এ লেভেল বাংলার চিত্র আরো ভয়াবহ। একিউএ এর অধীনে ২০২১ সালে কেবল একজন শিক্ষার্থী এ লেভেল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত কোনো সেন্টার এ লেভেল বাংলার জন্য কোনো এন্ট্রি পাঠায়নি। যা সত্যিই শিক্ষকসহ বাংলা ভাষা প্রেমীদের শংকিত করে তুলেছে।
আমি মনে – প্রাণে বিশ্বাস করি, মাতৃভাষা জানা ছাড়া যথার্থ শিক্ষা অর্জন মোটেও সম্ভব নয় । একটি জাতির সর্বাঙ্গীন ইতিহাস, প্রগতি কেবলমাত্র ভাষাই যুগযুগ ধরে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। নিজের মধ্যে ভাবের আদান – প্রদান তো বটেই, পাশাপাশি সমগ্র একটি জাতির আদব – কায়দা, ভালো – মন্দের ইতিহাসও রচিত হয় ভাষার মাধ্যমেই।ভাষা শিক্ষা মানুষের প্রাচীন ইতিহাস থেকেই জ্ঞান অর্জনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পথ হিসেবে স্বীকৃত। মাতৃদুগ্ধ ছাড়া শিশুর সার্থক বিকাশ যেমন সম্ভব নয়, তেমনিই মাতৃভাষা ব্যতীত উপযুক্ত শিক্ষা অসম্পূর্ণ। তাই বিশ্বের যে কোনও প্রগতিশীল জাতির মধ্যেই মাতৃভাষার প্রতি কদর বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কিংবা দ্বিপাক্ষীক সভায় জার্মানী, রাশিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের মাতৃভাষায় বক্তৃতা দিতে বা কথা বলতে দেখি। প্রতিপক্ষকে নিজের বক্তব্য বা কথা বুঝিয়ে দিতে তাঁরা দোভাষীর আশ্রয় নেন। তার মানে এই নয় যে, তাঁরা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারেন না। বরং তাঁরা বোঝেন নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলা অমর্যাদাকর। কারণ এর ফলে অন্য জাতির প্রতি অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দাসত্বের সূচনা হয়।
অথচ বাংলাদেশের ভাষা চিত্রের চেহারায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে । আমরা এখন বাংলা বলার সময় ইংরেজি শব্দের অহেতুক ব্যবহারকে জাতে ওঠার একটি উপায় হিসেবে ধরে নিয়েছি। প্রয়োজন ছাড়া কথার মধ্যে ইংরেজি বলাটা এক ধরণের স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। বাংলার মধ্যে ইংরেজি প্রবেশ করে ভাষাটা ক্রমশই হয়ে উঠেছে “বাংলিশ”এ। ফলে না পারছি ভালোভাবে বাংলা শিখতে, আবার না পারছি ইংরেজি রপ্ত করতে। আমি ইংরেজি ভাষা অথবা অন্য কোনো ভাষা শেখার বিরোধী নই। আমি বলতে চাইছি যে, আমাদের সর্বপ্রথমে নিজের মাতৃভাষা শেখা উচিত এবং শুদ্ধ উচ্চারণে তা প্রয়োগ করা দরকার। মাতৃভাষা পুরোপুরি আয়ত্ত করতে না পারলে অন্য ভাষা শুদ্ধভাবে শেখা যায় না। প্রবাসে বসে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল গুলোতে যখন সংবাদ বা টক শো দেখি, তখন প্রায়ই মনটা খারাপ হয়ে যায়। যখন দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষকদের অনেকেই, কিংবা সংসদ সদস্য থেকে বেশিরভাগ মন্ত্রী অথবা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ সচিব অশুদ্ধ উচ্চারণে বাংলায় কথা বলছেন। ফলে তাদের ইংরেজির দৌরাত্ম নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায় ! শুনেছি বাংলাদেশের চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় এবং আমলাতান্ত্রিক কাজে ইংরেজিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। আর সে কারণেই নতুন প্রজন্মের তরুণ – তরুণীরা মাতৃভাষার পরিবর্তে ইংরেজির প্রতি ঝুঁকছে। ধরে নিলাম বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইংরেজি ভাষায় অতিমাত্রায় পারদর্শী। তাহলে প্রশ্ন জাগে, ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সাড়াজাগানো সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতি অথবা অংকশাস্ত্রের কয়টি বই এযাবৎ বাংলায় অনুবাদ করা সম্ভব হয়েছে? সত্যি বলতে কি উল্লেখ করার মতো আজও পর্যাপ্ত সংখ্যক বই বাংলায় অনূদিত হয়নি। তাই বিশ্বাস করি, বই – পুস্তক ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার আগে আমাদের মাতৃভাষা “বাংলাকে”পুরোদমে আত্বস্থ করা দরকার। ইংরেজি প্রীতি মোটেই দোষের কিছু নয়। তবে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে কথায় কথায় অহেতুক ইংরেজি প্রেম প্রদর্শন অন্তত বাংলা ভাষা- ভাষীদের ঠিক মানায় না।
আমরা অনেকেই জানি, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই বিলেতে এসেছিলেন ইংরেজি ভাষায় লিখে তাঁর সাহিত্য কর্মকে বিশ্বসভায় ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু বাংলা, বাঙালি এবং দেশের মাটির টানে শেষ পর্যন্ত তিনিও দেশে প্রত্যাবর্তন করে বাংলা ভাষায় নিজের সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কারণ তিনি প্রবাসে থেকে মাতৃভাষার গুরুত্ব হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বর্তমানে ব্রিটেন প্রবাসী বেশিরভাগ বাঙালি মাতৃভাষাকে কতখানি ভালোবাসেন বা তাঁদের কাছে মাতৃভাষার গুরুত্ব কতোটা, তার একটি নমুনা এখানে পেশ করছি। আমি দুই দশকের অধিক সময় ধরে একিউএ এক্সাম বোর্ডের সঙ্গে কাজ করছি। ১৯৯০ এর দশকে একিউএ এক্সাম বোর্ডের অধীনে প্রায় চার হাজার বাংলা ভাষী ছাত্র – ছাত্রী বাংলা জিসিএসই পরীক্ষায় অংশ নিতো। ২০২১ সালে বাংলা জিসিএসই পরীক্ষায় ছাত্র – ছাত্রীদের এন্ট্রি সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচশোর মতো । একিউএ সূত্রে জানতে পেরেছি যে, আসন্ন ২০২২ সালের গ্রীষ্মকালীন জিসিএসই পরীক্ষায় এন্ট্রি সংখ্যা গত বছরের তুলনায় আরো কমে সাড়ে তিনশোর কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রতি বাঙালি নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অনীহা কতখানি বেড়েছে। একই সঙ্গে ব্রিটেনের মূলধারার স্কুল- কলেজে বাংলার প্রতি কর্তৃপক্ষের বিরূপ মনোভাব বর্তমানে বাংলা ভাষা প্রসারে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি সুকৌশলে কর্তৃপক্ষ স্কুল – কলেজের পাঠক্রম থেকে বাংলাকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। গুরুত্ব দিচ্ছে স্প্যানিশ বা ফ্রেঞ্চ এর মতো অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষাকে। উদাহরণস্বরূপ এক সময় টাওয়ার হ্যামলেটস্ এর প্রায় সব কটি মূলধারার সেকেন্ডারি স্কুলে বাংলা ভাষা পড়ানো হতো। এখন মাত্র সাতটি স্কুলে স্কুলের পাঠক্রম বাংলা ভাষা শেখানো হয়। আবার এদের মধ্যে মাত্র দুটি সেকেন্ডারি স্কুলে ইয়ার সেভেন থেকে জিসিএসই পর্যন্ত বাংলা পড়ানো হচ্ছে। বাকি স্কুলগুলোতে হয় ইয়ার সেভেন ও ইয়ার এইটে বাংলা পড়িয়ে ছাত্র – ছাত্রীদের জিসিএসই পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো স্কুলে বাংলা বিষয় অফার করা হচ্ছে ইয়ার নাইন থেকে ইয়ার ১১ পর্যন্ত। অর্থাৎ ইউরোপীয় ভাষার শিক্ষার্থীরা যেখানে পাঁচ বছর সময় পাচ্ছে ভাষাটাকে আত্মস্থ করতে, সেখানে বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীরা সময় পাচ্ছে দুই থেকে তিন বছর। এ লেভেল বাংলার চিত্র আরো ভয়াবহ। একিউএ এর অধীনে ২০২১ সালে কেবল একজন শিক্ষার্থী এ লেভেল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত কোনো সেন্টার এ লেভেল বাংলার জন্য কোনো এন্ট্রি পাঠায়নি। যা সত্যিই শিক্ষকসহ বাংলা ভাষা প্রেমীদের শংকিত করে তুলেছে।
জনসংখ্যার ভিত্তিতে বর্তমানে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দশটি ভাষার একটি হলো বাংলা। বাংলার স্থান ষষ্ঠ। অন্যদিকে ব্রিটেনে শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি ভাষার একটি বাংলা। লন্ডনে ইংরেজির পরেই বাংলার অবস্থান। তাহলে বাংলার কেনো এমন বেহাল দশা? বাঙালি কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ, বাঙালি সংগঠনগুলো, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপিরা, ব্রিটেনে বাংলাদেশ হাই কমিশন, ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ পদে কর্মরত বাঙালিরা, বাংলা মিডিয়াগুলো এবং সর্বোপরি বাঙালি মা – বাবা, অভিভাবকগণের কাছে কি এর কোনো জবাব আছে? ভাষার মাস ফেব্রুয়ারী এলেই আমরা ভাষাদরদী হয়ে জেগে উঠবো আর বাকি এগারো মাস ঘুমিয়ে থাকবো তাতো ঠিক নয়। ভুলে গেলে চলবে না, একটি ভাষার যত্ন আর সংরক্ষণ ব্যর্থ হলে একটি মানবগোষ্ঠীর সঞ্চিত জ্ঞান ও শিল্প – সংস্কৃতিরও বিলুপ্তি ঘটে। তাই আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা থেকে একদম মুখ ফিরিয়ে নেয়ার আগে এবং বাংলা ভাষা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পূর্বেই কিভাবে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের সন্তানদের আকৃষ্ট করা যায় এবং স্কুল – কলেজের পাঠক্রমে আবারো বাংলাকে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের এখনই সময়। আমার মতে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তা ব্যক্তিদের চোখে চোখ রেখে আমরা যতদিন কথা বলার ক্ষমতা অর্জন না করবো, ততদিন আমাদের দাবী বা অধিকার আদায়ের আন্দোলন কোনোক্রমেই সফল হবে না। আর সে জন্য ব্রিটিশ অর্থনীতিতে বাঙালিদের অবদানকে সবার নজরে পড়ার মতো পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। কারণ আমরা জানি ব্রিটিশ অর্থনীতিতে ইহুদি কমিউনিটির দুর্দান্ত প্রতাপের কারণে আজ তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সরকারকে নাকানি – চুবানি খাওয়াতেও কোনোরকম তোয়াক্কা করে না।
অধুনা আমি বেশ ক’জন বাংলা ভাষার শিক্ষক, অভিভাবক, কমিউনিটি নেতা, সাংবাদিক এবং শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ করে জানার চেষ্টা করেছি কিভাবে প্রবাসে আমাদের সন্তানদের বাংলা ভাষামুখী করে তোলা যায়। অর্থাৎ বাংলাভাষাকে কিভাবে তাদের মধ্যে জনপ্রিয় করা যায়।তাঁদের পরামর্শগুলো নিচে উপস্থাপন করা হলো:
– আমাদের সবাইকে আঞ্চলিক ভাষার উপর জাতীয় ভাষা, বাংলাকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে সালাম, রফিক, বরকত ও জব্বারসহ নাম না জানা ভাষা সৈনিক আঞ্চলিক ভাষার জন্য নয়, বরং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢাকার রাজপথে ঢেলে দিয়েছিলেন।
– ব্রিটিশ অর্থনীতিতে বাংলাদেশীদের অবদানকে চোখে পড়ার মতো অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। যাতে সরকার বাংলাদেশীদের দাবী – দাওয়া মানতে বাধ্য হন। আমাদের প্রাণের সংগঠন “বাংলাদেশ ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন এবং ” ব্রিটিশ – বাংলাদেশী চেম্বার অব কমার্স ” এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
-স্কুল, কলেজের পাঠক্রমে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মা – বাবা ও অভিভাবকদের হেডটিচারদের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।
– বাড়িতে আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা চর্চা করতে হবে। সন্তানদের বাংলা নাটক, বাংলা ছায়াছবি, বাংলা গান বা ধর্মীয় বিষয়ের অনুষ্ঠান দেখতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কেনো মাতৃভাষা জানা দরকার তাদের তা বোঝাতে হবে।
– ফ্রেঞ্চ বা স্প্যানিশ যে ভাবে পোড়ানো হয়, বাংলা ভাষার শিক্ষকদের তা অনুসরণ করতে হবে। কেবল পাঠ্য বইয়ের উপর নির্ভর না করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলা শিক্ষা দিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে জিসিএসই বাংলা এবং বাংলা এ লেভেল করলে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা কমবে না। যা মা – বাবাদেরও বোঝা উচিত।
– স্কুলে ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশ এর মতো বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীদের জন্যও ট্রিপের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাংলার জন্য সমান সুযোগ – সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা দেখতে পায় যে, স্কুল বাংলাকে খাটো করে দেখছে না।
– এক্সাম বোর্ডকে প্রশ্নপত্র তৈরী করার সময় আরো নমনীয় হতে হবে। কারো কারো মতে, নতুন সিলেবাসের অধীনে বাংলা প্রশ্ন পত্র বেশ কঠিন। ফলে শিক্ষার্থীরা বাংলায় পরীক্ষা দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
– প্যারেন্টস এসোসিয়েশনগুলিকে আরো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু প্যারেন্টস গভর্নর হলেই চলবে না। জবাবদিহিতা আদায় করার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে।
– বাংলা ভাষাকে স্কুল – কলেজে টিকিয়ে রাখার আন্দোলনকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। অনেকের মতে “ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন” চালাতে হবে। শুধু “রিজিওনাল ক্যাম্পেইন” করে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
– বাংলা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়াকে বাংলা ভাষার প্রসারে আরো তৎপর হতে হবে।
– হাউজ অব লর্ডসে এবং হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রতিনিধিদের স্কুল – কলেজের পাঠ্যক্রমে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোড় লবিং চালাতে হবে। ব্রিটিশ রাজনীতি এবং “পলিসি মেকিং প্রসেস” এ বাংলাদেশীদের অংশ গ্রহণ বাড়াতে হবে।
– ব্রিটেনে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে “অফকল”, “ডিএফই ” এবং “একিউএ” এক্সাম বোর্ডের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। প্রবাসে নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের জন্য মাতৃভাষা জানা কেনো অপরিহার্য তা হাইকমিশনকে তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে।
– টাওয়ার হামলেটসসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থানে বন্ধ হয়ে যাওয়া “মাদার টাং প্রজেক্টকে” আবারো চালু করতে জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন চালাতে হবে।
– আজকাল স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষার শিক্ষক অবসরে গেলে শিক্ষক স্বল্পতার অজুহাত দেখিয়ে কারিকুলাম থেকে বাংলাকে মুছে ফেলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের এই ষড়যন্ত্র রুখতে আমাদের উচিত বাংলা ভাষার শিক্ষক তৈরি করা এবং একই সাথে বাংলা পড়ানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্য স্কুলগুলোকে বাধ্য করা।
– শিক্ষার্থীদের পঞ্চাশটি বর্ণমালা আর দশটি স্বরচিহ্ন শিখতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। তিনটি “স” ধ্বনি (স, শ, ষ ), দুটি “ন” ধ্বনি (ন, ণ), তিনটি “র ” ধ্বনি (র,ড়,ঢ়), তিনটি “জ ” ধ্বনি(জ, ঝ,য) শিখতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা খেই হারিয়ে ফেলে। তার উপর “ক আর খ”, “চ আর ছ”, “ব আর ভ”,”প আর ফ” এর সঠিক উচ্চারণ শিখতে তারা প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া যুক্তাক্ষরের অত্যাচারতো রয়েছেই। বাংলাদেশ হাইকমিশনের উচিত প্রবাসী নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় এনে এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির সাথে আলোচনা করে এধরণের সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা। শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষা শিক্ষাকে আরো সহজতর করা।
গর্বের বিষয় হলো এখন “সোয়াস”, “কিংস কলেজ”, “ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়”, ” অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ” এবং “কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ” বাংলা ভাষা শেখার জন্য বিভিন্ন ধরনের কোর্স অফার করছে। আমরা যদি জিসিএসই ও এ লেভেল পর্যায়ের পরীক্ষায় ছাত্র – ছাত্রীদের এন্ট্রি সংখ্যা বৃদ্ধি করতে না পারি, তাহলে এমন একটা সময় আসবে যখন প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থীদের অভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলা ভাষা থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিবে। তাই আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কি আমাদের সন্তানদের বাংলিশ ভাষায় কথা বলার জন্য অনুপ্রাণিত করবো, নাকি ইংরেজি বলার পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতেও উদ্বুদ্ধ করবো। উল্লেখ্য ভাষা হলো জাতিগত পরিচয়, সামাজিক সম্পর্ক, যোগাযোগ এবং মানব সমাজের উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম। অতীত ও ভবিষ্যতের সাথে সেতু বন্ধন রচনার মাধ্যম হলো ভাষা। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, প্রবাসে থেকেও আমাদের ছেলে – মেয়েরা যেনো পুরোদমে বাঙালি হয়ে উঠতে পারে তা বাস্তবে রূপ দিতে এবং স্কুলগুলোর পাঠক্রম থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাওয়া বাংলা ভাষা পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হাউস অব লর্ডস আর হাউস অব কমন্সের সদস্যসহ নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী, এমবিই, এফআরএসএ, এফআরএএস ।