ম্যানচেস্টারে বোমা হামলা হয়েছিল ২০১৭ সালের ২২ মে। এক আরব বংশোদ্ভূত যুবকের ঘটানো এ বোমা হামলার পর হেইট ক্রাইম বেড়ে গিয়েছিল। বেড়েছিল বর্ণবাদী আচরণ সারা ব্রিটেনেই। এক সপ্তাহের মধ্যে বর্ণবাদী আচরণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছিল তখন। বোমা হামলার দিন থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টা কাজ করে ক্লান্ত ডাক্তার নাভিল ১২ ঘণ্টার রেস্ট শেষে আবারো যাচ্ছিলেন তার নির্ধারিত কাজে, আক্রান্ত কিশোর-কিশোর আর নারী-পুরুষের সার্জারির জন্য। পথে এক শ্বেতাঙ্গ তাকে বলে, তুমি তোমার দেশে যাও এ দেশ তোমার না। হেইট ক্রাইম এই পর্যায়ে চলে এসেছিল যে, বোমা হামলার রাতেই ওল্ডহ্যামের একটা মসজিদের দরজায় বোমা হামলা হয়। কিন্তু তার বিপরীতেও ছিল অন্য চিত্র। পরদিন সেই মসজিদে কিছু শ্বেতাঙ্গ মহিলা আর পুরুষরা আসে, নিয়ে আসে হার্টের প্রতিকৃতি, বেলুন… সহমর্মিতায় ছেয়ে যায় মুসলিম কমিউনিটি। মসজিদের দরজাটি হয়ে যায় যেন বেলুন-হার্ট দিয়ে নির্মিত এক সৌন্দর্যময় ভালোবাসার তোরণ। এক মুসলিম যুবক ম্যানচেস্টার সিটি সেন্টারে হাতে লিখে একটা প্লেকার্ড নিয়ে যায়। তাতে লেখা- ‘আমি মুসলমান, আমি তোমার ওপর আস্থা রাখি, তুমি কি বিশ্বাস করতে পারো, একটা কোলাকুলি কি আশা করতে পারি না?’ যুবকই বলেছেন মাত্র ৩০ সেকেন্ড তিনি কাটিয়েছেন এক রুদ্ধশ্বাস সময়। কি জানি কি ঘটে যায়। কিন্তু দেখা গেছে এর পরে একটা ‘হাগ’ কিংবা কোলাকুলি করার জন্য নারী-পুরুষদের লম্বা লাইন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ যেন এক ঐক্যবদ্ধ ম্যানচেস্টার। মসজিদে মসজিদে হয়েছে নিহতদের স্মরণে স্মরণসভা। ম্যানচেস্টারের এরিনায় ২২ মে পাশবিকতার যে বজ্রপাত হয়েছিল, এতে আতঙ্কে বিহ্বল হয়েছিল মানুষ, কিন্তু এই বজ্রপাতে নিস্তেজ হয়ে পড়েনি শহর। নতুন শক্তিতে আবার জেগে উঠেছিল ম্যানচেস্টার। তাইতো ম্যানচেস্টারের বাসে ট্রামে সব জায়গায় এখনো শোভা পায় প্রতীকী তিনটি শব্দ ‘উই লাভ ম্যানচেস্টার’। আমরা ফুল দিতে গিয়েছিলাম, সেন্টস আন স্কোয়ারে, সঙ্গে নিয়েছিলাম একটা ফ্রেম। নিহত ২২ জন মানুষের নাম সংবলিত একটা ফ্রেমের প্রতি ভিন্ন বর্ণের মানুষেরও উৎসুক্য ছিল দেখার মতো। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া স্কোয়ারে মুসলিমদের মানবিক আবেদন ম্যানচেস্টারের সামাজিক ঐক্যকে আরো সুসংহত করেছিল সে সময়। সেভাবেই ১৫ মার্চের নিউজিল্যান্ডের বোমা হামলায় সারাবিশ্ব যখন স্তব্ধ, ঘৃণায় আর আতঙ্কে যখন বিহ্বল মানুষ, উগ্র ফ্যাসিস্ট কেউ কেউ যখন অন্তরের গহিনে বর্ণবাদের জয়গান গাচ্ছে, ঠিক তখনই আবারো এই ম্যানচেস্টারেই লক্ষ করেছি ভিনদেশি মানুষের কাতর অনুভূতি। আতঙ্ক ছিল সারা ব্রিটেনেই মসজিদগুলোতে ছিল সতর্কাবস্থা। লন্ডনের বাঙালিদের মসজিদে এসেছেন লন্ডন মেয়র সাদিক খান। মসজিদে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য এমনকি অতিরিক্ত নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।
