লিওনেল মেসি। আর্জেন্টাইন সুপার স্টার থেকে এখন হয়ে উঠেছেন ফুটবল বিশ্বের শাসক। জীবন্তকিংবদন্তী লিওনেল মেসির নামের আগে বিশেষণের পর বিশেষণ দিতে দিতে ফুটবল ভাষ্যকাররা এখন হয়রান প্রায়। প্রতিনিয়তই তিনি যেমন নিজেকে ভাঙ্গছেন ভিন্ন ভিন্ন রুপে ;তেমনি ফুটবল ইতিহাসের রের্কড বুকে উলোট পালট করে যাচ্ছেন- ক্লাব কিংবা দেশের হয়ে মাঠে নামার পরেই।
বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হবার পরে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলতে আবারো নীড়ে ফিরে আসেন লিওনেল মেসি। দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়ে দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল সংস্থা কনমেবল পুরো আর্জেন্টিনা দলকেই সংবর্ধনা দেয়। এই সংবর্ধনা দিতে গিয়ে তাহারা দুটি সৃজনশীল ঘটনার জন্ম দেন। প্রথমতো দুই কিংবদন্তী পেলে এবং ম্যারাডোনার পাশে একমাত্র জীবন্ত কিংবদন্তী হিসাবে লিওনেল মেসির মূর্তি স্থাপন করে তাহাকে সম্মানিত করে ; আরেকটি চমক দেন কনমেবল প্রেসিডেন্ট আলেহান্দ্রো দমিনগেজ মেসির হাতে একটি “ব্যাটন” তুলে দিয়ে ঘোষনা করেন -বিশ্ব ফুটবল এর শাসক হিসাবে।
বিশ্বফুটবলে ইতিপূর্বে সন্দেহাতীতভাবে দুটি নাম সমান্তরালে উচ্চারিত হতো পেলে -ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করার পরে, সেখানে যুক্ত হয়েছে লিওনেল মেসির নাম।আশ্চর্যজনকভাবে তিনজনই ল্যাটিন আমেরিকার মাটি হতে শাসন করেছেন বিশ্ব ফুটবল ময়দান।
যেখানে মেসিকে সেই অঞ্চলের সভাপতি ঘোষিত করছেন বিশ্ব ফুটবল এর শাসক হিসাবে। একজন খেলে যাওয়া চলমান প্লেয়ারের জন্য এর চাইতে বড় ট্রপি আর কি হতে পারে! ঘোষনার পরের ম্যাচেই হ্যাট্রিক করে মেসি ঢুকে পড়েন সেঞ্চুরিয়ান ক্লাবে।
ইরানের স্ট্রাইকার আলী দাঈয়ি এই সেঞ্চুরিয়ান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৪৮ ম্যাচে ১০৯ গোল করেন। তারপর আলী দাঈ কে ছাড়িয়ে যান আরেক কিংবদন্তী পর্তগালের স্ট্রাইকার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তিনি এ পর্যন্ত ১৯৮ ম্যাচে ১২২ গোল করে এখনো পিছনে আছেন।
লিওনেল মেসি সেখানে মাত্র তৃতীয় ফুটবলার হিসাবে প্রবেশ করেন এই সেঞ্চুরিয়ান ক্লাবে।
অন্য দুজনের আগে স্ট্রাইকার শব্দটি থাকলে ও মেসি ফুটবলার হিসাবেই আলোচিত হবেন কারন প্লে-মেকার হয়ে গোলের রেসে চলে আসা খুবই অস্বাভাবিক এবং বিরলতম ঘটনা।
আরেকটি মাজার তথ্য অবশ্য যোগ করা যায় -যে মেসিকে কিছুদিন আগেও শুধু ক্লাবের ফুটবলার ভাবা হতো ,বার্সার প্লেয়ার বলে তীর্যকভাবে বল ছোড়া হতো, দেশের হয়ে নিবেদিত প্লেয়ার না বলে অযাচিত সমালোচনা করা হতো; সেই লিওনেল মেসিই কিনা জাতীয় দলের হয়ে ১৭৪ ম্যাচে করেন গোলের সেঞ্চুরী (১০২ নট আউট)। ।
