ইজিপ্টে নেমে প্রথম দিনে আমরা ঠিক করে ফেলি কর্মপন্থা অর্থাৎ কোন দিন কোথায় যাব, কী করব। ইজিপ্ট যেহেতু ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশ সব ইতিহাসের খোঁজ নিতে গেলে কয়েক মাসেও সম্ভব হবে না; আমরা এসেছি মাত্র এক সপ্তাহের জন্য।
প্রথম দিন বিকেলে ওল্ড মার্কেটে গিয়ে ট্যুর কোম্পানির খোঁজ করতেই পেয়ে গেলাম। তাদের অনেক প্যাকেজ; সবগুলো প্যাকেজ যেহেতু যাচাই করা সম্ভব নয়; অগ্রাধিকার ঠিক করে নিতে হলো। আমাদের চার সদস্যের প্রত্যেকেরই অগ্রাধিকার ছিল; ছাটাই করে সমঝোতা করতে হলো।
চারজন সদস্যের অগ্রাধিকার তালিকায় দেখা গেল পিরামিড আছে। কারো বা প্রথম কারো দ্বিতীয় কেউ তৃতীয়। আমার তালিকার প্রথমেই পিরামিড ছিল। যদিও পিরামিড একটা স্থাপনা মাত্র কিন্তু এর আবেগি মূল্য অনেক। আবেগটা হচ্ছে সদা প্রভু জেসাস জন্মের কয়েক হাজার বছর আগেই মানুষ চিন্তায় এবং প্রযুক্তিতে এত অগ্রসর ছিল বর্তমান সময়ের সাথে তুলনা করলে কূলকিনারা পাওয়া যায় না।
যেহেতু আমাদের চারজনের তালিকাতেই পিরামিড ছিল সেহেতু অবধারিতভাবে পিরামিড দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই সম্মতি প্রদান করল। ইজিপ্ট ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে পিরামিড দেখতে যাব স্থির করে ছিলাম কিন্তু ট্যুর কোম্পানির ভদ্রলোক বলল তাড়াহুড়ার কোন প্রয়োজন নেই। শার্ম-আল-শেখের দর্শনীয় স্থানগুলো প্রথমে দেখে নিয়ে একটু সুস্থির হয়ে পরে পিরামিড দেখতে যাওয়া যাবে।
শার্ম-আল-শেখ থেকে কায়রো তথা কায়রোর উপকণ্ঠ গিজার (যেখানে বিখ্যাত নয়টি পিরামিড আছে) প্রায় ছয় ঘন্টার জার্নি। যেতে ছয় ঘন্টা আসতে ছয় ঘন্টা। ম্যানচেস্টার থেকে শার্ম-আল-শেখের দূরত্ব ২৫৬৫ মাইল প্লেনে যেতে সাড়ে পাঁচ; ছয় ঘন্টা লাগে। শার্ম-আল-শেখ থেকে কায়রোর দূরত্ব ৩১৫ মাইলের মত।
এই দূরত্ব অতিক্রম করতে বাসে প্লেনের মতোই সময় লেগে যায়। আমরা ট্যুর কোম্পানির ভদ্রলোকের উপদেশ আমলে নিয়ে প্রথমে স্থানীয় দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখতে শুরু করি।
শার্ম-আল-শেখে গেলে পর্যটকরা যা দেখে তাই আমরা দেখলাম। মাঝেমধ্যে নিজেদের মত করে অর্থাৎ ট্যুর গাইড ছাড়া এখানে সেখানে গেলাম। বিশেষ করে কোন বিখ্যাত মার্কেট কিংবা সমুদ্র সৈকত।
ইজিপ্টে আসার আগেই কিছু হোম ওয়ার্ক করে এসেছিলাম আমার মেয়ে দর্শনীয় কিছু তালিকা নিয়ে এসেছিল। ট্যাক্সি ডাকি এবং তালিকায় একটা একটা করে টিক দেই।
সিদ্ধান্ত হলো ইজিপ্ট বাসের চতুর্থ দিন আমরা ফেরাউনদের দেখতে যাব। ট্যুর কোম্পানি থেকে বলা হল সম্ভব হলে দিনে ঘুমিয়ে নিতে কারণ রাত বারোটা সাড়ে বারোটার দিকে বাস আসবে সারারাত বাসেই থাকতে হবে। ঘুমাবার জন্য কেউ ছুটি কাটাতে যায় না আমাদেরও তাই ঘুম হলো না।
রাত পৌনে একটার দিকে বাসে চড়ে বসলাম। বাস চলতে শুরু করলো। খেজুর বৃক্ষের গোড়ায় আলো লাগানো থাকায় রাস্তার পাশের প্রতিটি খেজুর বৃক্ষকে এক একটি ফেরাউন মনে হল। বাস প্রায় যাত্রীতে পরিপূর্ণ। ভাগ্য কখনো আমার জন্য সুপ্রসন্ন হয় না, কোথাও বেড়াতে গেলে সবচেয়ে বাজে আসন আমার জন্য জুটে। কিন্তু দেখা গেল পিরামিড যাত্রায় আমি এবং আমার অর্ধাঙ্গিনী দুজনেরই ভাগ্য খুলে গেছে। অর্থাৎ আমরা যে আসনে বসেছি আমাদের পাশের আসনের দখল নিতে অন্য কেউ এলো না।
আমরা দুজনেই জুতো খুলে ভালো করে আসন গেড়ে বসলাম। আমাদের বলা হলো ঘন্টা তিনেক পরে বিরতি নেবে অর্থাৎ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চাইলে ঘন্টা তিনেক পরে তা সম্ভব হবে। যদিও ট্যুর কোম্পানি থেকে বলা হয়েছিল বাসে শৌচাগার আছে কিন্তু ড্রাইভার মহাশয় বললেন শৌচাগার অচল হঠাৎ ব্যবহার উপযোগী নয়।
অগত্যা তিন ঘন্টা চেপে বসে থাকলাম যদিও খুব বেশি চাপ ছিল না তবু হালকা হতে পারলে আরো একটু স্বস্তি পেতাম। রাতের ইজিপ্ট খেজুর বৃক্ষের গোড়ায় কৃত্রিম আলো ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ রাতে ইজিপ্ট খুব একটা দর্শনীয় বলা যাবে না।
আমরা তন্দ্রা বা তন্দ্রালু অবস্থায় তিন ঘন্টা কাটিয়ে বিরতির মুখোমুখি হলাম। আমাদের বলা হলো এখানে হালকা হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে। বাস থেকে নেমে দেখলাম সারি সারি ল্যাট্রিন। মেলায় কিংবা বড় জমায়েতে যে হালকা ল্যাট্রিন সরবরাহ করা হয় সেরকম কয়েকটি ল্যাট্রিন। সময় মাত্র ত্রিশ মিনিট।
প্রতিটি ল্যাট্রিনের সামনে দীর্ঘ সারি। ত্রিশ মিনিট সময় দীর্ঘ সারিতে দাঁড়ালেই চলে যাবে কখন হালকা হবো বুঝতে পারছি না। স্ত্রী ছেলে এবং মেয়ে ল্যাট্রিনের জন্য অপেক্ষা না করে পাশের ক্যাফেতে ঢুকে পড়ল। সামান্য স্ন্যাকস যদি কিনতে পারা যায়!
আমি ল্যাট্রিনের অপেক্ষায়। প্রায় ১৫ মিনিট পরে আমার সময় এলো ল্যাট্রিনে ঢুকে দেখলাম আমাদের দেশে নদীর পাড়ে যে উন্মুক্ত শৌচাগার দেখা যায় সেরকম অবস্থা। কিন্তু প্রবল চাপে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নাই কোনরকম ব্লাডারের প্রেসার কমিয়ে বেরিয়ে এলাম।
স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের ল্যাট্রিন এর অবস্থা বর্ণনা করতে চাইলে তারা হাসতে লাগলো। কেন হাসছে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল ক্যাফের ভিতরে উন্নত মানের বেশ কিছু শৌচাগার আছে যেগুলোতে তেমন কোনো ভিড় নেই। সেসব শৌচাগারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে হালকা হওয়া যায়। আমি যে বললাম কোন যাত্রায়ই আমার ভাগ্য সু-প্রসন্ন হয় না; প্রমাণ হচ্ছে পাঁচ তারকা টয়লেট বাদ দিয়ে টাট্টিখানায় নিজেকে বিলীন করা।
বাসে ফিরে এলাম ছেলে মেয়েদের খরিদকৃত স্যান্ডউইচ এবং এবং আমের শরবত খেয়ে গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম ভাঙলো ভোর সাড়ে ছটায়। খুব ভাঙ্গার পরে প্রথমেই স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালাম দেখলাম খুব রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কী বিষয় ভ্রমণেও এমন দৃষ্টি কেন! সে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে আমার নাসিকা গর্জনে বাসের সবাই অত্যন্ত বিরক্ত। আমার নাসিকা গর্জনের কারণে অন্য কারো নাকি ঘুম হয়নি।
কথাটা যে ডাহা মিথ্যা এর প্রমাণ হচ্ছে আমার ঘুম একবারও ভাঙ্গেনি; আচ্ছা আপনারাই বলুন আমি যদি এত জোরে নাক ডাকিয়ে থাকি তাহলে এমন গভীর ঘুমালাম কিভাবে!
বাস থেকে নামার সময় অন্যান্য পর্যটকরা আমার নাসিকায় দৃষ্টি নিবন্ধন করতে থাকলো, পর্যটকদের মধ্যে আমার নাক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল। আমার নাম হয়ে গেল মিস্টার স্নরিং।
আমাদের প্রথম স্টপ হচ্ছে ইজিপ্ট মিউজিয়াম। সঙ্গে যে গাইড জুড়ে দেয়া হল তার ইংরেজি কথা শুনে সবাই থ। তার ইংরেজিকে পুনরায় ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হবে। তার পিছনে হাঁটা অযথা মনে করে আমাদের লব্ধ জ্ঞান তথা গুগল থেকে আরোহিত জ্ঞান মিলিয়ে দেখতে লাগলাম।
মিউজিয়ামে দেখার মত অনেক কিছু আছে। আড়াই হাজার বছরের পুরনো মমি। ফেরাউনের কবর খুঁড়ে প্রাপ্ত অমূল্য ধনসম্পদ ছাড়াও মিউজিয়ামের প্রতিটি দেওয়ালে ইতিহাস উৎকীর্ণ আছে।
ফেরাউন এবং তাদের মমি নিয়ে আমার আগ্রহ থাকলেও আমি মনে মনে সেই মহান ব্যক্তিকে খুঁজছিলাম যার মাথায় প্রথম পিরামিড ভর করেছিল। আমি খুঁজছিলাম সেই মহান স্থপতিকে যে পিরামিড ডিজাইন এবং নির্মাণ করেছে।
ইজিপ্ট মিউজিয়ামের প্রথম তলায় তাকে পেয়ে গেলাম। ভদ্রলোকের নাম হেমিউনু (Hemiunu)। খ্রিস্টপূর্ব ২৫৭০ সালে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। ভদ্রলোকের এক আবক্ষ মূর্তি মিউজিয়ামের প্রথম তলার করিডোরে রাখা আছে। তার সামনে গিয়ে আপনা আপনি মাথা নত হয়ে গেল। শোনা যায় রাজা রাজরাদের জন্য পিরামিড বানানোর কাজ শেষ হলে নিজের জন্যও ক্ষুদ্র একটা পিরামিড বানিয়েছিল সেখানে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল।
আমরা প্রতাপশালী ফেরাউনদের মনে রাখি। ইতিহাসের পাতায় তাদের বীরত্বের কথা সদর্পে উচ্চারণ করা হয়। ইতিহাসের প্রতিটি পাতা তাদের সম্মানে নত হয়ে যায়। কিন্তু যে ব্যক্তি তাদেরকে অমর করার জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে তাকে আমরা তেমন স্মরণ করি না। স্মরণ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না।
তাজমহলের কথা উঠলে অবধারিতভাবে শাহজাহান চলে আসেন অথচ শাহজাহানের বাবা জাহাঙ্গীরের চৌদ্দ পুরুষের ক্ষমতা হতো না তাজমহল বানানোর যদি উস্তাদ আহমদ লাহারি চিন্তা, পরিকল্পনা এবং সাহস নিয়ে এগিয়ে না আসতো। তাজমহল এবং শাহজাহান বারবার উচ্চারিত হয় আহমদ লাহারির কথা কেউ মনে রাখে না।
ইজিপ্ট মিউজিয়াম জীবনে একবার হলেও ঘুরে আসা উচিত কারণ একটাই; আজ থেকে ৬-৭ হাজার বছর আগে মানুষের চিন্তা চেতনা কেমন ছিল ধারণা করতে পারবেন। ৬-৭ হাজার বছর আগে মানুষ যতটুকু অগ্রসর ছিল ৬-৭ হাজার বছর পরে চিন্তা করলে মনে হয় গত কয়েক হাজার বছর মানুষের ইতিহাসে বন্ধ্যা সময় গেছে। এখনো মানুষ আছে বন্ধ্যা সময়ে। ৬-৭ হাজার বছরে মানুষ বিন্দুমাত্র এগোয়নি।
ইজিপ্ট মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা গেলাম গিজায়। এখানে পৃথিবী খ্যাত নয়টি পিরামিড আছে। পিরামিড দেখতে আহামরি কিছু নয়। পিরামিডে কোন বিকল্প সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয় না। তবু মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, মানুষের সক্ষমতা অনুভব করতে চাইলে, দেখতে চাইলে একবার পিরামিডের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়।
আবু মকসুদ : কবি, সম্পাদক, শব্দপাঠ, লন্ডন