ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। বাঙালি মানস ও চেতনায় এ মাসটাই আমাদের সংগ্রামের উৎস। সংগ্রামে আমরা উজ্জীবিত হয়েছি, আমরা প্রাণিত হয়েছি এগিয়ে যেতে। এ মাসটাকে কেন্দ্র করেই দেশে যেমন বাংলা এবং বাঙালিত্বর স্পর্ধা নিয়ে এগিয়ে যাই আমরা, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের বাইরেও প্রবাসী কিংবা অভিবাসী মানুষগুলোও গর্বভরে উচ্চারণ করে এই মাসটার কথা।
ফেব্রুয়ারি এলে দেশের মতোই ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কিংবা সংগ্রামী চেতনার স্পর্শ পাই এই ব্রিটেনে। এখানেও ’৫২-এর স্পন্দনের অনুরণন হয় ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে। ব্রিটেনের ওল্ডহ্যামই প্রথম শহর, যেখানে বাংলাদেশের বাইরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ হয়েছিল।
বাঙালি অধ্যুষিত একটা এলাকা, বাংলাদেশের নামে আরেকটা সেন্টার আছে যার পাশে, সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই মিনার। শুধু তাই নয়, এ যেন এক বিস্ময় মাখা বাংলাদেশের আরেক রূপ। শহীদ মিনারের পাশেই আছে একটা বড় গোলচত্বর, যেখানে বাংলাদেশের ঐতিহ্য দেখে লাখ লাখ ভিনদেশি আর ভিন্ন বর্ণের মানুষ।
এই গোলচত্বরে মাঝখানে সুভাশিত হয়ে আছে বাংলাদেশের শাপলা। এই শাপলার পাশ দিয়ে হাজারো-লাখো চালক প্রতিদিন গাড়ি চালান। ওল্ডহ্যামে বাঙালি কমিউনিটির সার্থকতার এই পথ ধরেই এরপর লন্ডনের আলতাব আলি পার্কে নির্মিত হয়েছে আরেকটা মিনার।
এমনিতেই গোটা ইউরোপ কিংবা পশ্চিমের শহরগুলো হলো স্ট্যাচুর শহর। যেখানেই যে শহরে আমরা যাই না কেন, স্ট্যাচুগুলোই যেন কথা কয়। ইতিহাস ফুটে ওঠে এই স্ট্যাচুগুলোর মধ্য দিয়ে। স্বাভাবিকভাবে তাই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার একটা জায়গা হলো এই শহীদ মিনার, যেখানে বাংলাদেশ ফুটে উঠেছে। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সংগ্রাম আর বীরত্বের কথা।
এই বীরত্বগাথা আমাদের পরিচয় করে দিয়েছে ভিন্নভাবে। ব্রিটেনের স্থানীয় প্রশাসনে এখন বাংলা কিংবা বাঙালিত্ব নিয়ে নতুন কোনো পরিচয় তুলে ধরতে হয় না। বিশেষত বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় স্থানীয় কাউন্সিল এ ব্যাপারে অবহিত সে তো কয়েককাল থেকেই।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে এখন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যাও কম নয়। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস তো বাঙালিদের নিজস্ব এলাকা হিসেবেই পরিচিত। টাওয়ার হ্যামলেটস, নিউহাম, ওয়েস্টমিনিস্টার, ম্যানচেস্টার, ওল্ডহ্যাম, বার্মিংহামসহ ব্রিটেনে এখন অন্তত দেড় শতাধিক নির্বাচিত কাউন্সিলর।
ব্রিটেনের পার্লামেন্টে নির্বাচিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিনজন এমপির মাঝে একজন সরাসরি বাংলাদেশি মানুষের নিজস্ব এলাকার। সে হিসেবে মূলধারার রাজনীতিতে বাঙালি অভিবাসীদের অবস্থান মোটেই হেলাফেলার নয়। সে জন্য বাঙালিদের নিজস্ব দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হওয়া কিংবা যৌক্তিক কিছু দাবি-দাওয়া আদায় করে নেয়া খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
অভিবাসী বাঙালিদের অর্জন আছে এই ব্রিটেনে, সে জন্যই সারা ব্রিটেনে নির্বাচিত হচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে আছেন দুই ডজনের অধিক কাউন্সিলর, নিউহাম, ওয়েস্টমিনিস্টারেও আছেন আমাদের জনপ্রতিনিধি। লন্ডনের বাইরে যদি আমরা যাই তাও দেখব প্রতিনিধিদের সংখ্যা কম নয়।
ম্যানচেস্টারে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলর হলেন তিনজন, ওল্ডহ্যামে আছেন চারজন, বার্মিংহামে আছেন মাত্র দুজন। এভাবে যদি আমরা চোখ দেই দেখা যাবে দেশটার বিভিন্ন শহরে আমাদের জনপ্রতিনিধির সংখ্যা কম হলেও ১৫০ জনের কাছাকাছি।
আমাদের এই যে অর্জন, আমাদের যে বসতি, সব মিলিয়েই এই ব্রিটেনে আমাদের অবস্থান। আমাদের এই অবস্থানকে আমরা সুসংহত করেছি, সমৃদ্ধ করেছি। আমাদের সংস্কৃতি আর শিকড় কোনো না কোনোভাবে মজবুত হয়েছে। সে জন্যই সারাদেশের বিভিন্ন শহরে বাংলা ভাষা স্কুলের পাঠ্য হিসেবেও বিবেচিত হয়ে আসছিল।
লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিসের মাধ্যমে ১৯৮২ সাল থেকে দীর্ঘদিন থেকে বাংলা শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন শিক্ষকরা। পাশাপাশি চায়নিজ, মিরিডিয়ান, রাশিয়ান, লিথুনিয়ান, আরবি, উর্দু এবং সোমালিয়ান ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষা শিখাতে শিশুদের ফ্রি সুযোগ-সুবিধা ছিল।
প্রয়োজনীয় অনুদানও ছিল এতে। বিশেষত বাংলা ভাষা সেকেন্ডারি লেভেল ছাত্রছাত্রীদের পর্যন্ত পড়ার সুযোগ ছিল। এ ধারা অনুসরণ করে যুক্তরাজ্যের অনেক শহরে এই কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। লন্ডন তো বটেই, এর আগে এমনকি ম্যানচেস্টার, ওল্ডহ্যাম, হাইড প্রভৃতি শহর থেকে বাংলা ভাষায় জিসিএসই ও এ-লেভেলে ভালো রেজাল্ট করে ইউনিভার্সিটিতেও গেছে ছাত্রছাত্রীরা।
কিন্তু এ শহরগুলোর স্কুলগুলোতে পাঠ্যক্রমে এখন আর বাংলা নেই। বাংলা শেখানোর জন্য স্কুলগুলোতে কোনো শিক্ষক নেই। বাঙালি অধ্যুষিত কিছু এলাকায় এর আগে স্থানীয় কাউন্সিল বিভিন্ন কমিউনিটি ফান্ড চালু রেখেছিল এবং বিভিন্ন বাংলাদেশি ওয়েলফেয়ার সেন্টারগুলোতে শিশুদের মাতৃভাষা পাঠদানের জন্য অনুদান দিয়ে যেত। কিন্তু হালে এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু কিছু কিছু শহরে কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বাংলাদেশি সংগঠনের নিজস্ব উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে বাংলা ভাষার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য। কারণ বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে যারা অভিবাসী হয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন, তাদের অনেকেই অর্থনৈতিক অন্যান্য প্রতিশ্রুতির কারণেই নিয়মিত সময় দিতে পারছেন না।
ব্রিটেনের টাওয়ার হ্যামলেটস তারপরও টিম টিম করে জ্বলছিল বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রক্রিয়া। কিন্তু এই শেষ বাতিটাও নিভে যাচ্ছে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেই হয়তো শেষ প্রদীপটিও নিভে যাবে। অর্থাৎ এ মাসেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বাংলা শিক্ষার এ কার্যক্রম। এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছেলেমেয়ে এ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।
৯০ শিক্ষক চাকরি হারাবেন এবং এ কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪২ সংগঠন বন্ধ হয়ে যাবে। এই যে ৪২টি সংগঠন এগুলো শুধুই বাংলা ভাষা শিক্ষার শিক্ষালয় নয়। এই সংগঠনগুলো কিংবা এগুলোর বাইরে যে সংগঠনগুলোতে বাংলা ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়, সেগুলো বাংলা সংস্কৃতি আদান-প্রদানেরও একটা জায়গা।
এই সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় বাংলা কিংবা বাঙালিত্ব নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে, যেখানে এই ছেলেমেয়েরা এসে বাংলা সংস্কৃতির প্রতিই আকৃষ্ট হয়। এই অনুষ্ঠানগুলোতে সংযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা ধারণ করে তাদের পিতা-মাতা কিংবা মাতামহ-পিতামহের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার।
স্থানীয় প্রশাসন কমিউনিটি অনুদানের ওপর যদি বাংলা শিক্ষার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা ক্রমে আমাদের শেষ অবলম্বনটুকুও হারাবো। যুক্তরাজ্যে ছাত্রছাত্রীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ভাষা যেমন- স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, উর্দু প্রভৃতি ভাষা নিয়ে জিএসই কিংবা এ-লেভেল করে থাকে।
উর্দু তো মরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ব্যাপকসংখ্যক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ছাত্রছাত্রী উর্দু পড়ছে এবং আমাদের এলাকায় উর্দুর জন্য জিসিএসই ও এ-লেভেলে ফুলটাইম শিক্ষকও আছে। এবং বলতেই হয়, মোটামুটি পরিশ্রমেও স্প্যানিশ-ফ্রেঞ্চ ভাষায় তারা ‘এ স্টার’ পেয়ে যায়, যেটা আমি আমার সন্তানদের মাঝেও দেখেছি।
