোন সমালোচনাকে খুব একটা গুরুত্ব দেবেন বলে মনে হচ্ছে না। এতে যদি এশিয়ান কমিউনিটির কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে কিছু স্পর্শও লাগে তাতে তিনি ভ্রক্ষেপ না করলেও তাঁর কোন ক্ষতি নেই ।