একটি গল্প দিয়ে শুরু করি। গল্পের জন্ম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন আব্রাহাম লিংকন থেকে।একজন কৃষক যখন তার বাড়ির পাশে ক্ষেতের বেড়া মেরামতের কাজ করছিল তখন তার দশ বছর বয়সী ছেলে দৌড়ে এসে বলল – ড্যাড বড় আপা আর এক যুবক আমাদের খড়ের স্তুপের উপর দাড়িঁয়ে…।
আর যুবকটি তার প্যান্ট নামাচ্ছে ও বড় আপা তার স্কার্ট উঠাচ্ছে । আমার মনে হয় ড্যাড ওরা খড়ের উপর পস্রাব করতে যাচ্ছে …
শুনে ক্ষুব্ধ কৃষক ছেলেকে বলল-ব্যাটা তুমি ঘটনার বিবরণ ঠিকই দিয়েছো তবে ব্যাটা তুমি ভুল উপসংহার টেনেছ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবেগ, আতাঁত ও জন আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে যে অবস্থান, সেখানে সবচেয়ে বেশিবার অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সহ নানা সময়ে , নানা সমীকরণে কী হতে যাচ্ছিল আর কী ঘটেছে ;সেগুলোর যোগফল একত্রিত করলে যে কেউ এই মিলগুলো পেয়ে যাবেন। এজন্য রাস্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হবার দরকার নেই।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেষ দেড়যুগ যেভাবে রাজনীতি করেছে, সেটাকে রাজনীতি না বলে একজন ডিক্টেটরের শাসন চালিয়ে যাওয়া বলা যায় ।সেক্ষেত্রে আপনি শেখ হাসিনাকে ঘৃণা করতে করতে এক পর্যায়ে ভালোবেসে ফেলতে পারেন! এটাকেই বলে স্টকহোম সিনড্রম। যদি আপনি রাজনীতির একজন ভালো ছাত্র হয়ে থাকেন তাহলে এই রোগের নাম শুনেছেন। না শুনলে গুগলকে জিজ্ঞাসা করা যায়।
একজন ডিক্টেটর হয়েও শেখ হাসিনা এত স্মুথলি যে তার শাসনকার্য পরিচালনা করতে পেরেছিলেন।কারণ সেজন্য যে যোগ্যতা, দূরদর্শিতা এবং কঠোরতা দরকার ছিল তার সবগুলোই তিনি ব্যবহার করেছেন।সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী,আইনজীবী,বিচারপতি,পুলিশ, প্রশাসনসহ প্রতিটা সেক্টরের এমন সব প্লেয়ারদেরকে শেখ হাসিনা যেভাবে বন্ধাত্বের ইনজেকশন দিয়ে বীজহীন করে রেখেছিলেন -তা নিকট অতীতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশ্বের অন্য কোন দেশেও প্রায় বিরল।
অপরদিকে জামাতে ইসলামী ছিল আওয়ামী লীগের ঠিক বিপরীত অবস্থানে। যেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ভারতকে ম্যানেজ করতে গিয়ে ভারতের নীল নকশা অনুযায়ী জামাত এবং বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যেখানে যে পরিমাণ কঠোরতা দেখানো দরকার সেটি দেখিয়েছে । এই দেড় যুগের শেষ সময়ে যখন পাশার দান উল্টে আজ জামায়াত স্টিয়ারিং সীটে এবং আওয়ামী লীগ তাহার সর্বনিম্ন স্থরে আছে যেখানে ১৯৭৫ সালে ও ছিলো না।
এখানে মজার বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগের পতনকেই জামায়াত তাদের বিজয় ধরে নিচ্ছে । তারা এটাকে হয়তোবা মক্কা বিজয়ের পরে ক্ষমা দেওয়ার জোসে আছে। অথচ জামাতের বিজয় এখনো অনেক দূর কিন্তু তারা আওয়ামী লীগ কর্তৃক এই পরিমাণ নিষ্পেষিত হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের পরাজয়কেই নিজেদের জয় ভেবে বসে আছে ।সেই ভাবনা থেকেই জামাতের আমীর যেভাবে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন- মনে হচ্ছে তিনি ২০১ আসনের ম্যান্ডেড নিয়ে বঙ্গভবনে আছেন। আর এই সেই ঘাড় হলুদ মিডিয়া যারা জামায়াতকে কখনো স্পেইস দেইনি তারাই এখন জামায়াতের আমিরের বক্তব্যকে সর্বোচ্চ হাইলাইট করছে।
এখকার মিডিয়ার চতুরতাকে জামাতের আমীর হয়তো উনার জনপ্রিয়তা ভেবে বাবলের রাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন।এই প্রচার এর মানে কিন্তু উস্কে দেওয়া। খেলার গ্যালারিতে যেমন একে অন্যকে উস্কানি দিয়ে স্লোগান দেয় –“আয় মার আইয়া “…।এখানেই আসলে উপসংহারের প্রসঙ্গ চলে আসে।জামায়াতকে হাইলাইট করার আরেকটি শানে নযুল হতে পারে দল এবং দেশকে আরেকটি চোরাবালিতে নিয়ে যাওয়ার ধান্ধা।কিংবা জামাতের আমিরের উদার হয়ে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা ,ফ্যাসিস্ট বলতে অনিহার ঘটনা গুলিতো এত তাড়াতাড়ি প্রসবের কথা নয়। উনি এগুলি নিয়ে ব্যক্তিগত এবং দলীয় ফোরামে আলাপ করতেই পারেন। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন মনে হচ্ছে- উনি ক্ষমতায় আছেন ও রাস্ট্রপতির প্রাণ ভিক্ষার রীতির মতো ক্ষমাও করে দিচ্ছেন।
