স্থানীয় নির্বাচনে (কাউন্সিল) লেবার পার্টি ব্রিটেনে এবার কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে ব্রিটেনে ২০১৯ সালে লেবার দল হারলেও লিডার হিসেবে করবিন জায়গা করে নিয়েছিলেন জনগণের মাঝে। বাম ধারার এক জনবান্ধব নেতা করবিন দেশটার প্রচলিত-স্বাভাবিক নিয়মেই বিদায় নিয়েছিলেন লিডারশিপ থেকে দল হেরে যাওয়ার পর। পরবর্তীতে ক্ষমতায় যাওয়ার পরও যেমন টোরি পার্টিতে লিডারশিপ সংকট থেকে যায়, ঠিক তেমনি এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি লেবার দলও।
ব্রেক্সিট ইস্যুতে কনজারভেটিভ দলে শেষ পর্যন্ত বরিস জনসন দলের নেতৃত্ব নিয়ে দেশটার প্রধানমন্ত্রী হয়ে দুটো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন। ব্রেক্সিট মোকাবিলায় তিনি সাফল্য এনেছেন। করোনাকালীন সময় তার ওপর মানুষ আস্তা রাখতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি জনগণের বিশ্বাসকে বারবার আঘাত করেছেন। এবং সর্বশেষ ক’দিন আগেও তিনি পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে গণমাধ্যম ও জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন তার মিথ্যা বলার কারণে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যদিনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, ট্যক্স বৃদ্ধি প্রভৃতিতে উঠেছে জনগণের নাভিশ্বাস। অথচ বরিস জনগণের কোনো কথাই শোনেন না, বরং বারবার মিথ্যা বলেন।
সবকিছু মিলিয়েই এবারে একটা ধাক্কা খেয়েছে বরিস জনসনের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি। বিশেষত লন্ডনের তিনটি কাউন্সিলের নেতৃত্ব হারানোর পর বহু উচ্চারিত হচ্ছে টোরির এ রাজনৈতিক ধস নিয়ে। ওয়েস্টমিনিস্টার কাউন্সিল ১৯৬৪ সাল থেকেই টোরির দখলে ছিল, ওয়ার্ল্ডসওয়ারথ ছিল ১৯৭৮ সাল থেকে এবং বার্নেটে এই প্রথমবারের মতো লেবার বিজয়ী হলো। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে লেবার দলের জন্য এ এক বিশাল জয়, অন্যদিকে বরিসের নেতৃত্বাধীন টোরির জন্য রীতিমতো ব্যর্থতার। যদিও ব্রিটেনের কিছু কিছু জায়গায় বিশেষত উত্তরাঞ্চলে লেবারের একটা মজবুত ভিতে পরাজিত না হলেও বড় ধরনের বিজয় নিয়ে আসতে পারেনি তারা। এমনকি স্টকপোর্ট কাউন্সিলে লেবার পার্টি নেতৃত্ব হারিয়েছে লিবারেল ডেমোক্র্যাটের কাছে। সব মিলিয়ে আনুপাতিক হারে লিবারেল ডেমোক্র্যাট বলতে গেলে ভালো করেছে। কারণ তৃতীয় অবস্থানে গিয়ে দলটি ৩টি কাউন্সিলে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে ব্রিটেনে এখন ১৬টি কাউন্সিলের নেতৃত্ব দেবে। আর লেবার দল মাত্র ৫টি কাউন্সিলে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে মোট ৭৪টি কাউন্সিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে কনজারভেটিভ দল ১১টি কাউন্সিলে নেতৃত্ব খুইয়ে তাদের ঝুলিতে আছে এখন মাত্র ৩৫টি কাউন্সিল।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ফলাফল হয়েছে বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে। এ এলাকা লেবার পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। অথচ একটা নবগঠিত ‘এস্পায়ার’ দলের কাছে লেবার পার্টি হেরেছে চরম অপমানজনকভাবে। এ কাউন্সিলে মোট কাউন্সিলরের সংখ্যা ৪৫। এবারে এই ৪৫ আসনের ২৪টিতেই বিজয়ী হয়েছে এস্পায়ার দল। এবং লেবার দল পেয়েছে ১৮টি, অথচ পূর্বে তাদের কাউন্সিলর সংখ্যা ছিল ৪০। অর্থাৎ টাওয়ার হ্যামলেটসেও লেবার দল তাদের নেতৃত্ব হারিয়েছে।
