ফেব্রুয়ারি মাস এলে মনে পড়ে বাংলা ভাষার বিশ্ব জয়ের কথা! ফেব্রুয়ারি এলে পলাশ-শিমূল-এর রঙে রঙিন হয় বাঙালির মন! ফেব্রুয়ারি এলে মনে পড়ে সালাম- রফিক-জব্বার-বরকতদের কথা! কারণ, তাঁদের আত্মাহুতির মাধ্যমে বাংলা ভাষা নতুন করে পেয়েছিল প্রাণ! পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারি ভাষা কী হবে, এই প্রশ্নে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছিল অগ্নিগর্ভ! পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক বর্গের দূরভিসন্ধি প্রকাশ হতেই সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হল তীব্র অসন্তোষ! এই পূর্ব-পাকিস্তানই এক সময় পরিচিত ছিল পূর্ববঙ্গ নামে।
১৯০৫ সালে তথাকথিত বঙ্গভঙ্গ-এর ফলে পূর্ববঙ্গ ব্রিটিশ শাসক বর্গের যে আনুকূল্য লাভ করেছিল, সেই স্বর্ণ যুগ বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। মাত্র ছয় বছরের মাথায় বঙ্গভঙ্গ রদ হল! কিন্তু এই সাকুল্যে ছয় বছরই পূর্ববঙ্গের চাষাভুসোর চোখ-কান খুলে দিতে সক্ষম হয়েছিল! “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” নামক নব্যসৃষ্ট প্রদেশ শিক্ষাদীক্ষায় এমন অভাবনীয় উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল, যাকে পূর্ববঙ্গের ‘নবজাগরণ’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র -এর ভ্রূণ সেদিনই সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল সবার অলক্ষ্যে! পূর্ববঙ্গ ও আসামের ছোটোলাট বামফিল্ড ফুলারের আকস্মিক পদত্যাগ ও লর্ড কার্জনের বদলি পূর্ববঙ্গের মুসলিম রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবিদের ভাবতে বাধ্য করেছিল কংগ্রেসের প্রতিস্পর্ধী একটি সমান্তরাল সংগঠন সৃষ্টির! ফলস্বরূপ, ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হল “মুসলিম লিগ”-এর। সেই মুসলিম লিগই কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করে এক পর্যায়ে আদায় করে নিয়েছিল পাকিস্তান! কিন্তু সেই পাকিস্তানও বেশি দিন টিকতে পারেনি।
বঙ্গভঙ্গ রদের পর বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রদত্ত স্বান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে পূর্ববঙ্গের জন্য একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বরাদ্দ হল। আর সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য লাগাতার চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহসহ অন্যান্যরা। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নবাব সলিমুল্লাহ তিন শত একর জমি দান করেছিলেন। সঙ্গে বিপুল নগদ অর্থ। উল্লেখ্য, নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন উর্দুভাষী। মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
১৯৫২ সালে যখন বাংলা ভাষা বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন সলিমুল্লাহ পরলোকগত। এই ক্রান্তি-লগ্নে রুখে দাঁড়িয়েছিল সলিমুল্লাহর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গের জনগণের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বুকের রক্ত ঢেলে তা প্রতিহত করেছিলেন অকুতোভয় সালাম-জাব্বার-রফিক-বরকতরা। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদের পরিপূরক হিসেবে, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদিন ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হল! ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবার হলে রাজা পঞ্চম জর্জ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম” নামক প্রদেশটি বাতিল করলেন বটে।
কিন্তু ১৯৭১ সালে সেই মুহূর্তটি বলতে গেলে বুমেরাং হল! ১৯১১ সালে প্রবল আন্দোলনের চাপে বঙ্গভঙ্গ রদ না-হলে ভাষার নামে, ধর্মের নামে নষ্টামি, গুণ্ডামি করার অবকাশ হয়তো হত না। কলকাতার বাঙালি হিন্দু প্রাগ্রসর শ্রেণি যদি সেদিন আপস করতে এগিয়ে আসতেন, “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” প্রদেশটি মেনে নিতেন, তাহলে, কলকাতা আজও ভারতবর্ষের রাজধানী হিসেবে থাকত! বাঙালি আধিপত্য দেখাতেন সর্বত্র! কিন্তু আত্মঘাতী প্রাগ্রসর বাঙালি হিন্দু তা অনুধাবন করেননি! তাঁরা একচোখা হরিণের মতো শুধু বঙ্গভঙ্গ-ই দেখেছিলেন! দেশভাগ দেখেননি!
মুজিব স্বদেশি: কবি ও লেখক,আসাম।