সম্প্রতি বাংলাদেশের কুমিল্লার মুরাদপুরের ঘটনা নিয়ে এতদ্দেশে অনেকেই নিন্দা জানাচ্ছেন। আমিও আমার প্রতিবাদটুকু জানিয়ে রাখলাম। আমিও ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। তবে, পেছনে আরও খেলা আছে সম্ভবত।
পাশাপাশি, আমার রাজ্য অসমের কোকরাঝাড়ের গোঁসাইগাওয়ে এক-ই সময়ে যে পাঁচজন হিন্দু বাঙালি যথাক্রমে নির্মল পাল(৫০), তাঁর স্ত্রী মল্লিকা পাল(৪৫), মেয়ে পূজা(২৫), নেহা(১৭),দীপা(১৫) অভাবের দরুন আত্মহত্যা করলেন, সেই পাঁচজন হিন্দু মা-বোন-ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করছি। কারও কারও মতে, এটি আত্মহত্যা নয়; বাঙালি-বিদ্বেষ থেকে গ্যাস এজেন্সির মালিক নির্মল পালকে সপরিবারে খুন করা হয়েছে! বিষয়টি তদন্তাধীন। তবে গলায় দড়ি দিয়ে পাঁচ জনের আত্মহত্যার ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত/প্রচারিত হয়েছে। যা-ই হোক, ঘটনাটি মর্মান্তিক! দুঃসহ! কিন্তু গোঁসাইগাওয়ের উক্ত পাঁচ ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে তেমন চর্চা হবে না, কারণ, এখানে ‘অপর’ পক্ষ নেই! আর দুটি ‘পক্ষ’ না-থাকলে প্রতিবাদ ‘জমে না’! এ-প্রসঙ্গে নীরদ সি চৌধুরির বিখ্যাত উক্তিটি উদ্ধৃত করছি, তিনি তাঁর “আত্মঘাতী বাঙালী” গ্রন্থে লিখেছেন, ”হিন্দুত্ব যত না উহার প্রতি শ্রদ্ধা তার চেয়ে অনেক বেশী মুসলমান বিদ্বেষ”। ফলে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন, ফ্রান্সে চেচেন বালকটির হাতে সংখ্যাগুরু খ্রিস্টান শিক্ষকের মৃত্যু নিয়ে যতটুকু সোচ্চার হয়েছেন সুশীলবর্গ, কোকরাঝাড়ের পাঁচজন হিন্দুর মৃত্যু কিংবা দু বছর আগে তিনসুকিয়ায় জঙ্গিদের গুলিতে পাঁচজন হিন্দু যুবকের মৃত্যুর প্রতিবাদে মিডিয়া/সোশ্যাল মিডিয়া তুলনামূলক নিরুচ্চার! রাজনীতিকরাও নীরব! কারণ, এক্ষেত্রে ‘ইস্যু’ তৈরি করা যাবে না! প্রতিপক্ষ মুসলিম বা ইসলাম নয় বলে! অনেক সুশীলকে দেখেছি, শুধু মুসলিম অনুষঙ্গ থাকলেই তীব্র সোচ্চার হন! কিন্ত মুসলিম সম্পৃক্ততা না-থাকলে বাঙালি হিন্দুর মৃত্যু বা নির্যাতনের প্রতিবাদে টুঁ-শব্দটি করেন না!
গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মেঘালয়ের বাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত ইসামতিতে হাজার দেড়েক বাঙালি হিন্দু আক্ষরিক অর্থেই বিপন্ন! পণবন্দি! গ্রাম থেকে একবার বের হলে গ্রামে পুনরায় প্রবেশের অনুমতি নেই! বিচার চাইলে ভয়ানক পরিণতির ‘ফতোয়া’ মাথার উপর ঝুলছে! খাসিয়া ছাত্র ইউনিয়ন হুলিয়া জারি করে রেখেছে অনেক দিন ধরে! মেঘালয়ে হিন্দু বাঙালির ‘অনুপ্রবেশ’ রোধে গেট বসিয়েছে খাসিয়া ছাত্র সংস্থা। এসব জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে যতটুকু সোচ্চার হওয়া দরকার ছিল, তার ছিটেফোঁটাও লক্ষ করা যাচ্ছে না, কী সুশীল কী রাজনীতিক, কোনও পক্ষ থেকেই! অথচ, ফ্রান্সের সেই মাতাল শিক্ষকটির জন্য এতদ্দেশে অনেকের দরদ উতলে ওঠেছে! মাস কয়েক আগে কেরলে একটি অন্তঃসত্ত্বা হাতির মৃত্যুর জন্য কতকেই কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করতে দেখা গেল! কারণ, সেখানেও দূর সম্পর্কে মুসলিম অনুষঙ্গ কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছিল! এসব আত্মঘাতী প্রবণতার দরুন সম্ভবত নীরদ সি চৌধুরি উপর্যুক্ত মন্তব্য করেছিলেন! অর্থাৎ নীরদ সি’র সময়কালেও নিশ্চয় এমন প্রবণতা ছিল!
পুনশ্চ : হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে যাঁরা যেখানে অত্যাচারিত, আমি মনেপ্রাণে তাঁদের মঙ্গল কামনা করি। কায়িকভাবে দূরে হলেও মনের দিক থেকে কাছে আছি।
০৪.১১.২০২০
বুধবার
লেখক: কবি,গবেষক ও শিক্ষাবিদ । প্রকাশক, দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গ। করিমগঞ্জ। অসম।
মুক্তকণ্ঠে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখকের নিজস্ব মতামত।
আরও পড়ুন: