আজ থেকে দুই বছর আগে যখন মায়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে অনেকটা প্রাণ ভয়ে আরাকান রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গারা লাখে লাখে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছিল তখন যেমন এইসব অসহায় মানুষদের প্রতি মানবতা দেখাতে, ঠাঁই দিতে কার্পন্য করেনি বাংলাদেশ সরকার ঠিক তেমনি নিজেদের নিরাপত্তা এবং বর্তমান বাস্তবতায় এসব শরনার্থী রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো ছাড়া আর কোন বিকল্প ভাবছেনা সরকার। এ ব্যাপারে শুরু থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে কোন রকম গাফিলতি কিংবা চেষ্টার কমতি আছে বলে মনে করি না। সরকার তাঁর সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য। নানান সময় মায়ানমারের পক্ষ থেকে উস্কানি দেওয়া হলেও সরকার সেই ফাঁদে পা দেয়নি বরং ঠাণ্ডা মাথায় বিশ্বকে সাথে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চলেছে। আর যে কারণেই জাতিসংঘ থেকে শুরু করে মানবতায় বিশ্বাসী বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সাং সুচির বিভিন্ন পদকসহ সম্মান সূচক ডিগ্রি যখন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গুলো ফিরিয়ে নিচ্ছে এমনকি জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নির্যাতনের জন্য সরাসরি সূচিকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছে তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভুমিকার ভুয়সী প্রশংসা করছে গোটা বিশ্ব।
এ ধরণের পরিস্থিতি এর আগে বাংলাদেশ কখনো মোকাবেলা করেনি কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সেই অভিজ্ঞতার হয়তো কমতি আছে কিন্তু এ নিয়ে কুটনৈতিক তৎপরতা থেকে শুরু করে যা যা করণীয় সরকার তার সবটুকুই করে চলেছে। তারপরও দ্বিতীয়বারের মতো ভেস্তে গেলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। প্রথম দিকে মায়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে নানান টালবাহানা, ছলচাতুরি, গড়িমসি এমনকি তাদের পক্ষ থেকে এমনও বলা হয়েছে রোহিঙ্গারা সেই দেশের লোক নয় বরং বাঙ্গালী। সময়ের ব্যবধানে মায়ানমার এখন একটু সুর পাল্টেছে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর থেকে পরিস্থিতি একটু পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অনেকটা এরই ফলস্বরুপ রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মায়ানমার টেকনিক্যালি রাজি হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে মায়ানমারের ছাড়পত্র পাওয়া তিন হাজারের অধিক রোহিঙ্গার গত ২২ আগষ্ট প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস-ট্রাকসহ সবকিছু প্রস্তুত থাকার পরও প্রত্যাবাসনের প্রথম দফায় তালিকাভুক্ত কোন রোহিঙ্গা নিরাপত্তার অজুহাতে নিজ দেশে যেতে রাজি হয়নি যার ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন ক্যাম্পে সুযোগ সুবিধা কমানো হবে। বিভিন্ন মাধ্যমে যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেসব এনজিও এবং বিদেশী সংস্থা কাজ করছে তাদের একটা অংশ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে রোহিঙ্গাদেরকে ভুল বুঝানোর চেষ্ঠা করছে। শুধু তাই নয় ভয়ঙ্কর বিষয় হলো রোহিঙ্গাদেরকে দেশীয় অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগে ‘মুক্তি’ নামে একটি এনজিও‘র কার্যক্রম বন্ধ করেছে সরকার। এছাড়াও ৩৩টি এনজিওকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অনেক সংস্থা প্রধান মিডিয়াতে প্রকাশ্যেই বলছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনের পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। সেখানকার পরিবেশ নিয়ে যেসব মানবাধিকার কর্মী খুব উদ্বিগ্ন এখানকার পরিবেশ বিপর্যয় কি তাদের চোখে পড়েনা? কক্সবাজারের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে। পাহাড় কেটে গড়ে তুলছে বসতঘর। গাছপালা কাটছে কারণে অকারণে। আর সেই সাথে রোহিঙ্গাদের অপকর্ম এবং হিংস্রতা ইতোমধ্যেই সীমা ছাড়িয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে গত দুই বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ৪২ জনই হচ্ছে রোহিঙ্গা শরনার্থী। শুধু নিজেদের মধ্যেই খুন-খারাপির ঘটনা থেমে নেই বরং তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় এক যুবলীগ নেতাকে তারা হত্যা করেছে। তারা সমাবেশ করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে হুমকি দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। অথচ নিজ দেশ থেকে যখন বের করে দেওয়া হয় তখন টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি।
দুই বছর আগে রাখাইনে যখন মানবতা আগুনে পুড়ে, বেয়নেটের খোঁচায় এবং মিয়ানমারের আর্মিদের বুটের নিচে পিষ্ট হচ্ছিল বিশ্ব বিবেক-বিশ্ব মানবতা তখন নির্বিকার নিস্তব্ধ ছিল। রাখাইনের রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত মুসলিম সম্প্রদায়ের লাখ লাখ মানুষের আর্ত চিৎকারে যখন চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে আসছিল তখনো বিশ্ব বিবেক তথা মানবতার ঝান্ডা ঊড়ানো কোন বিশ্ব মোড়ল এগিয়ে আসেনি। এমনকি সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম দেশান্তরি হচ্ছিল তখনো নীরব দর্শকের ভুমিকায় ছিল বিশ্ব মুসলিমদের সংগঠন ওআইসি। দিক-বেদিক কোন আশ্রয় প্রশ্রয় না পেয়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অতি মানবিকতায় সেদিন আশ্রয় পেয়েছিল বাংলাদেশে। নিজ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়াটা এতো সহজ কাজ ছিল না। বিশাল জনগোষ্ঠীর এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলে ইস্যু না পাওয়া বিরোধীদল বিষয়টিকে কিভাবে দেখবে সর্বোপরি দেশের জনগণইবা কি ভাববে এ নিয়ে নিশ্চয়ই কঠিন ভাবনায় পড়েছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। কি করবেন ? একদিকে নিজ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী তার উপর আবার অন্য দেশের লাখো মানুষ ঢুকার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে সীমান্তে। এমন অবস্থায় সকল অনিশ্চয়তাকে পেছনে ঠেলে মানবতার কাণ্ডারী হয়ে খুলে দিয়েছিলেন সীমান্ত। অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব নেতারা সেদিন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল মানবতা কাকে বলে এবং কিভাবে মানবতা দেখাতে হয়। আর তাই তো লন্ডনের একটি পত্রিকা সেদিন শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অফ হিউমিনিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
বর্তমান বাস্তবতায় এসে সেই মানবতা কাল হতে বসেছে। যারা সেদিন শুধুমাত্র জীবন বাঁচানোর জন্য একটু মাথা গোজার ঠাঁই চেয়েছিল সেই তারাই এখন বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাচ্ছে। উড়ে এসে জুড়ে বসার অবস্থা এখন রোহিঙ্গাদের। নিজ দেশে যেখানে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হয়নি নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশান্তরিত হতে হয়েছে, সেখানে বিগত দুই বছর জামাই আদরে খাইয়ে পরিয়ে রাখার ফল দিতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি থেকে বের করে দিয়েছে প্রতিবাদ তো দুরে থাক একটি কথা পর্যন্ত বলতে পারেনি অথচ তারা এখন সমাবেশ করে (!)। শুধু সমাবেশই নয় তাদের অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। তারা স্থানীয় একদল দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট তৈরি করছে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন ন্যাশনাল আইডি এবং পাসপোর্টসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। এই সময়ের মধ্যে আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে ৩২ জন রোহিঙ্গা। যারা মাদকসহ বিভিন্ন অপকর্মের সাথে লিপ্ত ছিল। শুধু তাই নয় রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপকর্মের জন্য এ পর্যন্ত ৪৭১টি মামলা হয়েছে। যেখানে আসামী রয়েছে এক হাজারের অধিক রোহিঙ্গা। তাদের এই অপরাধ প্রবণতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
এবার প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হওয়ার পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হলো। রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র যে চলছে তা আরও স্পষ্ট হলো। খুব সহসা যে এই অনাকাঙ্খিত সমস্যার সমাধান হচ্ছে না সেটা বুঝা যাচ্ছে। মানবিকতার কারণে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেওয়া হলেও সিদ্ধান্তটি যে অনেকটা আবেগী ছিল সেটা দিন যত যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে। হয়তোবা ’৭১ এর সেই যুদ্ধকালীন আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ প্রাণভয়ে ভারতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। এই আবেগটিই প্রধানমন্ত্রীকে আবেগ তাড়িত করেছে।
একে তো বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বোঝা টানতে গিয়ে আমাদের অগ্রসরমান অর্থনীতি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তার উপর আবার রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক আচরণ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভাবিয়ে তুলেছে। তারপরও সর্বোচ্চ ধৈর্য্য শক্তি দিয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকার। কিন্তু এটাও সত্যি সাধারণ মানুষ বিশেষ করে স্থানীয় বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী দিনকে দিন রোহিঙ্গাদের আচার আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। এই বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটার আগেই যদি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দ্বার খুলে যায় তবেই মঙ্গল। আর তা না হলে পরিস্থিতি যে কোন দিকে মোড় নিবে তা বলা মুশকিল।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সরকারকে দায়ী করে ব্যর্থ হিসেবে আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছে বিরোধীদলীয় কিছু নেতা। এই মুহুর্তে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকবে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে অর্থাৎ দেশের প্রয়োজনে সকল রাজনৈতিক দলের উচিৎ সকল ভেদাভেদ ভুলে দেশকে সবার উপরে বিবেচনায় নিয়ে জাতীর ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা, যেন মানবতা কাল না হয়ে দাড়াঁয়।
গাজী মহিবুর রহমান : কলাম লেখক