জামাতে ইসলামীর এই সমস্যা নতুন নয়। আওয়ামী লীগ আর জামাতের আঁতাতের যে গল্প, সঙ্গে থাকলে সঙ্গী সরে গেলে জঙ্গি- এগুলো তো আর এমনি এমনি আসেনি। সাধারণ মানুষের পালস এর বিপক্ষে এদের অবস্থান বারংবার। এজন্য তৃণমূলের গণমতে জামায়াত যতটুকু আগায়, পিছায়ও তার সমানুপাত।আওয়ামী লীগ পতনের পর সারা দেশব্যাপী মানুষ যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে- এটাই ছিল স্বাভাবিক । অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী নেতাদের ধারণার চাইতেও অনেক কম প্রায়াশ্চিত করছে আওয়ামীলীগ।
আওয়ামী লীগই এখন উস্কানি দিচ্ছে বিএনপি জামাতকে ! কৈ নির্বাচন ? তোমরা এখন কোথায় ?এখনো ক্ষমতায় নয় কেন? এগুলো আসলে আওয়ামী লীগের অন্তর্জ্বালা থেকেই অর্থাৎ আমরা এখন নাই কিন্তু তোমরাও তো নাই।কিন্তু জামায়াত যেভাবে রিয়েক্ট করছে তা রহস্যময় এক আতাতীয় টানপোড়ান নয় কি?তারা ক্ষমতার আশেপাশেই নেই কিন্তু বক্তব্য বিবৃতিতে বুঝাচ্ছে আমাদের হাতেই সবকিছু।
জামাতে ইসলামীর এই অতি আত্মবিশ্বাস এবং সেটির সংক্রমণ ঘটিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়াকে পর্যন্ত তারা নির্বাচনে রাজি করিয়েছিল ১/১১ এর পরের নির্বাচনে। সেই রাজি করানোর নির্বাচনে যে রেগিং খেয়েছিল পুরো গণতন্ত্র সেটার প্রায়শ্চিত্ত টানতে হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশকে টানা দেড় যুগ।বর্তমানে যেভাবে তারা ক্ষমতায় চলে এসেছি ভাব নিয়ে চলছে সেটা যদি চোরাবালিতে পড়ে তাহলে তৃণমূল রাজনীতির মাঠে আরেকটি জামাতীয় নজির সৃষ্টি করবে। জামায়াত শুধুমাত্র একটি বিষয়কে মাথায় রেখেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে সেটা হলো- দেড় যুগের আওয়ামী নিষ্ঠুরতা থেকে তারা এখন মুক্ত এবং এটাই হওয়া উচিত ছিল ।
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে কৃষকের গল্পের সেই বালক ই আছে রাজনীর মাঠে। তারা যেভাবে কৃষকের ছেলের মতো ভাবছে -এখানে আসলে প্রস্রাব হচ্ছে ! প্রস্রাব করার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে সেটা আসলে তাদের জন্য একটি বিভ্রম। এখানে কৃষক যেটি বুঝেছেন সেটি হলো- ঘটনার প্রতি নজর না দিয়ে প্যান্ট খোলা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ওই ১০ বছরের বালকের মতোই একটি ভুল উপসংহার।
আওয়ামী লীগ, জামায়াত ,বিএনপির একাংশ যেখানে মনে করছে খড়ের উপর প্রস্রাবের জন্য প্যান্ট নামছে আর স্কার্ট উঠছে সেখানে আসলে ঐ যুবা দুই উপদেষ্টাই আসলে বুঝে ফেলেছেন- এখানে আবারো আওয়ামী রেগিং এর সহযোগীরা একত্রিত হবার সম্ভাবনা তৈরীতে রাস্তা তৈরীর কাজে ব্যস্ত। জামায়াতের আমীর কিংবা বিএনপির মহাসচিব এর মাঝে এখন স্টকহোম সিন্ড্রম ভর করেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু যেদিন স্বপরিবারে খুন হন সেদিন তিনি ফোন দিয়েও রক্ষিবাহিনীর প্রধান তোফায়েল কে কিংবা সেই বাহিনীকে পান নি! তেমনি শেখ হাসিনা যেদিন ম্যানিলা রুপ এর রসি দিয়ে ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাশেম আলীকে লটকালেন সেদিও জামায়াতের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্রশিবিরও একটি অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছিল। পালন করার ও দরকার মনে করেনি! আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের এই দুটি মিলের চাইতে বড় মিল আর খোজার দরকার নেই।উপসংহার বুঝাই হলো যেন রাজনীতি বাকি সব হলো- গুজব আর গুজব ।
ফুজেল আহমদ : রম্য লেখক।টরন্টো, কানাডা।
১৯ নভেম্বর ২০২৪ ইংরেজি
আরও পড়ুন-