বিশ্বে তরুণদের মধ্যে স্যোশাল মাধ্যম ফেইসবুক ব্যবহারকারী দেশ এর তালিকায় শীর্ষ তিন এর মধ্যে আছে বাংলাদেশ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে কয়েক বছর আগে ‘ফেইসবুক লাইক ব্যবসা‘র খবরও আমরা জানি; ইউরোপের নামী দামী কর্পোরেট কোম্পানীদের কাছে ‘লাইক বিক্রি’র নামে ফেইকলাইক বিক্রির অভিনব প্রতারণার সংবাদে বাংলাদেশ এর নাম উঠেছিল।
শোবার ঘর , রান্নাঘর, বাথরুম থেকে শুরু করে ফেইসবুকীয় শব্দ ‘আক্বাইম্মা কাজ’ কারবারের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দিতে আমাদের তারুণ্যের উর্বর চিন্তাটাকে কী নাম দেয়া যায়- তা এই মূহুর্তে আমার আইকিউতে আসছে না। একটা সুন্দর নাম দরকার এবং আপাতত একটি শ্রীযুক্ত নামের আবেদন দিয়ে ফেসইবুকীয় তারুণ্যের অনুভূতি কথায় ঘুরে আসা যেতে পারে-
ধর্ষিত-অগ্নিদগ্ধ নুসরাত এর হৃদয়বিদারক সংবাদে কয়দিন থেকে ফেইসবুক স্টেস্টার্স, কমেন্টসে বিগলিত শব্দে আমরা ফেইসবুকে প্লাবিত। গালিভরা শব্দ [ জা..‘ টা, ইত্যাদি ব্যবহার করে] প্রকাশ্য ফাসি থেকে শুরু করে অপরাধীর চৌদ্দগোষ্টির নামে গালিগালাজে আমরা সিংহভাগ তারুণ্য বলা যায় ‘কিছু দিনের জন্য ফরজকাম’ মনে করে লেগে পড়েছি।
আমাদের আবেগ, উচ্ছাস, ক্রোধের শব্দমালায় ফেইসবুকে বাধঁভাঙ্গা জোয়ারের মতো ফ্রেন্ডস থেকে মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ডস,তারপর পাবলিকে বিস্তৃত হচ্ছে। সাথে যোগ হয়েছে আরেক সংযোজন- বিভিন্ন পেইজ বা গ্রুপে ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদের ভিডিওতে নিজের বা পেইজের নাম বসিয়ে নিজেকে প্রচারের কৌশল। ‘ভাইরাল করুন‘ বা ‘ভাইরাল নিউজ, শেষ পর্যন্ত দেখুন, না দেখলে মিছ’ ইত্যাদিতে আসলে আমরা মৌজে যে আছি সেটা স্বীকার করতেই হয়।
ফেইসবুকে এইসব ঘটনাগুলো আসলেই কী আমাদের তারুণ্য মন ভিতর থেকে ছুয়ে যায়? ছোয়ে যাচ্ছে? সেগুলো বোধের আলোয় দেখলে, এসব বুঝতে বোধ করি বেশী সময় ব্যয় করার দরকার পড়ে না।। ধর্ষণ বা ইভচিটিং, নির্যাতন অথবা বর্বরতার দুই তিনটি ফেইসবুক স্টেটার্সের নিচের কমেন্টসগুলো পড়লেই আমাদের ভেতরে লুকানো ‘সার্বজনীন আমি’ কে বুঝতে বোধ করি বেগ পেতে হবে না। স্ট্রং ল্যাংগুয়েজ, নির্বোধ শব্দমালা, সমাজ,সরকার,প্রশাসনকে গালিগালাজ এর চর্চাই বেশী হয়ে থাকে।
প্রতিদিন ঘটছে অসংখ্য দানবীয়, নারকীয় বা নি:শংস ঘটনা। আছে প্রসাশনিক দুর্বিত্তায়ন। এটাকে যেমন অস্বীকারের উপায় নাই। তেমনি এ থেকে বের হয়ে আসার জন্য জাগরণ, প্রতিবাদ, বিদ্রোহেরও যে বিকল্প নেই, সেটাও তো আমরা জানি।
মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপের আলাদা ভাষা এবং প্রকাশভঙ্গী আছে। তারুণ্যও তাদের ভাষায় প্রকাশভঙ্গীতে কথা বলছে এবং বলবে এটাই স্বাভাবিক। স্যোশাল মিডিয়াতে সামাজিক কনর্সানগুলোতে তারুণ্যের একটি বড় অংশের প্রতিক্রিয়া বা তাদের চিন্তার প্রকাশটাকে কতটা সপ্রতিভ, প্রত্যয়ী এবং সংগ্রামমূখী এইসব-ই ফেইসবুকে ভাসতে থাকা অসংখ্য নিউজ ফিড দেখে বুঝা যায়।