ম্যানচেস্টার এরিনার সেই দুঃখগাথা এখনো মানুষকে ব্যথিত করে, কথায়-আলোচনায় সে এক দুঃস্বপ্নের রাত, কিন্তু সেই দুঃখগাথা মানুষকে নিয়ে যায়নি অমানবিক নির্মমতায়। পাশবিকতার কাছে ম্যানচেস্টারের জনজীবন হার মানেনি। এক মুসলিম নামধারী উগ্র মৌলবাদীর বিপরীতে সারা ম্যানচেস্টার একাট্টা হয়েছে, অমুসলিমরা হয়ে উঠেনি মুসলিমদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ। বরং এর বিপরীতে এখানে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে চায় মানুষ। আর যার প্রমাণ রেখেছেন ৫৭ বছর বয়সী এন্ড্রু গ্রেস্টন। নিউজিল্যান্ডে বন্দুক হামলা আর ৪৯ জন মানুষকে হত্যার পর পরই তিন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিলেন, একটা বার্তা দিয়েছিলেন সারা বিশ্বকে, আমি তোমাদের নামাজের সময় পাহারা দেব। তিনি মুসলমানদের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছেন এবং সে জন্য তিনি ‘আমি তোমাদের বন্ধু’ হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। কিন্তু বিশ্বের যুদ্ধবাজ নেতাদের কানে কি পৌঁছোয় এসব বার্তা। এ প্রশ্নটাই বারবার আমাদের ধাক্কা দেয়। বহু উচ্চারিত আইএস এখন ক্ষয়িষ্ণু, তাদের তেজ কমে গেছে। তবুও ধারণা করা হয় এখনো দশ সহস্রাধিক আইএস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই দেশগুলোতে, যদিও বলা হচ্ছে আইএস খেলাফতের পতন ঘটেছে। সারা পৃথিবীতেই গণমাধ্যমের কল্যাণে আইএস এক সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে যতটা পরিচিতি এসেছিল, তার চেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছিল মুসলিম উগ্রবাদী হিসেবে। বলতেই হয়, ‘মুসলিম’ শব্দটাতে কোনো মিথ্যা নেইও। এই যে মিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে এই আইএস তাদের নৃশংসতা চালাল, সে বিনিয়োগের ইতিহাস কি পশ্চিমা গণমাধ্যম ফোকাস করতে পেরেছিল কখনো। একটাবারের জন্য কি বলা হয়েছিল এই বিনিয়োগের পেছনে কারা? সামনে এসেছে শুধুই আইএস, শুধুই উগ্র মুসলিম শব্দগুলো।
যুগে যুগে এভাবেই শাসক-শোষকরা তাদের প্রয়োজনে একটা নিগৃহীত শ্রেণিকে টার্গেট করেছে। অর্থকেই তারা হাতিয়ার করেছে, ওই অর্থের টোপে গ্রাস করেছে মেধা-তারুণ্য। ওই মেধা তারুণ্য যখন যেভাবে প্রয়োজন, তারা সেভাবেই ব্যবহার করিয়েছে এদের দিয়ে। বাণিজ্যের জন্য বাজার প্রয়োজন, আর ওই বাজার সৃষ্টিতে এরা সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়েছে। ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। কখনো তারা জাতীয়তাবাদের স্লোগান দিয়েছে, কখনোবা উপস্থাপন করা হয়েছে জাতি আর বর্ণের দ্বন্দ্বের। গত শতকের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে তাই সারা বিশ্বেই ধর্মের প্রভাবটা ব্যাপক। পাকিস্তান যেমন উগ্রতায় প্রতিদিন রক্তাক্ত হয়, ঠিক তেমনি ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সারাটা দেশ। মহাত্মা গান্ধীর দেশ হিন্দু মৌলবাদের কাছে যেন নত হয়ে গেছে। কিন্তু নিউজিল্যান্ড থেমে থাকেনি। সে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা যেন সারা বিশ্বকে দেখিয়েছে বিস্ময়কর মানবতার উদাহরণ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী একজন মানুষ হয়েই যেন সারা পৃথিবীতে পৌঁছে দিয়েছেন মানবিকতার বার্তা।
বলা হয়ে থাকে ইসলাম অতি দ্রুত বেড়ে ওঠা একটা ধর্ম এই পৃথিবীতে। সারা পৃথিবীতেই এই ধর্মের মানুষরা আবাস গেড়েছে। এই আবাস গড়ার পেছনেও আছে শোষণ-বঞ্চনা-নিগ্রহ-সংগ্রাম আর বিসর্জনের কালো কালো অধ্যায়। ইরাক-সিরিয়া-লিবিয়া তথা মুসলিম দেশগুলোর যুদ্ধে শিশু-নারীরা বিধ্বস্ত হয়েছে। মানুষ তার আবাস হারিয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে শরণার্থী হয়ে জায়গা করে নিয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে। স্বাভাবিকভাবেই এরাও তাদের পথচলায় বহন করছে তাদের সংস্কার। এই সংস্কার-ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই চলছে তাদের যাপিত জীবন।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলাকারী ব্রেনটন হ্যারিসন টারান্টও জন্ম নিয়েছে সেই কালো অধ্যায়ের ইতিহাস থেকেই। কারণ সে তাই বলেছে, যা উচ্চারিত হয়েছে যুগ যুগ থেকে বর্ণবাদী মানুষের মুখ থেকে। ধর্মের নাম নিয়ে উগ্র ক্রীড়নকরা বিশ্বকে যেমন কাঁপায়, ঠিক তেমনি ওই সন্ত্রাসীও সেই ক্রীড়নকই। বিশ্বে ধর্মীয় অস্থিরতাকে স্থায়ী করতেই বন্দুক নিয়ে সেও খেলেছে। নিয়েছে অর্ধশত মানুষের প্রাণ। এই হামলার পর নিউজিল্যান্ড স্তব্ধ হয়েছিল, কিন্তু থেমে থাকেনি। ভয়ে আতঙ্কে নত হয়ে যায়নি। বরং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডানের নেতৃত্বে বর্ণবাদীদের প্রতি ঘৃণা তীব্র হয়েছে। দেশের জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় হয়েছে, ভিন্ন বর্ণ-ধর্মের মানুষের প্রতি দেশটির সহমর্মিতা তাদের দেশ তো বটেই, সারা পৃথিবীর মানবিকতাকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়। তার দেশ আর রাষ্ট্র কাঠামোকে নিয়ে তিনি মিশ্র সংস্কৃতির মানুষের বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ়তর করেছেন। তার কর্মযজ্ঞ নিউজিল্যান্ড যেন আরো জোরালো হয়েছে, শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নন, একটা গোটা দেশ যে কীভাবে মানবতার প্রতীক হয়ে যায়, তাই দেখিয়েছেন জেসিন্ডা। সারা পৃথিবীর মুসলমানদের কাছে জেসিন্ডা যেন এক ভালোবাসার নাম, যেন মানবতার দূত।
এর বিপরীতেও আছে ভিন্ন বিচ্ছিন্ন উদাহরন। ব্রিটেনে কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোতে বর্ণবাদ একবোরে মিইয়ে যায়নি।এমনকি নিউজিল্যান্ডের হত্যাকান্ডের পর ব্রিটেনের বর্ণবাদীরাও লাফ দিতে চেষ্টা করেছে, তারা বার্মিংহামে এক রাতেই পাঁচটা মসজিদের দরজা-জনালায় ভাংচুর করেছে, মসজিদে টেলিফোনে ফোন করে বলেছে ‘এদেশ তোমার না’।পুলিশে রিপোর্ট হয়েছে, বিচ্ছিন্ন এ ভাংচুর কিংবা বর্ণবাদি প্রচারণা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি বর্ণবাদীরা। পৃথিবীর সব জায়গায়ই একটা ছোট্ট শ্রেনীর মাঝে এইসব বর্ণ বৈষম্য কাজ করে।কিন্তু সরকার কিংবা প্রশাসনের কঠোর উদ্যেগ এসব দমনও করতে পারে, যা হয়েছে এই ব্রিটেনে।
জাসিন্ডার মানবিকতায় যেমন মুগ্ধ হয়েছে এ বিশ্ব, ঠিক তেমনি এ বিশ্বের অগণিত মানুষ দেখেছে ক্রাইস্টচার্চে হামলায় বাংলাদেশী বংশদ্ভোত নিহত পারভীন এর স্বামীর কঠোর সময়েও শান্ত আর ধীর গলায় নিউজিল্যান্ডকেই ‘সেইফেস্ট জায়গা’ বলা কিংবা খুনীকে অনুকম্পা দিয়ে বিশ্বকে মানবিক হবার আহবান ।
২০১৭-এর ম্যানচেস্টারের একজন মুসলিম সন্ত্রাসীর হামলায় যেমন ব্রিটিশ জাতি নির্ণয় করেনি সারা মুসলমানদের উগ্রতার চিহ্ন, ঠিক তেমনি নিউজিল্যান্ডের সন্ত্রাসী হামলাও ভিন্নবর্ণের সব মানুষের হামলা নয়। সব উগ্রতার বিরুদ্ধেই মানবতার অবস্থান। সেই মানবতার পক্ষে দুঃখে কাতর একজন জেসিন্ডা তথা একটা রাষ্ট্র যেন ভালোবাসার একটা অনুভূতির নাম। ভালোবাসার সেই অনুভূতি নিয়েই মানবিক আহ্বানে সব জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ বুকটান করে দাঁড়াক এই পৃথিবীতে। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার নাম নিয় যারা উন্মাদনা ছড়ায় ধর্মকে পুঁজি করে, তাদের বিপরীতে জেসিন্ডা আর্ডেনরাই আমাদের পথ দেখাবে, মানবিক বোধ জন্মাবে, জয়গান গাইবে মানতার।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক , প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম।