ইচ্ছে ছিল, ফুটবলার হওয়ার। গ্যালারি ভর্তি দর্শক দেখবে তাঁর পায়ের যাদু। স্কুল জীবনেই ফুটবলার হিসাবে পেয়ে গেছেন বহু পুরস্কার। স্বপ্নের পাখিরা ডানা মেলাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফুটবলার আর হয়ে উঠা হয়নি। স্বপ্নের পাখিরা স্থান নেয় হাসপাতালের অপারেশনের টেবিলে। সেই ফুটবলার হতে চাওয়া কিশোরটি আজ সার্জন হিসাবে বিশ্বখ্যাত। আবিস্কার করেছেন গুগল গ্লাসের মাধ্যমে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে সরাসরি অপারেশন প্রদর্শনের জন্য দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি তাঁর।বিশ্বের সর্বাধিক মানুষ দেখা সরাসরি অপারেশন কারী সার্জন তিনি । লাভ করেছেন আগামীর স্বাস্থ্যসেবা দান কারীর খেতাব। ফিউচার এন এইচ এস পদক। সেরা ব্রিটিশ বাংলাদেশি নয় শুধু, সেরা এশিয়ানের স্বীকৃতি ও পেয়ছেন তিনি।
ডাঃ শাফি আহামেদ। সিলেটের বিয়ানী বাজারের মোল্লার গাঁওয়ের ছেলে। জন্ম বাংলাদেশে। মাত্র চার বছর বয়সে মা বাবার হাত ধরে পাড়ি দিয়েছিলেন লন্ডন। লন্ডনেই বেড়ে উঠা, পড়া লেখা এবং কর্ম জীবন ।
ব্রিটেনের রয়েল লন্ডন হাসপাতাল ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসাবে কর্মরত আছেন। সেখানে তাঁর চেম্বারে বসেই এক বৃষ্টির দুপুরে পাঠকদের জন্য শুনালেন তাঁর জয়যাত্রার গল্প।
আপনে বাংলায় কউকা, আমি ইংলিশে কই
বেশ কয়েকবার ফোনের মেসেজেই যোগাযোগ। গত মাসেই পেয়েছেন, ব্রিটেনের প্রেস্টিজিয়াস ওয়েস্ট মিনিস্টার ফিউচার হেলথ এওয়ার্ড। সারা ব্রিটেন থেকে সংসদ সদস্য কতৃক ৭৫০ জন মনোনীত বিশেষ ব্যাক্তিদের মাঝখান থেকে বিজয়ী হন ডাঃ শাফি। বলেছিলাম, একটা ইন্টারভিউ করতে চাই। কিন্তু সময় বের করা যাচ্ছিল না। হঠাৎ করেই এক বৃষ্টির দুপুরে জানালেন আমি আজকে একটু ফ্রি আছি, আপনি চাইলে আসতে পারেন। কারণ পরের দিনই আবার উড়াল দিচ্ছেন আমেরিকায়।
শুরুতেই প্রশ্ন করেছিলাম ইংরেজীতে না বাংলায় চলবে আমাদের আলাপ আলোচনা?
সিলেটি উচ্চারণে বললেন, আমার বাংলা অতো ভালা নায়, বাট বুঝি সবতা। ভালা অইব, আপনে বাংলায় কউকা, আমি ইংলশে কই”।( আমার বাংলা খুব ভাল না, ভাল হবে আপনি বাংলায় বলুন, আমি ইংরেজীতে উত্তর দেই) ইংরেজি বাংলা মিলিয়েই চলে আমাদের কথোপকথন ।
বেড়ে উঠা সময়ের গল্প…
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে মাত্র ৪ বছর বয়সে লন্ডনে আসেন বাংলাদেশের সেই সময়ের স্মৃতি মনে নেই। পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পড়ালেখা করেছেন। ছাত্রজীবন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করার সময়ও শাফি এবং তাঁর ভাই, বাবার রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায় সাহায্য করেছেন। স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়ার।
ব্রিটেন তখনো বাঙ্গালিদের দেশ হয়ে উঠেনি।উগ্র বর্ণবাদী হামলা সে সময়কার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই পড়ালেখ করে বড় কিছু করার কথা কেউ ভাবতো ও না। সেই সময় মূলত গার্মেন্টসে কাজ করা বা ছোট খাটো ব্যবসা এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ছিল মূলত বাঙালিদের পেশা ।
তাঁদের বাবাও ধরে নিয়েছিলেন পড়ালেখা করে হয়তো বাবার ব্যবসায়ই সন্তানরা সময় দিবে। অথবা বৃহৎ ভাবে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করবে।
কিন্তু মা ছিলেন একটু আলাদা। শাফির নানা সেই আমলেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা পুলিশের ইন্সপেক্টর ছিলেন। তাই পারিবারিক ভাবেই মা’র ঝোঁক ছিল ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করানোর। আর মায়ের সেই প্রচেষ্টায়ই মূলত বাঁক নেয় জীবন। মা বারবার বুঝিয়েছন যাই করো পড়ালেখাটা করতে হবে। পরে বাবা ওসঙ্গী হন সেই যাত্রায়।
একজন মানুষ কতোটা মেধাবী হলে প্রতিটা ক্ষেত্রে সফল হয়! ডাঃ শাফির পরিচিতি শুধু ডাক্তার নয়, তিনি একাধারে শিক্ষক, উদ্ভাবক এবং উদ্যেক্তা সব ক্ষেত্রেই সফল তিনি। পরশ পাথর , যেখানে হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন তিনি। কিন্তু ডাঃ শাফি অন্যদের চেয়ে আলাদা যেখানে, কারণ তিনি কাজ করছেন, চিকিৎসা সেবায় নতুন প্রযুক্তি নিয়ে, উদ্ভাবন করছেন নতুন প্রযুক্তির, সারাবিশ্বে সার্জিকাল শিক্ষায় স্বক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছেন। গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান ভার্চুয়াল মেডিকস। শিক্ষা ও ক্লিনিকাল প্রাকটিসের জন্য ব্যবহার করছেন ওয়ারেবল টেকনোলজি। যেখানে লাইভ স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম এর মাধ্যমে ইন্টারেক্টিভ শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন। সম্প্রতি তিনি গ্লোবাল সার্জিকাল কারিকুলাম প্রকাশ করেছেন। ২০১৪ সালের মে মাসে গুগল গ্লাসের মাধ্যমে লাইভ অপারেশন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন শাফি। ১৩২ টি দেশে ১১০০ শহরের ১৪ হাজার ছাত্র ও প্রশিক্ষনার্থী সরাসরি সেই অপারেশন প্রত্যক্ষ করেন।
২০১৬ সালে ১৪ এপ্রিল বার্টস হেলথ এর সহযোগীতায় বিশ্বের প্রথম ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অপারেশন করে বিশ্ব রেকর্ড করেন। ৩৬০ ডিগ্রী এংগেলে সম্প্রচার করেন। বিশ্বের ১৪০ টি দেশের চার হাজার শহরে ৫৫ হাজার মানুষ সেটি প্রত্যক্ষ করেন। ৪.৬ মিলিয়ন মানুষ টুইটারে সংযুক্ত হয়েছিলেন। বিশ্বের ৪০০র অধিক মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয় ডাঃ শাফির এই কৃতিত্ব। ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্ভর স্ন্যাপচাটের মাধ্যমে প্রথম লাইভ অপারেশন করেন। যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ২০০ মেডিকেল শিক্ষার্থী ও সার্জিকাল প্রশিক্ষনার্থীকে প্রশিক্ষণ দেন। এই অপারেশন এক লাখ মানুষ দেখেছেন।
