লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব পাড়ি দিয়েছে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের পথ। এই পথ ছিল না প্রশস্ত কিংবা মসৃণ। বাংলা সাংবাদিকতাকে ব্রিটেনের কমিউনিটিতে সুদৃঢ় করতে এই সময় পরিক্রমায় লন্ডন প্রেসক্লাব পালন করেছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এখন ব্রিটেনের বাংলা সাংবাদিকতায় সাহসী এবং মেধাবী মানুষদের আধিক্যআছে। আছে কিছু উদ্যমী তরুণ।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সম্মেলন হয়ে গেল ২৭ জানুয়ারি। এমনিতেই বাংলাদেশি কমিউনিটির দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বার্ষিক-দ্বিবার্ষিক-ত্রিবার্ষিক প্রভৃতি নির্বাচন হয় ঘটা করে। কিছু কিছু শহরে একটা বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কিংবা সভাপতি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য ১০ হাজার/২০ হাজার পাউন্ড খরচ করেন কোনো কোনো প্রার্থী। এমনকি মসজিদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একই ধারা অনুসরণ করতে দেখা গেছে কোনো কোনো জায়গায়। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয় প্রায়ই।
এই বাস্তবতার মাঝে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব হলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটা সংগঠন। সিকি শতাব্দীরও আগে মাত্র ১১ জনের আহ্বায়ক কমিটি যাত্রা শুরু করে। এ বছর এই সংগঠনটি এক পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত হয়েছে। পরিপূর্ণ যুবক হতে গিয়ে যত ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয় একজন যুবককে, ঠিক ততটাই হয়েছে এই লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব।
ক্লাবের স্থায়িত্বের জন্য বিভিন্ন সময় প্রেসক্লাবের নেতারা চষে বেড়িয়েছেন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে। একটা নিজস্ব ভবনের জন্য তাদের এ চষে বেড়ানো। একটা বিরাট অঙ্কের ফান্ড আছে এখন তাদের কাছে। ২৫ বছর পর তারা একটা ভাড়া অফিস করতে পেরেছে।লন্ডনের মতো শহরে প্রেসক্লাবের মতো একটা সংগঠনের অফিসের জন্য যে ভবন প্রয়োজন, সে ক্ষমতাটুকু স্বাভাবিকভাবেই নেই। কিন্তু লন্ডনের বাইরে কোনো ভবন কিনে নিয়ে লন্ডনে একটা অফিস চালানো তাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব সম্ভবত সেদিকেই এগুচ্ছে। বিষয়টা লন্ডনের বাস্তবতায় মোটেও অযৌক্তিক নয়।
কিন্তু নির্বাচনী বাস্তবতায় লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের এবারের নির্বাচনে ছিল এক আলাদা উত্তাপ। শক্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে চলেছে দীর্ঘ এক মাস নির্বাচনী প্রচারণা। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহর বার্মিংহাম ম্যানচেস্টার ওল্ডহ্যাম লিভারপুল ব্রাডফোর্ড প্রভৃতি শহরে ছড়িয়ে আছেন সংবাদকর্মীরা।
এই শহরগুলোতে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সদস্য আছেন অনেকেই। কিন্তু নির্বাচন যারা করছেন অর্থাৎ ১৫ প্রার্থীর সবাই-ই লন্ডনের অবস্থানরত। যদিও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার লন্ডনের বাইরের। আর তাই এবারে দুটো প্যানেলের সবাই জোর দিয়েছেন ভিন্ন শহরে তাদের প্রচারণায়। দলবেঁধে তার গেছেন এই শহরগুলোতে। প্রচারণা চালিয়েছেন।
এবারের প্রচারণায় সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ছিল প্রেসক্লাবের সদস্য দেয়া না দেয়ার বিষয়। কারণ বিগত দিনগুলোতে এমন কিছু সদস্য প্রেসক্লাবের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, সাংবাদিকতায় এমনকি রিপোর্টিংয়ে এদের কোনো অতীত কিংবা বর্তমানের সংশ্লিষ্টতা দৃশ্যমান নয়। এ নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব এবং নানা অসঙ্গতির অভিযোগ উঠেছে এবারে খুব জোরালোভাবেই।
অন্যদিকে অনেক সত্যিকার অর্থের সাংবাদিক মেম্বারশিপ পাননি। এ কারণে যেখানে গেছেন প্রেসক্লাবের প্রার্থীরা, সেখানেই প্রশ্নবানে বিদ্ধ হয়েছেন। সে জন্য প্রার্থীরা সেসময় এ ব্যাপারটা বিবেচনার কথা বলেছেন তারা তাদের নির্বাচনী প্রচারণায়। আর তাই এবার প্রেসক্লাব মেম্বারদের দেখার পালা। নবনির্বাচিত সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে আলাপে তিনি এবারে সদস্যপদ বিবেচনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা তারা নিশ্চিত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।প্রেসক্লাবের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এর মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে ক্লাবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি এমনকি তার ভিন্ন ভিন্ন আলোচনায়। নতুন সদস্য করতে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করবে নতুন কমিটি, এ প্রত্যাশা প্রেসক্লাবের ৩১৮ জন মেম্বার করতেই পারেন। অন্যদিকে পুরনো মেম্বারদের তথ্য হালনাগাদ করে তাদের সদস্যপদও বিবেচনায় নিতে পারে বর্তমান কমিটি।
শুধু ‘পুরনো সদস্য’ এই অজুহাতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকা এখন কিংবা বছর বছর থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন একজন মানুষের এই সংগঠনের নীতিনির্ধারণের জায়গায় থাকাটা এ রকম সংগঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। একজন ব্লগার কিংবা অনলাইন এক্টিভিস্টও সাংবাদিক কিংবা রিপোর্টার হিসেবে বিবেচনা করা সঙ্গত কিনা তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
কিংবা একসময় সংবাদকর্মী ছিলেন কিংবা সাংবাদিক ছিলেন, এখন জীবন মানের উৎকর্ষ সাধনে ব্যবসায়ী হয়েছেন কিংবা চাকরিজীবী হয়ে সাংবাদিকতার ধারেকাছেও নেই, তাদের সদস্য নবায়নে নতুন কোনো চিন্তা করতেই পারে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের নবগঠিত কমিটি।আজীবন সদস্য হিসেবে তিনি বা তাদের কেউ কেউ থাকতে পারেন, কিন্তু প্রেসক্লাবের নীতিনির্ধারণীতে থাকা তাদের জন্য কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা ভাবনায় নেয়াটা প্রয়োজন। সে হিসেবে সদস্য নবায়নেও সংস্কার আনা যেতে পারে।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে লক্ষণীয় একটা ব্যাপার হলো এ দেশে জন্ম নেয়া দু-তিনজন তরুণ প্রেসক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তারা ইংরেজি গণমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করছেন। এ রকম আরো তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বাড়াতে পারলে মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে আমাদের কমিউনিটি সংযোগ বৃদ্ধি পাবে বলে বিশ্বাস রাখতে পারি।
ব্রিটেনে কমিউনিটি শব্দটি বড় বেশি উচ্চারিত। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সহাবস্থানে স্বাভাবিকভাবেই এখানে গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন কমিউনিটি। অভিবাসনের কারণেই ভিত পাচ্ছে এখানে বিভিন্ন কমিউনিটির বিভিন্ন সংস্কৃতিও। সে কারণেই এই অভিবাসে আমরা বাঙালিরা আমাদের সংস্কৃতি-সাহিত্য-সাংবাদিকতার একটা বলয়ও তৈরি করেছি ইতোমধ্যে। এই সংস্কৃতির জগৎ আমাদের একান্ত নিজস্ব হলেও ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে এর আবেদন রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই এখন আর।
মূলধারার রাজনৈতিক অঙ্গনে বাঙালিরা একটা উচ্চারিত নাম। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনীতিতে আছে অভিবাসী বাঙালিদের সাহসী পদচারণা। রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন আছে আমাদের প্রশংসা করার মতো অসাধারণ মানুষ কিংবা কর্ম, পাশাপাশি এর বিপরীতেও আছে বাংলাদেশি রাজনীতির অনাকাক্সিক্ষত সংস্কৃতি।
ব্রিটিশ বাংলাদেশি বলে উচ্চারিত আছে দুটো শব্দ। যেভাবে এখানে উচ্চারিত হয় ব্রিটিশ চাইনিজ, ব্রিটিশ পাকিস্তানি কিংবা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান প্রভৃতি। অর্থাৎ আমরা যেভাবেই চিন্তা করি না কেন, এথনিক অর্থাৎ সংখ্যালঘিষ্ঠ তকমাটা আমাদের থেকেই যাচ্ছে। আমরা আমাদের ওপর থেকে তা সরাতে পারছি না। এবং সে কারণে আমরা চাইলেও আমাদের শিকড়কে উপেক্ষা করতে পারছি না।
পারবে না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আরো কয়েক কাল। প্রত্যেকটা কমিউনিটিই তাই তাদের একটা নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছে। এই বলয় সৃষ্টি করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অন্য একটা ধারা সৃষ্টি হচ্ছে, আর তা হলো মুসলিম কমিউনিটি। ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের এক জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছে একটা গ্রুপ।
বাংলাদেশ পাকিস্তান, সুমাল, আরব প্রভৃতি দেশের মিলিত একটা উচ্চারণ হচ্ছে এখন ‘মুসলমান’ কিংবা ‘ইসলাম’। মসজিদে গেলেও ইসলামের কথা বলা হয়, বলা হয় মুসলিম উম্মার কথা, বলা হয় না বিশ্ব মানবতার কথা। বাস্তবতা হলো, এ প্রজন্মের একটা বড় শিক্ষিত অংশও এ দিকেই ঝুঁকছে।
নিজস্ব সংস্কৃতিকে তারা ধারণ করছে না, তারা প্রভাবিত হচ্ছে ইসলাম কিংবা মুসলমানিত্বের দিকে। অথচ ধর্ম আর নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ধর্মকে ধর্মের অবস্থানে রেখে সংস্কৃতিকে অনেক অভিভাবকও গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না।
আর এই জায়গাটাতেই আমাদের কমিউনিটির দায় কাজ করে। কমিউনিটিতে প্রভাব রাখতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ জায়গায়ই দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষত বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত গণমাধ্যমগুলোই এর প্রধান দায়িত্ব নিতেও পারে। হয়তো তাদের জায়গা থেকে তারা নিচ্ছেও। ব্রিটেনের গণমাধ্যমগুলোর নিরন্তরভাবে কাজ করার এই ক্ষেত্রটাতে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব সমন্বয়কের মতো কাজ করতে পারে।
বাংলা ভাষা কিংবা সংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক বিকাশের কোনো তথ্য জানা না থাকলেও ইতিহাসের সাক্ষ্য এটাই যে, ‘সত্যবাণী’ নামের একটা প্রকাশনা নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে বাংলা পত্রিকার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শতাধিক বছর পূর্বে ১৯১৬ সালে শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে এই যাত্রা।স্বল্প সংখ্যক মানুষ, অথচ কি এক আত্মপ্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই কণ্ঠক সময়ে। তারপর অনেক চড়াই উতরাই, দিগন্ত থেকে দিগন্তে বাঙালিদের অভিযাত্রা। ছাপার অক্ষরে কাগজে জ্বলজ্বল করা বাংলা ভাষার শত বছরের পথ পরিক্রমায় এখন বাঙালিদের আছে একটা শক্ত ভিত এই ব্রিটেনে।
আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা-ই আমাদের দৃঢ় এই অবস্থানটির কথা বিভিন্নভাবেই জানান দিয়েছে কিংবা দিচ্ছে এই কমিউনিটিতে। সত্তরের দশক থেকে ব্যাপকভাবে পাড়ি জমানো বাঙালি কমিউনিটি তিল তিল করে গড়েছে তাদের নিজস্ব জায়গাটি এই ব্রিটেনে। বাঙালিয়ানা নিয়ে অভিবাসী কমিউনিটি এখানে শেকড় গাড়তে থেকেছে তৎপর।
একে একে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা আর বাঙালিত্ব। নোনা জল পাড়ি দেয়া মানুষগুলোই এখানে সেই ‘সত্যবাণী’র নির্ভীক অভিযাত্রায় সারথি হয়েছে। একে একে জন্ম দিয়েছে অনেক অনেক বাংলা ভাষাভাষি গণমাধ্যমের। আকাশ সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে বাংলা।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব পাড়ি দিয়েছে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের পথ। এই পথ ছিল না প্রশস্ত কিংবা মসৃণ। বাংলা সাংবাদিকতাকে ব্রিটেনের কমিউনিটিতে সুদৃঢ় করতে এই সময় পরিক্রমায় লন্ডন প্রেসক্লাব পালন করেছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এখন ব্রিটেনের বাংলা সাংবাদিকতায় সাহসী এবং মেধাবী মানুষদের আধিক্য আছে। আছে কিছু উদ্যমী তরুণ।
এদের দিয়ে শুধু ব্রিটেনই নয়, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা কিংবা বাংলাদেশি কমিউনিটিকে যারা সুদৃঢ় করছে কিংবা বাংলা সাংবাদিকতায় যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সঙ্গে সেতুবন্ধনের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতির বিকাশে দেশে দেশে বাংলা সংযোগ বাড়াতে পারে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব।
ফারুক যোশী : কলামিস্ট, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম।