আখলাকুর রহমান যিনি আখি রহমান নামে পরিচিত, ব্রিটেনে বেড়ে উঠা বাংলাদেশী বংশদ্ভোত একজন মানুষ । তিনি হাঁটতে-দৌড়াতে ভালবাসেন, ভালবাসেন দুঃসাহসিক অভিযানে যেতে । এই দুঃসাহিসকতাই তাঁকে আরও প্রত্যয়ী করে তোলে, তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে যান দুঃসাহসি অভিযানে । এই সংকল্প একসময় হয়ে যায় তাঁর মানবিক কর্মযগ্গের অংশ । যেখানেই মানবিক কোন আহবান থাকে, সেখানেই তিনি সাড়া দেন, এমনকি জীবন বাজি রাখতেও পিছপা হননা । এভাবেই আখি এ যাবৎ সহযোগীতা করেছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে, যার কোন অর্থ লেনদেনে তিনি থাকেন না, শুধুমাত্র কাজ করেন তাঁর সামর্থ দিয়ে।
রমজান মাস শুরু হবার আগে তাঁরই একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম । গিয়ে দেখলাম, লন্ডনের একটা জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের (চ্যানেল এস) কর্নধারসহ ঐ চ্যানেলে কর্মরত অনেক সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত হয়েছেন । একটা জমজমাট অনুষ্ঠান, বেশ গোছালো মনে হল। অনুষ্ঠানটা আয়োজন করা হয়েছে ব্রিটেনে বাংলাদেশী বংশদ্ভোত আখি রহমানকে উপলক্ষ করে । আখি রহমানের নাম শোনেছিলাম , পাশের শহর ওল্ডহ্যামে থাকেন। এই শহরেরই এক পরিচিত মুখ গণমাধ্যম কর্মী মুহাম্মদ জুনেদের সাথে আছে তাঁদের পারিবারিক ক্যাটারিং ব্যবসা। এখানে আমরা বসি, গল্প করি । প্রায়ই আমি এই শহরে যাই, কিন্তু তাঁর সাথে আমার দেখা হয় নি, তাই তাঁকে উপলক্ষ করে অনুষ্ঠান, সেজন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত হই । সেখানে গিয়ে দেখা হয় আরেক তরুণ অভিযাত্রী ইমরানের সাথে, যিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটছেন, চার মাস আগে এরকম এক অভিযানে হাড়গোড় ভেঙ্গেছেন । তাঁকে নিয়ে লিখবো অন্য সময় ।
আখি পর্বত আরোহী ।২০২০ সালের জুলাই মাসে আফ্রিকার তানজিনিয়ার সর্বোচ্চ পর্বত (উচ্চতা ৫৮৯৫ মিটার) কিলিমানজারো জয় করে চিহ্ন আাঁকেন প্রথম সাফল্যের। পরে এ বছরেই ফ্রান্সের সর্বোচ্চ (৪৮১০ মিটার) পর্বত মন্ট ব্লংক, এবং অক্টোবরে নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ (চ্যালেন্জ নিয়ে) হয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে রশিয়া ও ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত এলব্রস জয় করেন। এরপর ২০২১ সালে পৃথিবীর একটা দুর্গম পর্বত নেপালের হিমালয় আমাদা ব্ল্যাম জয় করেন তিনি। উচ্চতায় যা ৬৮৫৬ মিটার।
মাত্র তিন-চার বছর আগে পর্বত আরোহণ শুরু করে ইতিমধ্যে এভাবেই তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছোট-বড় অনেক পর্বত আরোহণ করেছেন এবং জয় করেছেন । এবার তিনি গেছেন এভারেষ্ট জয়ে । ১১ এপ্রিল নেপালের মাউন্ট এভারেষ্ট জয়ের জন্য তিনি যাত্রা শুরু করেছেন । যুক্তরাজ্যের কোন বাংলাদেশী এযাবৎ এভারেষ্ট জয়ের দুঃসাহসী অভিযানে যায় নি । ৮৮৪৮ মিটার উচু এই পর্বত জয় করেছেন ইতিপূর্বে বাংলাদেশের দুজন পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার ও আব্দুল মুহিত।
যতটুকু জেনেছি, এভারেষ্ট আরোহণ করতে ব্রিটেন থেকে সব মিলিয়ে খরছ পড়তে পারে প্রায় ৩৫ হাজার পাউন্ডের (৪০ লাখ টাকারও বেশী) মত । এ নিয়ে চ্যানেল এস আখিকে ফান্ড সংগ্রহ করতে সহযোগীতা করেছে । তাঁর এ যাত্রাকে উপলক্ষ করে রমজান মাসে রোজা রেখে পর্বত আরোহণের মত কঠিন কাজে মানুষের সমর্থন নিয়ে রমজান ফ্যামিলি কমিটমেন্ট (আর এফ সি) নামের একটা চ্যারিটি সংগঠনের জন্য তারা এ অর্থ সংগ্রহ করে । এ সংগঠনের আওতাধীয় রমজান মাসে ২৬ টা ফান্ডিং এ্যপিল হয় রমজান মাসে । বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠন, মসজিদ প্রভৃতির নামে এ এ্যাপিলগুলো হয়ে থাকে ।
ধাক্কা খেলাম প্রথমেই । এলাম আখির প্রগ্রামে, দেখি ‘আর এফ সি’ । কিন্তু ঐ যে আগে উল্লেখ করেছি, আখি যেখানেই মানবতার ডাক এসেছে, সেখানেই ছুটে যান । সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল, আখি রহমান এই অভিযানে যাচ্ছেন রমজান মাসে এবং তিনি রোজা রেখেই এই পর্বত আরোহণ করবেন । স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি আছে এতে, অন্যদিকে ব্রিটেনে রমজান এ্যপিলগুলোও মূলত ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করেই হয় । সুতরাং উপস্থিত দর্শকদের সাড়া দেখে আমিও বিস্মিত হয়েছি সেদিন । প্রায় এক লাখ পাউন্ডের প্রতিশ্রুতি চ্যানেল এস (আর এফ সি) পেয়ে যায় ঐ সন্ধ্যায় । পরে খবর নিয়ে জানলাম, আখির এ উপলক্ষে যে অর্থ আসবে, তা যাবে ঐ সংগঠনটিতে। তবে চ্যানেল এস লন্ডনের কিছু ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীদের দিয়ে তাঁর যাতায়াত কিংবা আনুসাঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ করতে পুরোপুরি সহায়তা করেছে বলে জানালেন ঐদিন উপস্থিত থাকা চ্যানেল এস এর চীফ রিপোর্টার মোহাম্মদ জোবায়ের। অন্যদিকে ওল্ডহ্যামেও আখিকে নিয়ে অনুষ্ঠান হয়েছে, যাতে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরাও কিছু অনুদান সংগ্রহ করেছে ।
রমজান মাস এমনিতেই ব্রিটেনের সকল বাংলা টিভি চ্যানেগুলোর জন্য একটা চমৎকার মাস । এ মাসে এই চ্যানেগুলোতে কোন বিনোদন থাকে না। শুধুই থাকে ধর্মীয় ভাব-গাম্ভির্যে ভরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান। দিনের প্রায় ১২ টা ঘন্টা তারা ব্যয় করে শুধুমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে বিভিন্ন সংগঠনের চাঁদা সংগ্রহ করতে । মুসলমান, আরও সওয়াব, পরকাল, বেহেস্ত প্রভৃতিতে দর্শকরা বছরের পর বছর থেকে অর্থ দিয়ে যাচ্ছে । সাধারন মানুষ মনে করে একটা ভাল কাজেই তারা দিচ্ছে তাঁদের অনুদান । মানুষ খোঁজ নেয় না এই অর্থের, কোনদিনই পায় না আয়-ব্যয়ের হিসাব । শুধু তাই না, ব্রিটেনে থেকে প্রচারিত কিছু পাকিস্থানী অর্থাৎ উর্দুভাষী চ্যানেগুলোও একই কাজ করে ।
সহজ কথায় প্রতিবছর রমজান মাসে টিভি চ্যানেলগুলোর এ এক ব্যবসায়িক উদ্যোগ, কারন তারা এই সময়ের জন্য শ্লট ভাড়া দিয়ে থাকে । চলছে দেড় যুগেরও বেশী সময় থেকে । অত্যন্ত জনপ্রিয় এই এ্যপিলগুলো । আগে আগে দেশ থেকেও আসতেন কর্মকর্তারা বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানার জন্য অর্থ উত্তোলন করতে । এবারেও কানাডার একটা মসজিদের জন্য অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে । পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এরকম উদ্যোগ আছে কি-না জানি না। উৎসবের মত এ আয়োজনে এখন দেশ থেকে আর কোন মসজিদ মাদ্রাসার হয়ে কাউকে আসতে দেখা যায় না। কারন ব্রিটেনেই গজিয়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান । ব্রিটেনে চ্যারিটি সংগঠন করা কোন অবৈধ কিছু নয় । ব্রিটেনে তথা পৃথিবীর অনেক বড় বড় স্বেচ্চাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম জানে মানুষ, জানে এদের বাৎসরিক হিসাব-নিকাষ । আমরা জানি রেড ক্রসের প্রধান নির্বাহী কত বেতন নেন । এদের ঘাটলেই পাওয়া যায় প্রশাসনিক ব্যয় কিংবা বাৎসরিক আয় ব্যয়ের হিসাব । কিন্তু ব্রিটেনের বাংলাদেশীরা কি জানেন তাদের ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ প্রদান করা অর্থগুলো কোন্ কোন্ খাতে ব্যয় হয় । তাঁরা অবশ্য একটা খাত জানেন, সেটা হল তারা আবেগ মাখানো ফুটেজ দেখেন এবং মনে করেন এই জায়গায়ই যাচ্ছে সব টাকাগুলো ।
ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে মাঝে মাঝে ম্যরাথন দৌড় হয়, যে কেউ নিজেকে স্পন্সর করতে পারে এই ভাল কাজের জন্য। একটা বিখ্যাত সংগঠন চিলড্রেন ইন নীডের জন্য এমনকি বিবিসিকেও কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড তোলে দিতে দেখেছি । শিশুদের বেড়ে উঠা, শিক্ষা প্রভৃতি খাতে সারা দেশব্যাপি এ অর্থগুলো ব্যয় করে থাকে তারা । ব্রিটেনে প্রতি সপ্তাহে লটারী থেকে প্রাপ্ত অর্থের আয়-খরছ শেষে ব্রিটেনের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ক্রীড়া-সংস্কৃতিতে বন্টন করা হয় সারা বছর ব্যাপি এ অর্থ। আমরা জানি এই অর্থগুলো যায় কোথায় । এই-ই হলো ভলান্টারী সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা । আর সেজন্য প্রশ্ন আসতেই পারে, ব্রিটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটিকে কিংবা আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে যারা চাঁদা সংগ্রহ করছেন, তার ক’টি সংগঠন এই সচ্ছতা নিয়ে কাজ করছে । চ্যারিটিতে অর্থ প্রদান অন্যায় নয়, বরং এটাই মানবিক কাজ । মানবতাও এটাই শিক্ষা দেয় আমাদের । পৃথিবীর সকল ধর্মও তা-ই বলে । কিন্তু যারা স্বচ্ছতা নিয়ে আসছে না, যারা ব্যক্তিগত লাভালাভের হিসাব দেখছে, এটা দেখার দায়ীত্ব তাদের, যারা অর্থ প্রদান করছেন । ব্যবসায়িরা ব্যবসা করে, কে চ্যারিটিকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে, এটা ভেবে দেখতে হবে । কারন অনেককেই দেখেছি, যারা চ্যারিটি সংস্থা করার পর ফুলে-ফ্যাপে উঠেছে ।
হয়ত এ বোধটি মানুষের মাঝে এসেছে এবার । রমজান মাস শেষ হবার তিনিদিন আগে একটা এ্যপিল দেখলাম । পনেরো-বিশ মিনিটেও কোন অর্থের প্রতিশ্রুতি এলো না । একপর্যায়ে উপস্থাপক বললেন, অনেকে কিছু বললাম কিন্তু অর্থ উত্তোলনে যারা অন্য রুমে কাজ করছেন, তারাতো নিস্ক্রিয় হয়ে বসে আছেন—–গর্ভবতী মহিলাদের সাহায্য করতে, আফ্রিকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে এগিয়ে আসার জন্য পরে তিনি্ আবারও আহবান জানাতে থাকেন দর্শকদের ।
জানিনা মহামারী কি মানুষকে কিছুটা হলেও অভাবগ্রস্থ করেছে, না-কি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি মানুষকে বাস্তবমূখী করছে, না-কি সরকারী ভাতায় কিছুটা টান পড়েছে । না-কি মানুষের বোধে কোন প্রকার ক্লিক করছে । ফেসবুকে একজন দেখলাম স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, বলেছেন, এবার চাঁদা সংগ্রহে ভাটা পড়েছে । চ্যারিটি সংগঠনগুলোর চাঁদা সংগ্রহ করতে তাঁর পেশার জায়গা থেকে থেকে সহযোগীতা করেন, এমন একজন জানালেন, এবারে অর্ধেকে নেমে এসেছে অর্থ উত্তোলন।
আখি রহমান এ কমিউনিটির, এ প্রজন্মের অনন্য এক উদাহরণ । এরা সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। আখি নিজে্ই বলেছেন তিনি এমন কিছুই চান, যাতে তাঁর সন্তানরা কিংবা কমিউনিটি অনুপ্রাণিত হবে ভালো কাজের প্রতি, দুঃসাহসিক কাজ করতে আগাবে তারা । আখি রোজা রেখে তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই যেমন মানবিক কাজে মানুষের সমর্থন দিতে কমিউনিটিকে প্রাণিত করেছেন, কমিউনিটিও তাঁকে সমর্থন করছে । ইতিহাসের পাতায় চিহ্ন রাখা আখি রহমান’র মত মানুষগুলো মানবিক কাজেই এগিয়ে যাক এভাবে। শুধু ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটিই নয়, জবাবদিহীতা আর স্বচ্ছতার উদাহরণ রেখেই এদের দুঃসাহসকে, এদের প্রেরণাকে কাজে লাগাই যেন আমরা বিশ্বময় ।