সেটিও ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম প্লেয়ার হিসাবে এবং একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ী প্লেয়ার, যার সাফল্যের বাকেটে আছে জাতীয় দলের হয়ে গোলের সেঞ্চুরী।
বাঁ পায়ের এই জাদুকরের শততম গোলটি এসেছে ডান পায়ে! তাও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার ঠিক শততম দিনে!।
জাতীয় দলের হয়ে মেসির হ্যাট্রিক মোট ৯ টি। যেখানে রোনালদো শীর্ষে আছেন মোট ১০ টি হ্যাট্রিক নিয়ে।
ক্যারিয়ারে দ্রুততম ৮০০+ গোলের মালিক লিওনেল মেসির হ্যাট্রিক সংখ্যা ৫৭ টি। এখানে ও শীর্ষে আছেন রোনালদো মোট হ্যাট্রিক ৬২ টি নিয়ে। ৮০০ গোলের মাইলফলকে পৌছতে রোনালদোর লেগেছিলো -১০৯৫ ম্যাচ। মেসির সেখানে লেগেছে ১০১৬ ম্যাচ। ৭৮ ম্যাচ কম।
মেসি শেষ দুই বছরে যেভাবে ক্যারিয়ারের অন্তিম সময়ে এসে জাতীয় দলের হয়ে গোল করে এবং সতির্থদের দিয়ে গোল করিয়ে দেশ এবং বিশ্বকেই চমকে দিচ্ছেন ;সেটাই আসলে তাহার ফুটবল শাসক হবার রাস্তা তৈরী করে দিয়েছে।
ল্যাটিন চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে কোপার ফাইনালে হারিয়ে “কোপা আমেরিকা” চ্যাম্পিয়ন।
ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালী কে হারিয়ে ফাইনালিসিমা জয় এবং সর্বশেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স কে ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনালে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার পথে মেসি বিশ্বকাপের প্রতিটি পর্বে গোল করেছেন আর্জেন্টিনার হয়ে এবং করিয়েছেন চারটি এসিস্ট; পাচঁবার ম্যান অব দ্যা ম্যাচ। প্লেয়ার অব দ্যা টুর্নামেন্ট। আসলে জাতীয় দলের হয়ে মেসির এই স্কোরার -প্লেমেকার সহ নানা রুপ যেমন বিমোহিত করে ক্রীড়াপ্রেমিদের তেমন পরিসংখ্যানের বইয়ে একটি অস্বাভাবাবিকতার সৃস্টি ও কি করে যাচ্ছেন না এই এলএমটেন!
কারণ পরবর্তী প্রজন্ম যদি পরিসংখ্যান দেখে মেসিকে জাজ করতে যায় তাহলে নির্ঘাত তাদের মাথা আউলা হয়ে যেতে পারে।
কারণ যার ৩৫০+ এসিস্ট, সে আবার একই সাথে ৮০০+ গোল করলো কি করে? কিংবা যার ৬ টা গোল্ডেন বুট সে আবার আইএফএফ এইচ এস প্লেমেকার হিসাবে জিতেছে সর্বচ্চো পদক ৩ বার ।
পিচিচ ট্রপি জিতেছেন -৮ বার এইটা দেখে যতটা না অবাক হবে তার চাইতে বেশী হতবাক হয়ে যখন আবিস্কার করবে এক বছরে সর্বোচ্চ গিনেস বিশ্ব রেকর্ড (৯১ টি) গোলদাতার নাম ঐ লিওনেল মেসি এগেইন।
অথচ ফুটবলার হিসাবে মাথা এবং ডান পায়ের ব্যবহার নাই বললেই চলে।
ম্যাজিশিয়ান মেসি অবশ্য ভাব নিয়ে বলতেই পারেন – আরে ফুটবল খেলা। এ আবার কঠিন কি? -এ তো আমার বাঁ পায়ের খেল!
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক
টরন্টো। কানাডা। ত্রিশ মার্চ ২০২৩ সাল।
আরও পড়ুন: