কামাল লোহানী; একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ যোদ্ধাই নন, এদেশের সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুধু একটি নামই নন, তিনি চির বিদ্রোহের একটি অধ্যায়। একটি ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ; স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন- সর্বক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকা একজন অসাধারণ যোদ্ধা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ যোদ্ধা বলেছেন। কামাল লোহানীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা আরো বলেছেন, তিনি বাঙালির ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। একজন আদর্শবান ও গুণী মানুষ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের আর্দশ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা এবং দেশের সংস্কৃতি বিকাশের আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।
স্বাধিকার আর অধিকার আদায়ে চিরবিপ্লবী বাঙালির এক অকুণ্ঠ কণ্ঠস্বর কামাল লোহানী আমাদের জাতির অহঙ্কার। একটি ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়। তাকে হারানো মানে একটি ইতিহাসের গতি থেমে যাওয়া। তাকে হারানো মানে একটি সোনালি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।
কামাল লোহানীর পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে তার জন্ম। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে কামাল লোহানীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ভাষা আন্দোলনের বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময়ই যুক্ত হন রাজনীতিতে। যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে। পাবনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলন যোগ দেন। এরই মধ্যে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। যুক্ত হন রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চায়।
১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিলে নুরুল আমিনের আগমনের প্রতিবাদ করায় প্রথম গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করায় দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে ছাড়া পান। এরপর পারিবারিক মতবিরোধের কারণে ঢাকায় চলে আসেন। চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় ওই বছরই দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তার। একই বছর তিনি ন্যাপে যোগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তার ছিল দৃঢ় ভূমিকা। শতবর্ষ পালনের আয়োজনে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে তিনি বজ্রসেনের ভূমিকায় অংশ নিয়ে প্রশংসিত হন। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’র সাধারণ সম্পাদক হন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন।
কামাল লোহানী ১৯৬০ সালে চাচাতো বোন সৈয়দা দীপ্তি রানীকে বিয়ে করেন৷ ২০০৭ সালে ২৪ নভেম্বরে স্ত্রীর মৃত্যুতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। এ দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী।