বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমিয়ে এনেছিল দেশের ব্যাংকগুলো। গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ৫ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমেছিল। তবে তিন মাস যেতে না যেতেই পুরনো চেহারায় ফিরেছে খেলাপি ঋণ। মার্চে এসে পুনঃতফসিলকৃত ঋণসহ নতুন ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বিশেষ সুবিধায় ২০১৫ সালে পুনর্গঠন করা ঋণের বড় একটি অংশও এখন খেলাপি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা; যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ। বিশেষায়িত খাতের দুই ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ৪ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা; যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ৪২টি ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ৪৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা; যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশি খাতের ৯টি ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ।
দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। এরপরও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নগদ অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে যদি ব্যাংকগুলো তৎপর না হয়, বাস্তবতার নিরিখে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ আদায় না করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক অঙ্কে নামিয়ে আনা কঠিন হবে। তিনি বলেন, বাস্তবতার নিরিখে নিবিড় তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি যথাযোগ্য জামানত গ্রহণ সাপেক্ষে নতুন ঋণ দেয়ার মাধ্যমে শ্রেণিকৃত ঋণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব।
অর্থনীতিবিদদের মতে, পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, ঋণ পুনর্গঠনের শর্ত শিথিল করা এবং খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করায় বাংলাদেশের ব্যাংক খাত পিছিয়ে গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন করে কিছু বলার নেই। ঋণগুলো তো আগে থেকেই খারাপ হয়ে আছে। এখন দিন বাড়ছে, খেলাপিও বাড়ছে। ঋণ পুনরুদ্ধারে সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে এভাবে বাড়তেই থাকবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের কিছু ভুল পলিসির কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি হওয়ার সময় বাড়ানোও এর জন্য দায়ী। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে গুড গভর্নেন্সের অভাব, দুর্নীতি তো আছেই। বাংলাদেশ ব্যাংকও তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছে না। এতে করে ম্যানেজমেন্ট দুর্বল হয়ে গেছে। আসলে সমস্যাগুলোকে দূরীভূত করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা এখন খেলাপি ঋণ। এটিকে ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। তবে এই রোগ নিরাময়ের চেষ্টা অব্যাহত আছে।