যদি কিছু মনে না করেন, তা’হলে অবয়বপত্র ব্যবহার এবং ওটাতে আমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে ক’টা কথা কইবার আছে। অবয়বপত্রের মূল উদ্দেশ্য পারস্পরিক যোগাযোগ, সংবাদ ও চিত্র আদানপ্রদান, নানান বিষয়ের ওপরে তথ্য ও জ্ঞানের সহভাগ করে নেয়া ইত্যাদি। এ কাজগুলো সঠিক ও দায়িত্বশীলভাবে করার জন্যে অবয়বপত্র কতৃপক্ষ স্বাভাবিকভাবেই কিছু বিধিনিষেধ বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। আমরা যারা অবয়বপত্র ব্যবহার করি, তাদেরও শালীনতা, পরিশীলতা, সংবেদনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু নিজস্ব নীতিমালা মেনে চলা ঊচিৎ।
সবচেয়ে দৃষ্টিকটুটা দিয়েই শুরু করা যাক।অহরহ আমরা প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধব, চেনা-পরিচিতের প্রয়াণ-সংবাদ অবয়বপত্রে সহভাগ করছি। প্রায়শ:ই দেখি, কেউ কেউ তিনটি ইংরজী অক্ষরে তাদের মনোভাব জানাচ্ছেন – RIP. এটা অশোভন এবং কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। এটা লিখে কি আমরা বোঝাতে চাইছি? একটি বাক্য লেখার মতো আমাদের সময় নেই, নাকি আমরা যে কত পশ্চিমী, চটপটে আর আধুনিক? আপনার মনোভাব যই হোক ন কেন, এমন লেখা একজন প্রয়াত মানুষের প্রতি তুচছ- তাচ্ছিল্যের মোক্ষম উদাহরন। আমরা যদি একজন চলে যাওয়া মানুষের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা ও সম্মান না দেখানোর জন্যে অন্তত: পক্ষে একটি পূর্ণ বাক্য না লিতে অপারগ আ অনীহ হই, তার চেয়ে কিছু না লেখাই ভালো। সেটা করলে সম্মান না জানালেও, অন্তত:পক্ষে আমাদের অশ্রদ্ধা থেকে প্রয়াত মানুষটি রেহাই পাবেন।
এ ব্যাপারটিরএকটি পাদটীকা আছে। মাস তিনেক আগে কেউ একজন আমাকে HBD জানিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম, তিনি আমাকে আনন্দিত জন্মদিন (Happy Birthday) জানিয়েছেন। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, মোটেই প্রীত হই নি।
দ্বিতীয় বিষয়ে আসা যাক। সেটা হচ্ছে ‘like’ অভিব্যক্তিটির ব্যবহার দু’টো উদাহরন দেই। অবয়বপত্রে যখন একটি লেখা দেই, প্রায়ই দেখি, সাঁটার ৫ সেকেন্ডের মধ্যে কেউ কেউ ‘like’ দিয়ে দেন। এ কাজের অর্থ আমি খুঁজে পাই না। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে আমরা লেখাটি তিনি পড়ে উঠতে পারেন নি নিশ্চিতভাবে। সুতরাং আমার লেখাটির বিষয়বস্তু বিচার করে ‘like’ দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়? সুতরাং হয় তিনি আমার নামটি ‘like’ করেছেন, নয় তিনি আমার লেখার প্রচেষ্টাকে ‘like’ করেছেন। কোনটা যে ঠিক, বুঝি না।
পরের উদহরনটি আবারো মৃত্যুবিষয়ক। আমাদের বন্ধু-বান্ধবেরা ও চেনা পরিচিতেরা প্রায়ই তাঁদের জনক-জননীর মৃত্যু সংবাদ সবাইকে জানান অবয়বপত্রের মাধ্যমে। প্রায়শ:ই দেখি, অনেকেই নির্দ্বিধায় তাতে ‘like’ দিচ্ছেন। আবারও আমি দ্বিধাণ্বিত হয়ে পড়ি। বুঝি না যে, আমাদের বন্ধুটি যে তাঁর পিতা-মাতার প্রয়াস সংবাদ দিয়েছেন, সেই প্রচেষ্টাটিকে আমরা পছন্দ করছি, না কি বন্ধুটির পিতা বা মাতা যে গত হয়েছেন, সেটা হয়তো আমরা পছন্দ কর ছি? কে জানে, বন্ধুটির প্রয়াত পিতা বা মাতার প্রতি হয়তো আমরা বিরূপ ছিলাম, সুতরাং তাঁদের পরলোকগমনে আমরা যারপর নাই খুশী হয়ছি।
প্রায়শ:ই দেখি, অনেকেই তাঁর পত্রকে বা তাঁর একটি উদ্যেগকে ‘like’ করার জন্যে অনুরোধ জানান। এ জাতীয় পছন্দ করার ব্যাপারটি একজন ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব ব্যাপার।তাঁকে অনুরোধ করে কেন পছন্দ করাতে হবে, পছন্দ হলে পরেই তিনি তা করবেন। তেমনিভাবে বহু গোষ্ঠীতে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ আসে। আমন্ত্রণ জানানোর আগে অমন্ত্রণকারীর কিছুটা বিচার-বাছাই করতে হবে যে আমন্ত্রিত ব্যক্তিটি সেই গোষ্ঠীর জন্যে উপযুক্ত কি না, না কি শুধু তাঁর নামের জন্যেই তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে? তেমনি ভাবে কোন লেখার সঙ্গে কাউকে জুড়ে দেয়ার আগে তার প্রাসঙ্গিকতা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
আপনাদের মতো আমি প্রতিদিনই কোন না কোন বন্ধু-অনুরোধ পাই। তার মধ্যে একটা বড় অংশ থাকে, যাদের পরিচয় অবরুদ্ধ। একমাত্র তাদের নাম আর ছবি ভিন্ন আর সবই আটকানো। বন্ধু অনুরোধ যাঁরা পাঠান, তাঁদের পরিচয়ই যদি আমি না পাই, তা’হলে কেমন করে তাঁদের আমি অবয়বপত্র বন্ধু হিসেবে গ্রহন করবো – কিসের ভিত্তিতে? সুতরাং বন্ধু অনুরোধ পাঠালে অনুগ্রহ করে আপনার পরিচয় অবরুদ্ধ করে রাখবেন না।
কথা আরো আছে। অনেকেই অবয়বপত্র বন্ধু হওয়া মাত্র অন্যপক্ষকে অবয়বপত্রের বার্তা ফোন বযবহার করে ফোন করে বসেন। এই ব্যাপারটিও অভিপ্রেত নয়। প্রথম কথা, সবে বন্ধু হয়েছেন। লেখার মাধ্যমে পরিচিতটি আরো একটু গাঢ় হোক। তারপরই ফোন করা শ্রেয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ফোন করার আগে বার্তার মাধ্যমে জেনে নিন অপর পক্ষ ফোনে কথা বলতে চান কি না, সেটা তার জন্যে অসময় কি না ইত্যাদি।
শেষের কথা বলি, অবয়বপত্র একটি গণমাধ্যম। শালীনতা, শোভনতা সেখানে বড়ই অভিপ্রেত। রা যে ত মেনে চলি। সেই সঙ্গে কোন ব্যক্তিগত বিষয় থাকলে তা অবয়বপত্রে না তুলে, তার জন্যে বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগ করাই শ্রেয়।তা’হলেই বহু বিব্রতকর পরিস্হিতি এড়ানো সম্ভব।
অবয়বপত্র খুব জরুরী ও শক্তিশালী তথ্যমাধ্যম। আমাদের পরিনত ও দায়িত্বশীল ব্যবহারর মাধ্যমে আমরা এর পরিপূর্ণ সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে পারি। তাই উপর্যুক্ত কথাগুলো বললাম। এগুলো ‘কথার কথা’ নয়, এগুলো ‘যা না বললেই নয়’। কিছু মনে করলেন না তো।
সেলিম জাহান : অর্থনীতিবিদ ও লেখক