‘এস্পায়ার’ নামের এই দলটি ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এবং বিস্ময়টা এখানেই, আদালতের রায়ে এই দলটির প্রধান লুৎফুর রহমানকে ২০১৫ সালে নির্বাচনী আদালতে (ইলেকশন কোর্ট) ব্যক্তিগতভাবে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ওই বছরের ২৯ এপ্রিল তার দলটিও (টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট) রাজনৈতিক দলের মর্যাদা হারায়। একসময় লেবার দলের কাউন্সিলর-লিডার অর্থাৎ ক্যারিশমেটিক নেতা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল এবং লেবার দলের সঙ্গে মতভিন্নতার কারণে তিনি দল থেকে ছিটকে পড়েন। কিন্তু কমিউনিটি তথা টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষের কাছে তিনি তার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ঠিকই ধরে রেখেছিলেন এবং সেজন্যই তিনি লেবার দলের বাইরে গিয়ে ‘টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট’ নামের রাজনৈতিক দল গঠন করেও ২০১০ সালে টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হন। ৪ বছর তিনি সফলতার সঙ্গে এবারায় কাজ করে দ্বিতীয়বারও বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে লুৎফুর তার কর্মদক্ষতা দিয়ে নিজেকে কমিউনিটির একজন প্রধান প্রতিনিধি হিসেবেই একটা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
নির্বাহী মেয়র হিসেবে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন অভিযোগে তিনি বরখাস্ত হয়েছিলেন এবং বরখাস্ত হওয়ার পর কোর্টের নির্দেশনায়ই নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার ক্ষমতাও হারান। পরবর্তীতে লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডন হওয়ায় এবং কোর্ট নির্দেশনা শেষ হওয়ার পর তিনি এবারে আবারো প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নামেন। বিস্ময়করভাবে লেবার দলের মানুষগুলোই এবারেও লুৎফুরকেই ভোট দেন। কারণ এ নির্বাচনেও ‘দলের চেয়ে কমিউনিটি বড়’ এই বিবেচনায় তারা লেবারকে প্রকাশ্যেই ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছে এবং লেবার দলের প্রার্থী জন বিগসের চেয়ে ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে লুৎফুরকে জিতিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি তার দলের কাউন্সিলররাও ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
এই-ই হল টাওয়ার হ্যামলেটসের ভোটের মাঠ। এই মাঠের মানুষ এর আগেও একবার লেবার দলকে ভোট দেয়নি সংসদ নির্বাচনে। যখন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেধাবী নেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও লেবার দল এই সংসদীয় এলাকা থেকে বাংলাদেশি কাউকে মনোনয়ন দিতে বছরের পর বছর সময় নিচ্ছিল, তখন মানুষ বিদ্রোহী হয়ে উঠে। সে সময় জর্জ গ্যালওয়ে লেবার পার্টি ত্যাগ করে রেসপেক্ট পার্টি গঠন করে বেথনাল গিন-বো এলাকায় নির্বাচন করেন, তখন জনগণ তাকেই লুফে নেয়। কারণ তিনি বাঙালিদের হয়ে কথা বলেছিলেন। অভিবাসী মানুষদের সমর্থন নিয়ে গ্যালওয়ে নির্বাচিত হন সংসদ নির্বাচনে। বলতে গেলে তিনিই লেবার দলে বাংলাদেশিদের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। কারণ এর পর লেবার পার্টি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজনকেই বেছে নিতে বাধ্য হয় এবং এই পথ ধরেই দক্ষ একজন রাজনীতিবিদ রোশনারা আলী এমপি নির্বাচিত হন।
একজন অবাঙালি-অমুসলিম হয়েও জর্জ গ্যালওয়েকে সেই সময় মৌলবাদী আখ্যায়িত করা হয়েছিল। প্রগতিবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন কতিপয় মানুষ, যে আঁচড়টি লুৎফুরের গায়েও লেগেছে বারবার। কিন্তু জনগণ এই ‘অতি প্রগতি’বাদীদের তোয়াক্কা না করে কমিউনিটির স্বার্থটাই বেছে নেয়। কারণ লুৎফুর রহমানের গত দেড় টার্মের মেয়রকালীন সময়ে সত্যিই কমিউনিটির স্পন্দন বুঝে তিনি তার কাজ করে গিয়েছিলেন।
একইভাবে আমাদের বিশ্বাস, লেবার দল যদি টাওয়ার হ্যামলেটসে দলটির নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে আগামীর নেতৃত্ব মনোনয়নে মেধাবী বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের দিয়েই তা করতে হবে। তা না হলে লুৎফুর নিজেই এখানে একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। কাঠ-খড় পুড়িয়েও লেবার দল আগামী মেয়র নির্বাচনে সহজে জয়ী হতে পারবে না। সোজা কথায় বৈষম্যের রাজনীতি দিয়ে তার থেকে নেতৃত্ব ফিরিয়ে নেয়া যাবে না।