অভিষেকের আগেই বাংলাদেশ ক্রিকেট এর সবচাইতে টেকনিক্যাল সাউন্ড ব্যাটসম্যান তকমা জুড়ে গিয়েছিল মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং এর ধরণ দেখে। উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান হিসাবে যখন জাতীয় দলের দরজায় নক করছিলেন তখন বাংলাদেশ দলের উইকেট কিপার হিসাবে ছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট। সে সময়ে বিশ্বের উইকেট কিপারদের মাঝেও টেকনিক এর দিক দিয়ে পাইলট ছিলেন -অন্যতম একজন। এবং বাংলাদেশের লোয়ার অর্ডারের ব্যাটিং এর শেষ ভরসা হিসাবে পাইলটের বিকল্পও ছিল না। কারণ বাংলাদেশ সে সময়ে ৫০ ওভার ব্যাটিং করার লক্ষ্য নিয়ে খেলতো। দুজন উইকেট কিপার খেলানোর মতো বিলাসী সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু মুশফিক এর ব্যাটিং এর ধরণ ,টেকনিক ,বল ছাড়ার বিচক্ষণতা এবং ডিফেন্স দেখে নির্বাচকরাও যেন তাকে বাজিয়ে দেখার লোভ আটকে রাখতে পারেন নি! আর পারেননি বলেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবে মুশফিকুর রহিমের জাতীয় দলের প্রথম অভিষেক হয় ওয়ানডের পরিবর্তে টেস্ট ক্রিকেটে।
ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রিকেটের আবাসভূমি খ্যাত লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে । ২০০৬ সালের ২৬ মে লর্ডস এ অভিষিক্ত প্লেয়ার হিসাবে মুশফিক ছিলেন (১৭ বছর ৩৫১ দিন) সবচাইতে কনিষ্টতম।
মাত্র ১৯ রানের ছোট্ট একটি ইনিংসেই প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন বিশ্বের মূলধারার ক্রিকেট মিডিয়ায়। নাসের হুসাইনের মতো গ্রেটরা পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন এই বেবি ফেইসের।
পরর্বতীতে ওয়ানডে এবং টি ২০ ক্রিকেটে শুধু অভিষেকই নয় ।একেবারে জাতীয় দলের কাপ্তান হিসাবে দলের ব্যাটিং ভরসার নাম হয়ে উঠে মুশফিকুর রহিমের। উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ডটি-ও করেন এই লিটল চ্যাম্পিয়ন। দেশের হয়েও প্রথম ডাবল সেঞ্চুরী করেন মুশফিক।
কিন্তু মুদ্রার অন্য পীঠের মতো ব্যাটিং অফ ফর্মের কারণে ২০০৮ সালে দল থেকে বাদও পড়েন। এবং পরবর্তিতে বাংলাদেশের অন্যতম এক ‘ডিসিপ্লিন প্লেয়ার’ হিসাবে খ্যাত মুশফিক ফিরে আসেন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে।
মুশফিকুর রহিমের জেদ এবং ইমোশন যেমন তার শক্তির-অনুপ্রেরণার উৎস তেমনি, সমালোচনার ক্ষেত্রটি- ও তৈরী করে দেয় প্রতিনিয়ত। উইকেট কিপার হিসাবে দলে থাকলে ও মুসির ব্যাটিং ছিলো অগ্রগণ্য । উইকেট কিপিং এ অসংখ্য ফাম্বল করতেন এবং সেটার মর্মপীড়া পুরো ম্যাচে টেনে নিয়ে যেতেন- যার ফলে ব্যাটিং এর সময়েও সেটার প্রভাব পড়তো দৃষ্টিকটুভাবে। এই ইমশনের সাথে যুক্ত জেদ এর কারণে ক্যাপ্টেন- কোচ অনেকবার বলার পরেও মুশফিক -কিপিং গ্লাভস ছাড়েননি । যদিও শেষ পর্যন্ত ছেড়েছেন দলের প্রয়োজনে কিন্তু আবার গ্লাভস পরেছেন ।
টি 20 ক্রিকেটের জোয়ারে কপিবুক স্টাইলের ব্যাটিং কিন্তু হারিয়ে যায়নি -বিরাট কোহলিরা ঠিকই রান করে যাচ্ছেন কিন্তু মুশফিকরা কেমন জানি আটকে যাচ্ছিলেন আবার নতুনদের জন্য সরেও যাচ্ছিলেন না। টিম ম্যানেজমেন্ট কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও এতো দীর্ঘ ক্যারিয়ার বিবেচনায় বার বার যেন রিভিউ নিচ্ছিলেন। এক সময় টি 20 থেকে নিজেই সরে গিয়ে নির্বাচকদের দম ছাড়ার সুযোগ করে দেন।
২০২৩ এর ওয়ান ডে বিশ্বকাপে মুশফিকের খেলার সম্ভাবনা অলরেডি রেফার হয়ে গিয়েছিল- থার্ড আম্পায়ারে অর্থাৎ মাঠের চাইতে মাঠের বাহিরের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
একমাত্র কাপ্তান তামিম ঘোষণা দিলেন -তার নেতৃত্বাধীন বিশ্বকাপ দলে মুশফিক শুধু যাচ্ছেনই না ; সাথে কিপিং গ্লাভসও থাকবে মুশির হাতে।
এরই মাঝে দলের কোচ হিসাবে যুক্ত হলেন -কড়া হেড মাস্টার হাথুরে। তামিম- হাতুরে কম্বিনেশনে ফেয়ারলেস ক্রিকেট খেলার নকশা প্রণয়নে দুজন মুশিকে ক্রুশাল ব্যাটিং অর্ডার ৬/৭ এ উইলো বাজির জন্য তার কাধেঁ ভরসার হাত রাখলেন। টিমের ব্যাটিং কম্বিনেশনের সাথে লোয়ার অর্ডারের সাথে পার্টারশীপ এবং জেনুইন ক্রিকেটীয় শট খেলার এভিলিটির সাথে স্কুপ এন্ড আন অর্থডক্স শট খেলার সক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখার- ‘বিশ্বাস’ দিলেন তামিম ইকবাল। সিনিয়রদের গ্রুপিং নিয়ে মিথ তৈরী করা বোর্ডের মুখের উপর বলে দিলেন- তামিমের সমর্থনের জন্যই দেশের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে এই দ্রুততম ইনিংস খেলতে পারলেন।
ব্যাটিং এর ধরণ এবং একই সাথে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া ইনিংসটি খেলতে মুশফিক বল খেলেছেন মাত্র ৬০ টি।
১ টি ছক্কা এবং ১৪ টি চার মারের মিশ্রণে তৈরী আইরিস বোলিং এর উপর চালানো এই সুনামির স্ট্রাইক রেইট ছিলো ১৬৬।
দেশের হয়ে আরেকটি রের্কডময় দ্রুততম ইনিংস খেলে যেমন জাতীয় দলে নিজের বাউন্সব্যাক করলেন। তেমনি কাপ্তান আর বোর্ড কর্তাদেরও কী নিশ্চয়তা দিয়ে দিলেন যে, বিশ্বকাপ যাত্রায় মিস্টার ডিপেন্ডেবল হয়েই হাল ধরছেন উইকেটের সামনে এবং পিছনে। দল এবং দেশের চাওয়াও তেমন। বেবি ফেইসে অভিষিক্ত মুশফিক এবার হয়ে উঠুন একজন ফিনিশার।
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক
টরন্টো। কানাডা। ১ এপ্রিল ২০২৩ সাল।
আরও পড়ুন: