বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বিশ্বের সর্বোচ্চ চুড়া এভারেস্টের বরফ গলতে শুরু করেছে। এরই কারণে এভারেস্টের যাত্রাপথে এই বছর অসংখ্য নিখোঁজ অভিযাত্রীর মরদেহ বেরিয়ে আসছে বলে নেপাল প্রশাসনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে দ্যা ওয়াল।
সরকারি তথ্য বলছে, সেই ১৯২২ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত শতাধিক অভিযাত্রীর দেহ থেকে গিয়েছে এভারেস্টের বুকে। কালের হিসেবে তারা চাপা পড়ে গিয়েছে বরফে, হারিয়ে গিয়েছে হিমবাহের অতলে। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে উষ্ণতা এত অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে, যে গলে যাচ্ছে এভারেস্টের অনেক বরফ। আর বরফ সরতেই বেরিয়ে আসছে সেই আরোহীদের চাপা পড়া দেহ! অবিকৃত! তুষারের দেশে যে সবই অবিনশ্বর!
নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি আং শেরিং শেরপা বলেন, “২০০৮ সালে এক বার এমন হয়েছিল। ১৯৭০ সালে চাপা পড়া সাত জন ব্রিটিশ অভিযাত্রীর দেহ একসঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল। সেগুলো নামানো হয়। কিন্তু তার পর থেকে আর কখনও এত দেহ দেখা যায়নি। এই বছর অস্বাভাবিক রকম গলেছে বরফ। এটা সারা পৃথিবীর জন্য খুবই খারাপ বার্তা। আমরা উদ্বিগ্ন।”
বস্তুত, মেরুপ্রদেশ থেকে শুরু করে হিমালয়– বরফ সর্বত্রই গলতে শুরু করেছে কয়েক বছর ধরেই। এর নানা কুফল প্রায়ই সামনে আসে। কিন্তু এ নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যতটা প্রচার ও সচেতনতা গৃহীত হওয়া উচিত, তার প্রায় কিছুই হয় না। সেই কারণেই বছর-বছর গলতে গলতে, এই বার যেন মাত্রা ছাড়িয়েছে এভারেস্ট।
এভারেস্টে ওঠার পথে অন্যতম বিপজ্জনক জায়গা হল খুম্বু আইসফল। একশো বছর ধরে এই আইনফলেই মারা গিয়েছেন বহু পর্বতারোহী। ২০১৪ সালে এখানে বড় তুষারধস নামায় মারা যান ১৩ জন অভিজ্ঞ শেরপাও। সেই খুম্বুতেই বরফ গলে বেরিয়ে আসছে সব থেকে বেশি মৃতদেহ— গত কয়েক বছরে এমনটাই অভিজ্ঞতা পর্বতারোহীদের।
নেপালের পর্বত আরোহণ আয়োজক সংস্থাগুলির তরফে জানানো হয়েছে, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক হলেও, অত উচ্চতা থেকে দেহ নামিয়ে আনা খুবই পরিশ্রমসাধ্য ও খরচসাপেক্ষ। তার উপর অনেক সময়েই দেহের মালিকানা নিতে চান না কেউ। তখন তার দায় সংস্থাকে নিতে হয়, সৎকারের ব্যবস্থা করতে হয়। সে কারণ বেশির ভাগ দেহই শ্রদ্ধা জানিয়ে পাহাড়ের কোলেই ফেলে আসা হয় বলে জানালেন অভিজ্ঞ শেরপারা।
১৯৫৩ সালে প্রথম এডমন্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে এভারেস্টের চুড়ো স্পর্শ করেন। তথ্য বলছে, তার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার পর্বতারোহী নিরাপদে এভারেস্ট সামিট করে ফিরে এসেছেন। কিন্তু অনেকেই আবার পারেননি ফিরতে। পাশাপাশি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এভারেস্টের ফিচারও পাল্টে গেছে। ২০১৫ সালের ভূমিকম্প যেমন নষ্ট করে দেয় সামিটের নীচের ‘হিলারি স্টেপ’ নামের একটি জায়গা। ওই একই বছরের এক গবেষণায় দেখা যায় হিমালয়ের বরফ প্রবল গতিতে গলতে শুরু করেছে। আগামী ১০০ বছরের মাথায় ৭০-৯৯ শতাংশ হিমবাহ গলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।
কিন্তু ভবিষ্যতের কথা তো পরে, অতীতের প্রায় একশো বছর ধরে হিমালয়ের তুষারেরাজ্যে সমাহিত পর্বতারোহীদের মৃতদেহ বেরিয়ে আসায় সমস্যায় পড়েছেন নেপালের পর্বতারোহী সংস্থাগুলো।
তথ্য বলছে, এভারেস্ট অভিযানে এ পর্যন্ত মৃত ৩০০ জনের মধ্যে বেশির ভাগেরই দেহ বরফের তলায় চাপা পড়ে যাওয়ার তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায়নি এত দিন। কিন্তু উষ্ণায়ণ বদলে দিয়েছে এই চিত্র। গত কয়েক বছর ধরে সারা পৃথিবীর সঙ্গে বাড়ছে হিমালয়ের তাপমাত্রাও। গলছে এভারেস্টের বিভিন্ন হিমবাহ। তার ফলেই এত দিন ধরে বরফে চাপা পড়ে থাকা পর্বতারোহীদের মৃতদেহ বেরিয়ে আসছে অনেক বেশি সংখ্যায়।
নেপাল ন্যাশনাল মাউন্টেন গাইড অ্যাসোসিয়শনের তরফে সবিত কুঁয়ার জানিয়েছেন, ‘‘বিষয়টি খুবই চিন্তার। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে আমাদের। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমরা মৃতদেহ নামিয়ে আনছি। কখনও আবার শুধুই প্রার্থনা করে পাথর আর বরফ দিয়ে মৃতদেহগুলি চাপা দিয়ে দিচ্ছি।’’
এ বিষয়ে আং শেরিং বলছেন, ‘‘কিছু দিন আগেই একটি মৃতদেহ বেরিয়ে এসেছিল পর্বতশৃঙ্গের প্রায় কাছে, আট হাজার ৭০০ মিটার উচ্চতায়। মৃতদেহটি ঠান্ডায় তো জমাট বেঁধে গিয়েছিলই সেই সঙ্গে তার ওজন হয়ে গিয়েছিল প্রায় ১৫০ কেজি। ওই দুর্গম জায়গা থেকে মৃতদেহটি নীচে নামিয়ে আনতে বেশ কষ্টই হয়েছিল আমাদের। সব সময় তা সম্ভব হয় না।’’