যে যুদ্ধ করে আর যে যুদ্ধের বয়ান তৈরি করে- এই দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরের প্রজন্ম, তারা তৈরি করা বয়ান দিয়েই তো যুদ্ধ, যোদ্ধা, ইতিহাসকে চিনেছি। তাহলে এই ফারাকটা ভরাটের পথ কী?
ঠিক এই জায়গাটা থেকেই একসময় ভাবি, যোদ্ধার প্রকৃত বয়ানটাই বোধহয় সেই ফারাকটা ভরাট করে দিতে পারে। একসময় যোদ্ধার বয়ান শোনা শুরু করি। সত্যিকার অর্থেই তখন অন্য এক যুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করি যোদ্ধার চোখে। সেই ঘোর আজও কাটেনি।
কিন্তু যোদ্ধাও তো মানুষ, সময়ের ব্যবধানে সেও নিজেকে যে পাল্টে ফেলেনি- তাই বা কে বলবে! তবু আজও মুক্তিযোদ্ধার, বীরাঙ্গণার, শরণার্থীর গল্প শুনি ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথার মতো সরলতা, মুগ্ধতা আর শিহরণ নিয়েই।
সেই অচেনা, অজানা, অখ্যাত যোদ্ধা, যারা মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপ দিয়েছিল, তাদের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা এই উত্তাল মার্চের দিনগুলোতে শুনাতে চাই ৫২বাংলায় ।
যুদ্ধ কেবল ভূগোল বা ইতিহাস নয়, মানুষের স্বপ্নকেও পাল্টে দেয়, বদলে দেয় জীবন-যাপনের গতিধারা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার চানপুর চা-বাগানের সাবিত্রী নায়েকের জীবনের চেনা ছককে পাল্টে দিয়েছে।
যুদ্ধের সময় সাবিত্রী ছিল বিশ বছরের এক উচ্ছল তরুণী। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সাবিত্রী সবার ছোট। স্বাধীকারের দাবিতে রাজপথ কেঁপে উঠলে সেই স্পন্দন পাহাড়ি টিলা ও নিবিড় অরণ্য পেরিয়ে পৌঁছে যায় চা-বাগানের নীরব-নিস্তরঙ্গ জনপদে। সেখান থেকেই পাকিস্তানি সেনারা সাবিত্রীকে তুলে নিয়ে যায়।
সাবিত্রীকে নিয়ে প্রথমে আটকে রাখে চা-বাগানের ৬ নম্বর বাংলোতে। সেখানে তাঁকে দুই সপ্তাহ আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। দুই সপ্তাহ পর তারা তাঁকে নিয়ে যায় মাধবপুর থানার সুরমা চা-বাগানের বাংলোতে।
একদিন বাড়ি ফিরে আসেন সাবিত্রী। কিন্তু চিরপরিচিত বাগান তাঁর কাছে অপরিচিত হয়ে উঠে। চারপাশের চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে যায়। সাবিত্রীর অন্ধকার জীবনে স্বস্তির সুবাতাস নিয়ে এগিয়ে আসেন চানপুর চা-বাগানের মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলী। সাবিত্রী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
জীবন রূপকথা নয়, জীবন রুক্ষ কঠিন রূঢ় বাস্তবতা। কেরামত আলীর মহানুভবতায় যে রূপকথার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তাঁর ঘৃণা ভরা প্রত্যাখানে সেই রূপকথার সমাপ্তি হয়। সমাজ ও চারপাশের মানুষের প্রতিনিয়ত করা ব্যাঙ্গোক্তি একসময় সাহসী মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরোধের দেয়ালও ভেঙ্গে দেয়। তের বছরের সংসার থেকে দুই সন্তানের হাত ধরে বেরিয়ে আসতে হয়। আবার অনিশ্চিত যাত্রা, সামনে বিরূপ পৃথিবী। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কেউ সাবিত্রীকে স্বীকৃতি দেয় না।
(বীরাঙ্গনা সাবিত্রীর ভাই মঙ্গল নায়েক, বড় ছেলে আলম ও ছোট ছেলে খোকনের এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের এক বিকালে তাদের চানপুর চা বাগানের বাড়িতে।)