যেখান থেকে শুরু …
স্কুল কলেজ জীবন থেকেই প্রতিটা ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ডাঃ শফি, ঐতিহ্যবাহী কিংস কলেজ হাসপাতালের স্কুল অব মেডিসিন বিভাগে ১৯৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ১৯৮৯ – ৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল সোসাইটির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন, এবং শিক্ষা কার্যক্রমে মেডিকেলে এথিক্স বিষয় অন্তর্ভূক্ত করতে ভূমিকা রাখেন তিনি। শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রমে অসামান্য ফলাফলের জন্য ১৯৯০ সালে কিংস কলেজ থেকে জেইএলএফ ( Jelf) পদকে ভূষিত হন।১৯৯২ সালে ডায়াবেটিক নিউরোরথ্রোপি: চ্যারকোট যৌথের রোগজাতকরণ “শিরোনামের মূল গবেষণার জন্য তিনি ডায়াবেটিসে ডব্লুজি অকলি পুরস্কার জিতেছিলেন।১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত উইনাইটেড হাসপাতাল টিমের মূল দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। আবার ১৯৯১ থেকেভ ১৯৯৩ সালে ক্রিকেট দলের অধিনায়কের ও দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০৬ সালে এফ আর সি এস ( জেনারেল সার্জন ) ফাইনাল এফআরসিএস ফাইনাল ইন্টারকলিজিয়েট ( আন্তঃ কলেজ ) সম্পন্ন করেন।ডাঃ শাফি ২০০৭ সালে লন্ডনের রয়েল লন্ডন হাসপাতালের লেপরোস্কপি এন্ড কলোরেক্টাল সার্জন কনসালটেন্ট জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
জেনারেল সার্জারীর উপর নিয়েছেন উচ্চশিক্ষা। ২০০৭- ২০০৮ এফ আর সিএস ইংল্যান্ড এফ আর সি এস এডিংবারা, এফআরসিএস আই রয়েল কলজ অব ইংল্যান্ড এডিংবারা এবং আয়ারল্যান্ড থেকে ডিগ্রী লাভ করেন । ২০১০ সালে কলোরেক্টাল ক্যান্সারের উপর পিএইচডি ডিগ্রী নিয়েছেন।
ডাঃ শাফি নিজের প্রতিষ্ঠিত minimally invasive colorectal surgery ‘র একাডেমিক সেন্টারের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর মূল কাজের বিষয় কলোরেক্টাল ক্যান্সার ল্যাপারোস্কপিক এর ক্ষেত্রে তাঁকে প্রবর্তক হিসাবে গণ্য করা হয়। ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলোরেক্টাল ক্যান্সারের বার্টস হেলথ ট্রাস্ট এর নেতৃত্ব দিয়েছেন।২০১৩ সালে রয়েল কলেজ অব সার্জন অব ইংল্যান্ড এর কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। বলিভিয়া, কলম্বিয়া, পেরু এবং স্পেন থেকে ৪ টি সম্মান সূচক ডক্টরেড ডিগ্রী পেয়েছেন।
তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মুল বক্তা (KEY NOTE SPEAKER ) হিসাবে বক্তব্য রেখেছেন। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্বের ২০ টির অধিক দেশে আমন্ত্রিত হয়েছেন বক্তা হিসাবে । লন্ডন মেডিকেল স্কুলে তৃতীয় বর্ষে এবং পঞ্চম বর্ষে ডাঃ শাফির প্রবর্তিত নতুন কোর্স ডিজিটাল হেলথ বিষয়ে ছাত্রদের পড়ানো হয়।
যতো পুরস্কার…
ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলে সাধারণত চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা ছবি বা আনুষাঙ্গিক জিনিস দিয়ে সাজানো থাকে। কিন্তু ডাঃ শাফির চেম্বারে ঢুকে মনে হতে পারে কোন খেলোয়াড়ের ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়েছি। সেলফ জুড়ে বিভিন্ন ক্রেষ্ট আর মেডেল। স্কুল জীবনে ফুটবল ক্রিকেটে পেয়েছেন নানা পুরস্কার। কাউন্টিতে ক্রিকেটও খেলেছেন স্কুল, কলেজ জীবনে। প্রথম পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে। ব্রিটিশ জার্নাল অব সার্জারি প্রাইজ পান ২০০৪ সালে। ২০১৫ সালে পান সিলভার স্কালপেল প্রাইজ। ২০১৭ সালে ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার ১০০ এর, ব্রিটিশ বাংলাদেশি পার্সন অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন।
টপ এশিয়ান ইন ইউকে টেক ২০১৭ সালে, ডিজিটাল লিডার এওয়ার্ড লাভ করেন ২০১৭ সালে সর্বশেষ ব্রিটেনের প্রেস্টিজিয়াস এওয়ার্ড এন এইচ এস ৭০ পার্লামেন্টারি এওয়ার্ড ২০১৮ ফিউচার এন এইচ এস হিসাবে নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে ইসলামিক সোসাইটি অব ব্রিটেন, ব্রিটিশ টেলিকম ইনোভেশন এওয়ার্ড।২০১৩ ও ২০১৭ সালে দুইবার বার্টস হেলথ হিরো হিসাবে নির্বাচিত হন।২০১৭ সালে ডিজিটাল পাইনিওর এওয়ার্ডের জন্য ও শর্ট লিস্টেড হয়েছিলেন শাফি।
শাফি এম আর সি এস এর আন্তর্জাতিক কোর্ট অব এক্সাম এর বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন।উত্তর আমেরিকার দেশ ভলিবিয়ার সরকার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়েছন দেশটিতে। শাফির নামে SAMD যার পূর্নাঙ্গ নাম হচ্ছে শাফি আহামেদ- মার্টিন ডকওয়েলার বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন এবং যার সিইও হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ডাঃশাফি।বিয়ানীবাজার ক্যানসার হাসপাতালের এডভাইজার হিসাবে শুরু থেকেই সহযোগীতা করছেন। বাংলাদেশের মায়েদের মাতৃত্বকালীন সেবা দিতে কাজ করছে নিজের সংগঠন “প্রশান্তি” যার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। Riheted এর শিক্ষক হিসাবে সেখানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। লন্ডন কুইন মেরী ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হিসাবেও শিক্ষকতা করছেন শাফি। বিশ্বের ৪০ টা দেশ সফর করেছেন শাফি কোন না কোন শিক্ষক কিংবা উদ্ভাবক কিংবা উদ্যেক্তা হিসাবে।
ব্রিটিশ বাংলাদেশি ও বাংলাদেশ…
ব্রিটেনে তৃতীয় চতুর্থ প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের বিপ্লব ঘটে গেছে বলা যায়। গড়ে প্রতিটা পরিবারের এক দুইজন ছেলে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে ।শাফি বলেন, আমরা যখন শুরু করি তখন বড়ই দুঃসময় ছিল। আমাদের সামনে বাঙালি বা এশিয়ান কোন রোল মডেল ছিল না। এখনকার প্রজন্মের সামনে অনেক রোল মডেল আছে। এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম খুবই ভাল করছে। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি এবং ফলাফল দেখলেই সেটা বুঝা যায়। ব্রিটেনের প্রতিটা সেক্টরে উচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে আমাদের ছেলেমেয়েরা । তাই ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের ভবিষ্যৎ দিন দিন আরো উজ্জ্বল হবে বলেই তিনি মনে করেন।
ব্রিটেনে বাংলাদেশীরা পারলে বাংলাদেশের বাংলাদেশীরা আবিস্কার বা গবেষণায় পিছিয়ে কেন?
শাফি বলেন, বাংলাদেশে Riheted( রিহেটেড) এর ডিন হিসাবে কাজ করার সুবাদে আমি বাংলাদেশি ডাক্তারদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। বাংলাদেশে প্রচন্ড মেধাবীরা আছেন শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সুযোগের একটা বিষয় আছে। ব্রিটেনে যে উন্নত সুযোগ সুবিধা আছে সেটা কিন্তু বাংলাদেশে নেই। এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগের একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ব্যয়বহূল বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। যার কারণে অনেকেই হয়তো সেই ক্ষেত্রটা পাচ্ছেন না।
দ্বিতীয়ত আমার যেটা মনে হয়, পৃথিবীব্যাপী সংখ্যালঘুদের ঠিকে থাকার এক ধরণের প্রচেষ্ঠা থাকে। সব দেশেই এটা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে হয়তো সেই অর্থে ঠিকে থাকার চাপটা থাকেনা।কারণ বাংলাদেশে জাতিগত ভাবে সবাই সংখ্যাগরিষ্ট, সবাই মূলধারার সাথেই আছে। ব্রিটেনে মূল ধারায় অবস্থান গড়তে একটা প্রতিযোগীতা কাজ করে, সেটা ও একটা কারণ হতে পারে। আর এই কারণেই বাংলাদেশীরা ব্রিটেনে ভাল করছে।
নতুন প্রজন্ম কি বাংলাদেশের সাথে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে , এর কারণ হিসাবে,শাফি বলেন যেখানেই যাই না কেন, নিজের জাতিস্বত্তা বদলানোর সুযোগ নেই, অস্বীকার করার ও সুযোগ নেই। সেটা ধরে রাখা অবশ্যই জরুরী। কিন্তু ব্যস্ততা ও বাস্তবতার কারণে হয়তো সেটা হয়ে উঠছে না।
আমার নিজের ছেলে মেয়ের বয়স ১৪ এবং ১৫ কিন্তু এখনো দেশে নিয়ে যাওয়া হয়নি। এদের নিয়ে দেশে যাওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছা শাফির। নিজের শিকড়ের সাথে বন্ধন টা গড়ে দিতে চান। পূর্ব পুরুষের মাটির সাথে যেন যোগাযোগ টা থাকে। শুধু নিজের সন্তান নয়, ব্রিটেনে বাংলাদেশি ডঃ এসোশিয়শনের সাথে এই ব্যাপারে তিনি কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেন , যাতে করে বাংলাদেশের সাথে নতুন প্রজন্মের একটা সেতুবন্ধন গড়া যায়।
জানতে চেয়েছিলাম প্রযুক্তির কাছে কি তবে মানুষ হেরে যাবে? শাফি বলেন, না, প্রযুক্তি মানুষই তৈরী করছে প্রয়োজনে। প্রযুক্তি কাজগুলোকে সহজ করে দিচ্ছে, পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। ব্রিটেন কিংবা বাংলাদেশের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তি। বাংলাদেশে বসে আপনি ব্রিটেনের মানের সেবা নিতে পারবেন।জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রতিটা ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ ক্ষেত্র তৈরী করে দিচ্ছে প্রযুক্তি। ওয়ারেবল টেকনোলজি, মানে ভার্চুয়াল মাধ্যম সেই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। আগামীর দিন প্রযুক্তির দিন৷ তাই প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে নিতে হবে। মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের।
আলোকিত পরিবার
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা পেয়েছেন বাবা, মিম্বর আলী, মা সুফিয়া খানম। চার ভাই বোনের মাঝে তৃতীয় ডাঃ শাফি । বড় ভাই শামিম আহামেদ এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ার, পাশাপাশি বিমানের যন্ত্রাংশের ব্যবসায় রয়েছে নাম ডাক। বড় বোন স্বপ্নারা খাতুন অক্সফোর্ড থেকে পাশ করা, ব্রিটেনের প্রথম এশিয়ান নারী বিচারক। ছোট ভাই জামি আহামেদ পাতাল রেলের চালক। স্ত্রী ফারজানা হোসাইন ও পেশায় ডাক্তার। দুই সন্তান ওসমান ও জরিনা।
বৃক্ষ যেমন ফলের ভারে নুয়ে পড়ে, মানুষও নাকী জ্ঞানের ভারে বিনয়ী হয়ে উঠে, ডাঃ শাফির সাথে দেখা করতে গিয়ে সেই প্রবাদটাই মনে পড়ল। রয়েল লন্ডন হাসপাতালের রিসিপশন থেকে যখন তাঁকে ফোন দিলাম, কোন ফ্লোরে আসব? তিনি দুই মিনিট অপেক্ষা করার কথা বলে নিজেই নেমে আসলেন, সাথে করে চেম্বারে নিয়ে গেলেন, ইন্টারভিউ শেষে যখন বের হচ্ছিলাম তখনো লিফট পর্যন্ত সাথে এলেন। আমি মনে মনে বাংলাদেশের চিকিৎসার চিত্রটা কল্পনা করলাম!
আগামীর পৃথিবী প্রযুক্তির পৃথিবী,দৈনন্দিন জীবন থেকে চিকিৎসা সবই নিয়ন্ত্রণ করবে প্রযুক্তি। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানে সেই দিন বদলের পথ প্রদর্শক আমাদের দেশের ছেলে ডাঃ শাফি আহামেদ।মানুষ নাকী তার স্বপ্নের চেয়ে বড় হয়। কেউ কেউ আকাশ হতে চায়, কেউ হতে চায় রোদ্দুর। কেউ স্বপ্ন দেখে সাধ এবং সাধ্যের ভিতরে। সেই দিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়,মোল্লার গাঁয়ে জন্মনেয়া ডাঃ শাফির এই জয়যাত্রা হয়তো, চিকিৎসা বিজ্ঞানে, নোবেল প্রাইজ পর্যন্ত পৌঁছাবে। সেই দিনের অপেক্ষায় আমরা।
জুয়েল রাজ: সম্পাদক; ব্রিকলেন