বিশাল ব্যবসা হলো এখানে চিকিৎসা। আধুনিক ক্লিনিক হয়েছে, গজিয়ে উঠেছে নতুন ডায়াগনসিস সেন্টার, ডাক্তাররা আসেন রাজধানী থেকে, ফার্মেসির সামনে থাকে লম্বা লাইন। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ফতুর হয়ে যাচ্ছে শুধু চিকিৎসকদের দেয়া ‘টেস্ট’গুলো করাতে। ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করেন এমন একজন ব্যবসায়ী নিজেই বললেন, আমি যখন ডাক্তার দেখি, তখন আর পুলিশের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ থাকে না।
গত ক’বছর থেকেই শোনছি, নয়া ব্যবস্থায় দেশের জমি-জিরাতের পিতৃসম্পত্তি পেতে হলে যে কোনো প্রবাসীর অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সনদ বা আইডি থাকতে হবে। সনদ না থাকলে যদি কোনো সময় দুঃখজনকভাবে জমি-সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমায় কেউ জড়িয়ে যান, তাহলে তাকে বেগ পেতে হবে এসব ছোট-বড় সম্পত্তি রক্ষায়। নাগরিক সনদের ব্যাপারটাতে যুক্তি আছে নিঃসন্দেহে, কারণ কোনো না কোনোভাবে মাটির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততাকে অবশ্যই প্রমাণ করা প্রয়োজন, না হলে যে কেউ এ নিয়ে জট পাকাতে পারে।
কিন্তু কথা হলো, দেড় কোটিরও বেশি প্রবাসী যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন পৃথিবীর দেশে দেশে, যারা দেশে ছুটি কাটাতে যান স্বল্প সময়ের জন্য, তারা এসব সনদ বের করতে গিয়ে পড়েন বিপাকে। কারণ বর্তমানে নাগরিকদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি), সেটি বের করতে কিছুটা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়, যা করতে গিয়ে অনেকের ছুটি শেষ হয়ে যায়, তারপরও প্রসেসটা শেষ করা যায় না। অফিসারদের কাছে ধরনা দিতে হয় এবং অর্থও খসে। প্রবাসী বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকা-যুক্তরাজ্য তথা যারা বিভিন্ন দেশে স্থায়ী অভিবাসী হয়েছে, তাদের জন্য আইডি কার্ডটা বের করা সবচেয়ে জরুরি, কারণ ভিন দেশে অভিবাসী হওয়া বাংলাদেশিদের পাসপোর্টটা সে দেশেরই হয়ে যায়। অন্যদিকে স্থায়ী অভিবাসী যারা নন, তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গর্ব করার মতো বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকে, সেজন্য তাদের ঝক্কি-ঝামেলা এক্ষেত্রে কম। আর সেজন্য বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশি মিশনগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ ব্যাপারটা অর্থাৎ জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের কাজটা হাতে নিলে অভিবাসী তথা প্রবাসী মানুষগুলো বড় ধরনের উপকার পাবে এবং মিশনগুলো এ থেকে সরকারের নির্ধারিত পাওনাগুলোও পাবে।
২) আমি ব্যক্তিগতভাবে এবারে জাতীয় পরিচয়পত্রটি নিতে উদ্যোগী হই। এর আগে ম্যানচেষ্টার সহকারী হাইকমিশন থেকে ডিজিটালাইজড জন্ম সনদপত্র ও বাংলাদেশি পাসপোর্টটাও করেছি। যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্র হাইকমিশন দিচ্ছে না, সেহেতু যা কিছু প্রয়োজন তা আমার স্থানীয় পৌরসভা (বিয়ানীবাজার) থেকে সব কিছু মাত্র একদিনেই শেষ করি। অফিসার ছুটিতে থাকায় ৫ দিন আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। যেদিন তিনি ছুটি থেকে আসেন, সেদিনই বিয়ানীবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র উপজেলা নির্বাচন কমিশনে নিজে উপস্থিত থেকে প্রয়োজনীয় প্রসেস শেষ করতে সহযোগিতা করায় ছবি তোলা এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট আধা ঘণ্টার মধ্যেই শেষ করতে পারি। পরিচয়পত্রটি এখনো পাইনি, তবে এটি পাওয়া যাবে এ বিশ্বাস আমার আছে। কারণ পরিচয়পত্রটি স্মার্টকার্ড হিসেবে পৌরসভায়ই আসবে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র। তাছাড়া অনলাইনে ট্রাক করা যাচ্ছে আইডি কার্ডের আপডেট, যদিও আমার আইডিটা এখনো অনলাইনে আসেনি। এখানে উল্লেখ করতে চাই, আইডি সংশ্লিষ্ট কিছু প্রমাণাদির কাগজ বের করতে গিয়ে আমি যেমন সমস্যায় পড়িনি, ঠিক তেমনি পৌরসভার অভ্যন্তরে সার্ভিস গ্রহীতাদের কোনো হা-হুতাশ করতে দেখিনি। অসন্তুষ্ট হয়ে কোনো রুঢ় বাক্য ব্যয় করতেও দেখা যায়নি কাউকে।
৩) গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলেছিল, সাময়িক হিসেবে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। তবে ৮ ফেব্রুয়ারি পাওয়া গেল চূড়ান্ত হিসাব। এ অনুযায়ী, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা। অর্থাৎ নভেম্বরে যে হিসাব ছিল, তার চেয়েও বেশি।
এ হিসাবটাই মিলাতে থাকলাম আমার এলাকায়। এ এলাকাটা প্রবাসী অধ্যুষিত। ইউরোপ-আমেরিকা-যুক্তরাজ্য এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে আছে এ এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ। সে হিসেবে ইউরো-ডলার-পাউন্ড-রিয়াল হিসেবে এলাকার মানুষগুলোর মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে মানুষের যে সামঞ্জস্য আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আমি রাত পোহাবার পর বাসা থেকে বেরুলে প্রথমেই যে মানুষগুলোকে দেখি, এদের অধিকাংশই এ এলাকার না। শ্রমজীবী মানুষগুলো এসেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। এই এলাকারও মানুষ আছেন, কাজ করছেন তবে স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। যেহেতু এলাকা বিদেশি অধ্যুষিত, সেহেতু এখানে কাজ করতে আসা মানুষগুলো বেকার বসে থাকে না। কাজ আছে এবং পারিশ্রমিকও পাচ্ছেন। তবে এলাকাটাকে আমি আমার কৈশোর এমনকি যুবক বেলার সঙ্গে যেন মেলাতে পারি না। সিলেট শহরের মতো মাইলব্যাপী ট্রাফিক জ্যামে পড়তে হয় আমাদের। সেই গ্রাম, সেই কোলাহল এখন আর নেই। শহরে গড়ে উঠেছে বিশাল সব প্রতিষ্ঠান। বাসা-বাড়িতে বাইরের অঞ্চলের মানুষ ভাড়া থাকে, এখানকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারো-লাখো ছাত্রছাত্রী এই উপজেলায়।
বিশাল ব্যবসা হলো এখানে চিকিৎসা। আধুনিক ক্লিনিক হয়েছে, গজিয়ে উঠেছে নতুন ডায়াগনসিস সেন্টার, ডাক্তাররা আসেন রাজধানী থেকে, ফার্মেসির সামনে থাকে লম্বা লাইন। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ফতুর হয়ে যাচ্ছে শুধু চিকিৎসকদের দেয়া ‘টেস্ট’গুলো করাতে। ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করেন এমন একজন ব্যবসায়ী নিজেই বললেন, আমি যখন ডাক্তার দেখি, তখন আর পুলিশের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ থাকে না। প্রসবকালীন অস্ত্রোপ্রচার ডাল-ভাতের মতো। অথচ ব্রিটেনের মতো জায়গায় তা নিতান্তই শুধুমাত্র প্রয়োজন হলেই হয়। স্বল্প আয়ের ওপর নির্ভরশীল একটা বিশালসংখ্যক মানুষ তথা মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর হাতে সঞ্চয় নেই- জাতীয় আয়ের সঙ্গে তারা নিজেদের কি মেলাতে পারছে? তবে প্রশাসনে বসে থাকা সরকারি চাকরিজীবীদের স্বস্তি আছে। এদের আয়ের উৎস বোঝা যায় সাধারণ মানুষের বিভিন্ন অভিযোগ শোনলে।
৪) কিছু মানুষকে দেখেছি, তাদের দৃশ্যমান কোনো কাজ নেই। হয়তো আছে রাজনীতির তকমা। তাদের জীবনাচার চোখ ধাঁধায়। কেউ একসময় ছোট্ট ব্যবসা করত, এখন সে ব্যবসাও নেই, তবে আছে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি, জনপ্রতিনিধি হবার খায়েস। শোনেছি তাদের নাম আছে টেন্ডারে, কন্ট্রাক্টরি পেশায়। যে কলেজে আমরা পড়তাম একসময়, সেটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়। টিনশেডের ঘরে ক্লাস নিয়েছেন আমাদের শিক্ষকরা। এখন বহুতল ভবন সারা ক্যাম্পাসজুড়ে। হচ্ছে ১০ তলা বিশাল ভবন। সাড়ে তিনশ ছাত্র ছিল আমাদের সময়, সেখানে আট-দশ হাজার ছাত্র, কলেজ হয়েছে কয়েকটা ইউনিয়নে। কিন্তু ক্যাম্পাস শূন্য, খাঁ খাঁ করছে। অনেক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করছি সংগঠন থেকে কি কোনো ম্যাগাজিন বেরিয়েছে ইদানীং। মনে হয় আকাশ থেকে পড়েছে ওরা। জানেই না তারা এসব। সংস্কৃতি বলতে মোবাইল ফোনে টিপ দেয়া। সেই তালেই বেড়েছে মাদ্রাসা। সেভাবেই আছে অন্য ধর্মের ‘ইসকন’র প্রভাব। সেখানেও বেড়ে উঠছে একটা ধর্মীয় শ্রেণি। এলাকায় ধর্মীয় বিদ্বেষ নেই। কিন্তু তলে তলে একটা প্রতিযোগিতা তৈরি করা হচ্ছে, যা মোটেও সুখকর নয়। রাজনীতিতে আছে দারুণ শূন্যতা। সারাদেশের মতোই। পারস্পরিক বিদ্বেষ, দলীয় গ্রুপিংয়ে নতজানু ক্ষমতাসীন দল। মেয়র নির্বাচন আসছে। এ দলেরই আছে ডজনখানেক প্রার্থী শুধু মেয়র পদে। উড়ে আসছে ইউরোপ আমেরিকা থেকে প্রার্থীরা। অর্থও উড়বে এখানে যাচ্ছেতাই। দল-উপদলে বিভক্ত এখানকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হয়েছে এই দলটির ভরাডুবি। এই ভরাডুবির পেছনে নেতৃত্বের অর্থ লেনদেন প্রধান কারণ বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই। অর্থাৎ যোগ্য প্রার্থীরা মনোনয়ন পাননি এমনকি কয়েকজন ভালো প্রার্থী তৃণমূলের ভোটে মনোনয়ন পাওয়ার পরও না-কি শেষ মুহূর্তে তাদের মনোনয়ন খুইয়েছেন।
উপজেলা কেন্দ্রে আছে একটা ঐতিহ্যবাহী পাবলিক লাইব্রেরি। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ পাঠাগারটি আমাদের যৌবনের দিনগুলোর একটা বড় অংশজুড়ে আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো সময়। বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতির আলোয় টিমটিম করত আর গমগম করত আড্ডা। সেই পাঠাগারটিও এখন বিশাল অট্টালিকা। প্রবাসীদের বিশেষত যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের উদ্যোগেই এটা সংস্কার করে নতুন অত্যাধুনিক পাঠাগার হয়েছে। এখানে আছে অনেক দুর্লভ বই। সারি সারি কম্পিউটার বসানো, নিচের তলায় কনফারেন্স হল। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু নেই কোনো পাঠক। সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ দু’তিনজন মানুষ এটি এখন দেখাশোনা করেন। দুদিনই গেলাম। কিন্তু নেই কোনো পাঠক। এখন একজন লাইব্রেরিয়ানও আছেন। কিন্তু কেউ যেন যেতে চায় না বই উল্টে দেখতে। কী এক সর্বগ্রাসী সংস্কৃতি বিমুখিনতা! এর মাঝেও ভালো খবর উঁকি দেয়। উপজেলা কেন্দ্রে বালকদের স্কুলের প্রয়োজনীয়তা থাকায় এবারে আরেকটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে একঝাঁক তরুণ। জায়গা না থাকায় এই লাইব্রেরিতেই তারা ক্লাস শুরু করেছেন।
উপজেলা হিসেবে নিঃসন্দেহে এটা একটা সমৃদ্ধ এলাকা। কিন্তু এই সমৃদ্ধতায়ও আছে তরুণদের মাঝে এক হা-হুতাশ। ইউরোপ-ইংল্যান্ড-আমেরিকা যেন এদের হাতছানি দেয় প্রতিনিয়ত। মাত্র ক’দিন হয় অবস্থান করছি সেই মায়াঝরানো মাতৃভূমে। এর মাঝে জেনেছি, শত-সহস্র ছাত্রছাত্রী চলে গেছে এই দেশগুলোতে। অভিবাসী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে দক্ষ হওয়ার সনদ নিতে ভিড় করছে ইংরেজি শেখার প্রতিষ্ঠানে। উপজেলা কেন্দ্রে এরকম ৬টি প্রতিষ্ঠান আইইএলটিএস (ওঊখঞঝ) কোর্সটা করায়। তাদের ব্যস্ততা অর্থাৎ ব্যবসায় ফুসরত নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে কিউ লেগে আছে তরুণ-তরুণীদের। মোটামুটি ভালো শিক্ষার্থী যারা কোর্স শেষ করছে, তারা ভাগিয়ে নিচ্ছে ছাত্রভিসা আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডের। পালাচ্ছে তারুণ্য। এমনকি চাকরি ছেড়েও যাচ্ছে কেউ কেউ। তারা নাকি পেরে উঠছে না প্রতিযোগিতায়, তাই তাদের পালিয়ে যাওয়া অর্থনৈতিকভাবে আরো ভালো কিছুর প্রত্যাশায়।
এভাবেই শ্রেণি-দ্ব›দ্ব বাড়ছে- একটা শ্রেনি উঠছে বড় দ্রুত। একটা শ্রেণি নিঃশেষ হচ্ছে না যদিও, তবে জাতীয় আয়ের হিসাবের সঙ্গে এদের কোনোই মিল নেই।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম।
আরও পড়ুন-