বাংলাদেশের তারণ্য, হোক বয়সে অথবা হোক মনের দিক বিবেচনায় ; আমাদের একটা প্রমিত শক্তি আছে। তা হলো- প্রতিবাদ, প্রতিরোধ,জাগরণ।
আশার দিকও আছে। আমাদের কিছু তারুণ্য প্রতিনিয়ত অসংখ্য অন্যায় অবিচার বা জগন্যতম ঘটনাগুলো কোন না কোন ভাবে স্যোশাল মিডিয়াতে তুলে ধরছে। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন, ডাকসুর ভিপি নির্বাচন দুটোকে তারুণ্যের চিন্তা চেতনার পজিটিভ বহি:প্রকাশও বলছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।
সাম্প্রতিক সময়ে আবার মোটাদাগে উচ্চারিত হচ্ছে , তরুন ফেইসবুক ইউজারদের সামাজিক চেতনাহীন এবং বৈকল্য চিন্তা চেতনায় বেড়ে ওঠা নিয়ে।প্রশ্ন ওঠেছে-তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেন শব্দ-বর্ণমালায় শুধু জোকারবার্গসের ফেইসবুকে বন্দি হয়ে আছে? যে কোন কিছুতেই তাদের মন্তব্য- প্রতিমন্তব্য করতে যেমন দেখা যায়, তেমনি, ভাষাতেও যুক্ত হয়েছে গালিগালাজ, বিদ্বেষ আর ঘৃণা। নিজের দায়িত্বকে আড়াল করে অন্যের কাধে দোষ চাপিয়ে চলার মানষিক বৈকল্যবান্ধব সংস্কৃতি চর্চা কোন ভাবেই শুভ সংবাদ নয়।
এই ‘শা..র‘..ফাসি চাই, কু‘.. বাচ্চাকে জ্যান্ত পুতে ফেলো, আসতাগফিরুল্লাহ;এটা নাস্তিকদের কাজ, কাফির নাসাদের কাজ, সংখ্যালঘুদের যাবার আর জায়গা নেই, হিন্দু বলেই আমাদের মারা হচ্ছে, এই দেশ আমার না, আমীন না লিখে যাবেন না, ইত্যাদি শব্দমালায় আজকাল ফেইসবুকিয় আবেগ অনুভূতি মিশেল প্রতিবাদ জোরেসুরে চলছে-ই।
সহজ বাস্তবতা হলো- যে সব ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত, সেগুলো থেকে নিজেকে আলাদা করার কী কোন উপায় আছে। ……ধর্ষিতা তরুণী তো আমাদেরই বোন, ধর্ষক তো আমাদেরই সমাজের এক পাষন্ড। বাঙালির সামাজিক রীতিনীতি বা ঐতিহ্যিক রীতিনীতিগুলো সমাজে অনেক হার্দিক ভাবে আমরা করি। উৎসব, সংস্কৃতির সব আয়োজনেও আমাদের আত্নীক সম্পর্কিত শিষ্টাচার আছে। তো, সেখানে,আমাদের পাড়া,প্রতিবেশী,আপনজন বন্ধুদের বেলায় নিপীড়ন ঘটলে আমরা শুধু নিজেকে বাচানোর মন-মানষিকতায় শামুকে মতো নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি কেন। আমাদের প্রতিবাদের ভাষা উচ্চকন্ঠ, মুষ্টিবদ্ধ, একত্রিত হচ্ছে না কেন? আমাদের তারুণ্যরা তো অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ভালো সুবিধায়, ভালো পরিবেশে, ভালো মানের শিক্ষা- সুবিধায় বড় হচ্ছে। তাদের নিজস্ব জগতে দ্বিধা -দ্বন্দ আর শুধু নিজেকে নিয়ে থাকা ও ভাবার চিন্তার ট্রেন্ড তৈরী হচ্ছে কেন? আবেগ অনুভূতি ফেইসবুকীয় হয়ে যাবার মোটা দাগে কারণ কী ?
যে মেয়েটি ইভচিটিং এর শিকার হচ্ছে, সে এই সবুজ তারুন্যদ্বীপ্তের বোন না হলেও স্পষ্টত, পাড়ার অন্য কোন তারুণ্যের ছোট বা বড় বোন। বন্ধু অথবা প্রতিবেশী। তাদের বাড়িতে কোন আচার, অনুষ্ঠান হলে তো এই তারুণ্যই সবার আগে দাওয়াত পায়। পেট ভরে খায়, আনন্দে ভাসে। সুন্দরী সহপাঠি হলে এরাই তো প্রেমে পড়ে, ভালোবাসতে মন চায়।পাড়ার বোনের আদুরে শাসনে নির্ভরতা পায়। তো, তার কিছু হলে আমাদের সঙ্গবদ্ধ প্রতিবাদটা উবে যায় কীভাবে? এসব দেখে শুনে হাজার তরুণের রক্তকণিকা ঠান্ডা থাকে-ই বা কী করে? প্রমিত ভাষায় অথবা খিস্তিখেউড়ি দিয়ে স্যোসাল মিডিয়াতে ঝড় তুলে সমাজ অথবা রাস্ট্রব্যবস্থার চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধারে স্যোশাল মিডিয়াতে শব্দমালায় থাকাকে অনেকে কেন প্রতিবাদ প্রতিরোধ ভাবছেন, রাস্তায় না নেমে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে সৃষ্ট জাগরণটি কেন স্থায়িত্ব পায় না? পাড়ায় মহল্লায় প্রতিনিয়ত ঘটছে বর্বরতা। বিভৎসতায় ছেয়ে আছে চারপাশ।এভাবে চলতে থাকলে নতুন প্রজন্মের কাছে একসময় মনে হবে, এইসব বর্বরতা যাপিত জীবনেরই একটা অংশ।
আমাদের ভোতা অনুভূতিতে একটা বড় ধাক্বা দেয়া দরকার। নিজেকে নিজের আয়নায় দাড় করার সময় অনেক আগেই এসেছে। আমাদের একটা জাগরণ দরকার। সাংস্কৃতিক সামাজিক একটা পাগলাটে হার্দিক ভালোবাসার জাগরণ এর ক্ষেত্র তৈরী করার দায়িত্বও আমাদের।
গায়ে একটি চিমটি দিয়ে দেখুন, অল্প হলেও ব্যাথাটা যদি বুঝতে পারেন। প্রতিদিন বাইরে যেতে গায়ের জামাটা পাল্টাতে যেমন আয়নায় দাড়ান। প্রতিদিন কম করে হলে ২০বার যেমন স্যোশাল মিডিয়াতে ইন হোন; নিজেকে আপডেপ রাখেন, লাইক, কমেন্টস করে নিজেকে তারণ্যের দলে উজ্জীবিত রাখতে ভালোবাসেন। তেমনি ভাবে, আপনার পাশের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধেও দাড়ান। প্রতিবাদ প্রতিরোধ, জাগরণে তৃণমূলকেই জাগতে হয়। জাগাতেও হয়। কোন কালে, কোন সভ্যতায়, থানা- পুলিশ এইসব কাজে আগে দাড়ায় না। বরং তৃণমূল জনগণ দাড়ালে প্রশাসন পাশে বাধ্য হয়েই কাছে থাকে।
ঘুম থেকে ওঠে গালে রেজার ব্লেড লাগানোর আগে নিজেকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে; একজন তারণ্যের সৌন্দর্য আসলে কোনটি। সুঠাম দেহ আর ক্রেজ চেহারা? নাকি মানবিক ব্যক্তিত্ববোধ। আপনার সুঠাম দেহের পাশ দিয়ে আপনার প্রতিবেশী বোনকে পাশবিক নির্যাতন করে দিব্যি চলে যাচ্ছে একটা নরপশু। আর আপনি আতর-গোলাপে পাড়ায় আড্ডাবাজি, ফেইসবুকে লল, লাইক, রিঅ্যাক্ট নিয়ে থাকবেন, নাকি কর্পোরেট নটা-পাচটা অফিস, রেস্তোরায় আলো-আধারিতে প্রেম আর পুড়া মাংস খেয়ে সময় পার করবেন অথবা হবু বৌ নিয়ে বাচ্চা উৎপাদন ও তার ভবিষ্যত পরিকল্পনায় থাকবেন।
বাইরে যাবার সাজগুজের সময় তারণ্য মেয়ে আপনারও বোধেরআয়নায় দাড়িয়ে ভাবার সময় এসেছে- মুখের লিপস্টিকের সৌন্দর্যকে যে কামগন্ধ খুজে, তাদের কাছে নিজেকে সুন্দরী প্রকাশের চেষ্টার চেয়ে মেরুদন্ড সোজা ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরাটা কতটুকু যৌক্তিক এবং সময়ের দাবী। যে দেশে ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতিদিন কালো মেয়েকে ধর্ষণ করছে করপোরেট সমাজ, সেখানে শক্তপায়ে দাড়াবার শক্তিতে আপনারা কতজন শিক্ষিত তরুণী উচ্চকণ্ঠ ও সংঘবদ্ধ। যাস্ট কিডিং, লল ইত্যাদি চেয়ে অনেক দামী এবং শক্তিশালী হতে একটি প্রতিবাদের জাগরণী ডাক।
নারী মানেই তো মা। মা তো দেশ-ও। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিহত নুসরাত এর উপর পাশবিকতার বিচারে নিজে তদারকি করছেন বলে সংবাদপত্রে এসেছে এবং এর তাৎক্ষনিক ফলাফলও সংবাদপত্রে প্রকাশ পাচ্ছে। তো, ঘরের মা এবং দেশের মা তো জেগেই আছে। তারুণদের জাগরণে বাধা কোথায়। অনুপ্রেরণা, পথের পথিক, নির্ভরতা এবং শেষ পর্যন্ত লেগে থাকার কাজে সন্তানের জন্য একজন মা-ই যথেষ্ট।
পাঠক,দুজনে মিলে একটি সিনারিও আঁকি….
ভোরবেলা, ফ্রেস হয়ে, দুজনে লম্বা একটা নি:শ্বাস নেই। এবার দুজনে নিজেদের আয়নায় দাড়াই। মনের শুদ্ধতা নিয়ে আয়নায় চোখে চোখ রাখি। তারপর, তনু থেকে নুসরাতদের ইনসিডেন্টগুলো একটু মনে করুন! এবার এদের পাশে আপনার আত্নজা বা ভালোবাসার মানুষটির মুখটিকে রাখি। তারপর ধীরে ধীরে তনুদের ছবিতে আত্নজার ছবিটি কপি করে বসাই। কেমন লাগছে দেখতে? চোখটা কি ভয়ে ছোট হচ্ছে ? নাকি, রক্তলাল হতে শুরু করেছে? হাতের আঙ্গুল কী মুষ্টিবদ্ধ হতে চায়। নাকি অনুভূতি নাই সেখানে ও?
শুরুতে ফেসবুকীয় শব্দ ‘আক্বাইম্মা’ কাজ কারবারের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দিতে আমাদের তারুণ্যের উর্বর চিন্তাটাকে কী নাম দেয়া যায় জানতে একটি শ্রীযুক্ত নামের আবেদন রেখে ছিলাম। সেটার কথা আপাতত বাদ দিন। এই মূহুর্তে আপনার আত্নজার শ্রীযুক্ত ছবিটি দেখে আপনার অনুভূতি কথা জানতে চাইছি। এই সিনারিওটি আমার বোধের আয়নার। আপনি অনেক সৃজসশীল, মেধাবী। আপনার জাগরণ আপনার মতো। স্যোসাল মিডিয়াতে সেটার একটা ফিডব্যাক জানাতে পারেন। তবে জাগরণটা যেন তৃণমূলে; হাটে, মাঠে, পাড়ায়, পথে, ঘাটে , আলো, অন্ধকারে সব জায়গায় সমান তালে ধারাবাহিক হয়।
অনুপ্রেরণার ঘাটতি হলে মা‘দের কথা ভাবুন। একজন প্রতিকী মা রাষ্ট্র চালাচ্ছে; সেও এই বর্বরতার বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে। আরেকজন মা, ঘরে বসে প্রতিদিন তার মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় পার করছে রাতদিন….
লেখক : আ নো য়া রু ল ই স লা ম অ ভি : কবি , সাংবাদিক, লন্ডন