হোম গ্রাউন্ড কাকে বলে আমার জানা নাই, দেশের কোন মাঠে বসে খেলা দেখার সৌভাগ্য এখনো হয় নি । কিন্তু আজ ট্রেন্ট ব্রিজ নটিংহ্যামে অস্ট্রেলিয়ার বিপরীতে বাংলাদেশের খেলায় পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে বাঙালীদের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছে হোম গ্রাউন্ডও এরচেয়ে সরব, প্রাণবন্ত হয় না। পুরো স্টেডিয়ামের প্রায় নব্বই পঁচানব্বই শতাংশ দর্শক ছিল বাংলাদেশি কিংবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এই প্রথম বাংলাদেশের খেলা সরাসরি দেখা হলো, এ এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। খেলার ফলাফল হয়তো কাঙ্ক্ষিত হয় নি । তবু আফসোস করছি না । কারণ বাংলাদেশ যেভাবে যুদ্ধ করেছে তাতে প্রতিটি সৈনিকের জন্য সমীহ ছাড়া আর কিছু মনে উদয় হয় নি। ৩৮১ রান তাড়া করে বাংলাদেশ যদি জিতে যেতো, হয়তো নতুন ইতিহাসের অংশ হতাম। কিন্তু একেবারে ইতিহাস হয় নি এটাও বলা যাবে না। ৩৩৩ রান রান করতে পারা ইতিহাসের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বাংলাদেশ এখন আর দুর্বল কোন দল নয়, কারো করুণার আশায় বসে থাকে না, বাংলাদেশ বাঘের গর্জনে প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন ধরায়। কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে করুণা দেখানোর প্রত্যয় রাখে।
বাংলাদেশ থেকে নটিংহ্যামের দূরত্ব প্রায় ৪৯৭৯ মাইল। নটিংহ্যাম ইংল্যান্ডের মধ্যভাগে অবস্থিত, এই শহরের ৩০০ হাজার জনসংখ্যার প্রায় ৩৬ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এরমধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ এশিয়া বা এশিয়ান বংশোদ্ভূত, মোট জনসংখ্যার ৫/৭ শতাংশ বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। ট্রেন্ট ব্রিজের ধারণক্ষমতা ১৭ হাজারের কিছু বেশি, আজ প্রায় প্রতিটি আসন বাংলাদেশি দ্বারা পূর্ণ ছিল। ১৭ হাজার দর্শকের মধ্যে অনন্ত ১৫ হাজার অবশ্যই বাংলাদেশি ছিল। যদিকে তাকিয়েছি লাল আর সবুজ দেখেছি। আমি যে গ্যালারীতে ছিলাম তার ধারণক্ষমতা ২০০/২৫০ হবে এর মধ্যে ২০/২৫ জন ছাড়া প্রত্যেকেই লাল সবুজ বুকে ধারণা করে বসেছিল।
আমার বয়স যখন ১৬/১৭ আমি দেশ ছাড়ি প্রায় যৌবনের প্রারম্ভে। যাকে উঠতি বয়স বলে সেই বয়সে দেশ ত্যাগিত হয়েছি। দেশ ছাড়ার যে বেদনা আজ এতো বছর পরেও সমানভাবে অনুভূত হয়। আমি তবু বিলেতের বাংলাদেশিদের দ্বিতীয় প্রজন্ম। আমাদের প্রথম প্রজন্ম অর্থাৎ বাবা চাচা মামা খালু অনেকেই এখন প্রয়াত, তাঁদের হাত ধরে বিলেতে আগমন হলেও তারা প্রায় অতীত হয়ে গেছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁদের রক্ত ঘাম আমাদের শরীরে বর্তেছে বলেই আমরা এখনো প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁদের স্মরণ করি। তাঁদের কষ্ট কিংবা আত্মত্যাগ নিজেদের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে বলেই আমরা নিজেদের যাচাই করতে পারছি।
আমরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, আমি জানি এই অবস্থান তৈরীর পিছনে কতটুকু খননের প্রয়োজন হয়েছে, কতটুকু রক্ত, ঘাম ঝরানোর প্রয়োজন হয়েছে। আমরা হয়তো অকৃতজ্ঞ নই, আমরা হয়তো পূর্বপুরুষের পায়ের ছাপে নিজেদের যাচাই করতে পারি কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশীদের এমন দায় নাই। দেশ নামে বুকের কোনে যে বেদনা সেই বেদনাবোধ তৃতীয় প্রজন্মের নাই।
আমাদের সন্তানেরা বাংলাদেশী তৃতীয় প্রজন্ম হিসাবে পরিচিত। দীর্ঘদিন পূর্বে তাদের দাদা কিংবা বাবা এদেশে বসতি গেড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু এর জন্য তারা কোন দায় বা দায়িত্ব অনুভব করে না। তাদের জন্ম বিলেতে, তাদের দেশ বিলেত। বাংলাদেশ তাদের অন্য অনেক দেশের মতো, ছুটি কাটাতে ২/৪ সাপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ তারা ঘুরে আসে ঠিকই যেমনি ভাবে তারা মরক্কো, টার্কি, তানজানিয়া, দুবাইয়ে ছুটি কাটাতে যায়।
দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। ভালভাবেই বিলেতে নিজেদের আসন গাঁড়তে পেরেছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালীরা নিজেদের সফল ভাবতে পারে, অর্থনৈতিক মুক্তিকে সফলতা ধরা হলে বাঙালী দ্বিতীয় প্রজন্ম অনেকাংশে সফল। তবু এই অর্থনৈতিক সফলতার বিপরীতে তাদের বড় ধরণের পরাজয় আছে, এই পরাজয় নৈতিক। সফলতার পিছনে ছুটতে গিয়ে তারা তাদের সন্তান, সন্ততিকে নিজেদের শিকড় চিনাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিজের সন্তানদের দেশ, মাটি, মানুষের সাথে সংযোগে ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ব্যর্থতাকে হয়তো আরো বড় করে প্রকাশ করা যায়, তাদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে হয়তো অনেক সত্যতা লুকিয়ে ফেলা যায়। তাদের ঘাড়ে তলোয়ার রেখে হয়তো স্বীকার করিয়ে নেয়া যাবে তারা নিজেদের শিকড়ের খবর পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছাতে ব্যর্থ। কিন্তু এসবই অর্ধসত্য হবে, তাদের অনেকাংশে দায়ী করে গেলেও তৃতীয় প্রজন্মের দেশ বিমুখতার জন্য তারা পুরোপুরি দায়ী নয়। দায়ী দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচার।
প্রজন্মে দেশের খবর পৌঁছাতে হলে সর্বপ্রথমেই দেশের পজিটিভ দিকগুলো অবগত করাতে হবে। পারিবারিক আবহের বাইরে অবগত করানোর মতো কি আছে আমাদের দেশে। কি বলা যায়, যা নিয়ে একজন পিতা তার সন্তানের কাছে পিতৃভূমির প্রসংসা করতে পারে। গর্ব করার মতো কোন বিষয়কি পিতা তার সন্তানের কাছে বর্ণনা করতে পারে। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি এমন কি ঘর গেরস্থালির ক্ষেত্রে কোন সুসংবাদ কি গত কয়েক দশকে আছে যা নিয়ে পিতা সন্তানের কাছে যেতে পারে, না নেই।
বিলেত বা ইউরোপ আমেরিকার যেসব দেশে আমাদের প্রজন্ম বড় হচ্ছে তাদের কাছে দেশ নিয়ে পৌঁছাতে হলে তাদের দেখাতে হবে, জানাতে হবে আমাদের দেশ কোন অংশে বিলেতের চেয়ে, আমেরিকার চেয়ে ছোট না। তাদের বুঝাতে হবে বাংলাদেশ বিলেতের সাথে, আমেরিকার সাথে পাল্লা দিতে পারে। তারা যদি দেখে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তারা যদি বাংলাদেশ থেকে ভাল কিছুর আওয়াজ পায় তারা সেই আওয়াজ অনুসরণ করবে। তারা আমাদের সন্তান, তাদের ধমনিতে আমাদের রক্ত প্রবাহিত।
ক্রিকেট, ধমনিতে বয়ে যাওয়া এক মধুর অনুরণন। বাংলাদেশ যেখানে পরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসাবে, বন্যার দেশ হিসাবে, দারিদ্র্যতার দেশ হিসাবে, রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ হিসাবে। অসততার দেশ, বিনাবিচারে হত্যার দেশ, ধর্মান্ধতার দেশ, অসহিষ্ণুতার দেশ। ব্লগার হত্যা, জঙ্গি আক্রমণ, নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ঘটনার পরেও ক্রিকেট বাংলাদেশকে উচ্চে তুলে এনেছে। এতো এতো নেতিবাচক সংবাদের পরেও ক্রিকেটের একটু ধনাত্মক খবর আমাদের প্রজন্মকে উজ্জীবিত করছে, তারা নিজেদের শিকড়ের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। বাবা দাদাদের আবাসভূমি পুনরায় খুঁড়ে দেখায় তারা উৎসাহী হচ্ছে।
ট্রেন্ট ব্রিজের আজকের খেলায় প্রায় পনেরো হাজার বাঙালী উপস্থিত ছিল, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের ৫০ শতাংশ হলে তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালী ছিল ৫০ শতাংশ।
তৃতীয় প্রজন্মের চোখেমুখে আমি উচ্ছ্বাস দেখেছি, নিজেদের শিকড়ের জন্য তীব্র ভালবাসা দেখেছি। তারাও নিজেদের ভুলের পাড়ে ফিরতে চায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের মতো নিজের পিতা পিতামহের ঋণ শোধ করতে চায়। সামান্য এক খেলা যদি তাদের এমন ভাবে দেশের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে তাহলে একটু ভাল রাজনীতি, একটু ভাল সমাজনীতি, একটু ভাল অর্থনীতি তাদের কেমন প্রভাবিত করবে ভাবতেই আনন্দে মন কেঁপে উঠছে।
আমাদের রাজনীতিবিদদের যদি একটু সুমতি হয় এতিমের টাকা কিংবা ভোটার বিহীন ক্ষমতার দাপটের বদলে তারা যদি একটু নমনীয় হয় তাহলে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে, ক্রিকেট ছাড়িয়েও বাংলাদেশ বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। আসুন আমরা বাংলাদেশের জয়গান করি। জয় বাংলা!
আবু মকসুদ: কবি ও সম্পাদক; শব্দপাঠ