অনেকেই বলতে পারেন, বাংলা আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের চয়েসের মাঝে নেয় না। কিন্তু একটা কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই, অন্যান্য ভাষারও তো একই অবস্থা। ফ্রেঞ্চ কিংবা জার্মান কয়জন নেয়, কিন্তু তবুও স্থানীয় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভাগ তো এই ভাষাগুলো পড়ানোর জন্য ঠিকই ফুলটাইম শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে।
টাওয়ার হ্যামলেটসে আমাদের অন্তত দুই ডজন কাউন্সিলর আছেন। তাই সম্মিলিতভাবে যুক্তি উত্থাপন এবং দাবি আদায়ের জায়গা এটা, সেখানে কাউন্সিলররা কথা বলতেই পারেন। তাদের পার্টির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজন নেই। যেহেতু যুক্তি আছে, সেহেতু সেই যুক্তিগুলোই উত্থাপন প্রয়োজন, অন্যান্য কাউন্সিলরের সমর্থন আদায় প্রয়োজন।
রাজনীতি তো জনগণ দিয়েই। যুক্তির মধ্য দিয়ে তাই কাউন্সিল সভায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে জনগুরুত্বপূর্ণ এই দাবিটাকে প্রাধান্য না দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
অন্যদিকে বাংলাদেশের দূতাবাস বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছাত্রছাত্রীদের নিয়েও ভাবতে পারে। তাদের একটা ভালো উদ্যোগ হলো, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বছরে সম্মাননা দেয়া। বাংলাদেশ সরকার লন্ডনের একটা মসজিদের জন্য ৩০ হাজার পাউন্ড অনুদান দিয়েছে সম্প্রতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্কুলও পরিচালনা করে দূতাবাস। স্বীকার করি এটা তাদের দায় নয়, তবে ব্রিটেনেও বাংলাদেশ হাইকমিশন বাংলা ভাষা শিক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।
তাদেরই উদ্যোগে ব্রিটেনের বাঙালি অধ্যুষিত শহরের কিছু কিছু সংগঠনকে কিছু অনুদান দিতেই পারে এ ভাষাটা অন্তত প্রাথমিক লেভেলে চালু রাখার জন্য। বাংলা ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখলে বিভিন্ন সময় দূতাবাস এই ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাংলাদেশভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার সুযোগও পাবে, যাতে করে এ প্রজন্মকে দেশমুখী করারও একটা সুযোগ সৃষ্টি হতেই পারে।
ব্রিটেনে বাংলাদেশি দ্বিতীয় প্রজন্ম (কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৃতীয় প্রজন্ম) নিয়ে বড় বেশি কথাবার্তা উচ্চারিত হয় বক্তৃতায়। আগেই বলেছি, এটা বাংলাদেশ সরকারের হয়তো দায় নয়, তবে সংস্কৃতি আর ইতিহাস-ঐতিহ্য সন্ধানী বর্তমান সরকার এ উদ্যোগ নিতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি।
সংস্কৃতি কিংবা বৈদেশিক মন্ত্রণালয় বলি কিংবা অন্যান্য যে কোনো মন্ত্রণালয় থেকেই এ রকম ছোটখাটো অনুদান (ফান্ডিং) দেয়া যেতেই পারে। বিশেষত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেখানে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক সহযোগিতা করে থাকেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারটা একটু বিবেচনা করলেই একটা ব্যবস্থা হয়েই যেতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে যদিও দূতাবাসের কথা এসেছে। তবে আসল দায়টা এখানকার বাঙালিদের, বাংলাদেশিদের। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনপ্রতিনিধিরাই দায়িত্ব নিয়ে কমিউনিটির স্পন্দনকে একটু গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয় কাউন্সিলগুলোতে একটু যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে ভূমিকা পালন করতে হবে। কমিউনিটিকেও এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখাটা প্রয়োজন।
ষার মাস ফেব্রুয়ারিতে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল তাদের সিদ্ধান্ত বদলাবে- এই আশা আমরা রাখতেই পারি। পাশাপাশি জিসিএসই কিংবা এ-লেভেলে আবারো যাতে বাংলা ভাষাকে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেটাও জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করাটাও প্রয়োজন। অন্তত বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার স্কুল-কলেজগুলোতে বাংলা ভাষার পঠনটা ফিরে আসুক- এটাই চাইছি আমরা ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে।
ফারুক যোশী : কলামিস্ট, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম।