রক্ত ও আগুনের উপস্থিতি সম্পর্কে মানুষ যতটা সচেতন, ভাষা বিষয়ে মানুষ সম্ভবত ততটা সচেতন না। কিন্তু এই কথা সত্য- রক্ত ও আগুনের চেয়েও ভাষা কখনও কখনও অধিক শক্তিশালী। আগুন একটি এলাকাকে জ্বালিয়ে দিতে পারে মাত্র অথচ একটি মাত্র উচ্চারিত বাক্যে পুরো একটি জনপদ, একটি জাতি জেগে উঠতে পারে। রক্ত হয়তো একটি বংশ গড়ে তুলতে পারে কিন্তু ভাষা পুরো একটি জাতিসত্তাও গড়ে তুলতে পারে। বাঙালি বাংলাদেশ তার প্রমাণ।
অনুচ্চারিত, উচ্চারিত বা লিখিত ভাষাকে আপাত যতটা নিরীহ মনে হয়, আদতে তা নয়। ভাষার রাজনীতি আছে, অর্থনীতি আছে; ইতিহাস-ঐতিহ্য, শ্রেণিচেতনা আছে। সভ্যতার ইতিহাসে আগুন ও চাকার আবিস্কারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু আমার কাছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে ভাষার আবিস্কার। ভাষাকে দিয়ে সে ঈশ্বর থেকে নিজেকে আবিস্কার করেছে। ভাষা দিয়েই মানুষ চিন্তা করতে, কল্পনা করতে সবকিছু বুঝতে শুরু করেছে। আয়তন ও পরিমাণের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে পৃথিবীতে জলভাগ সবচেয়ে বেশি; আর দেহের ও মস্তিস্কের দিক থেকে নীল তিমি সবচেয়ে বড় প্রাণী। এ হিসেবে ডাইনোসর তো নয়ই, নীল তিমির পৃথিবীকে শাসন করার কথা। কিন্তু করছে মানুষ। কারণ একটিই- মানুষের ভাষা আবিস্কার। জর্জ বার্নার্ড শ ঠাট্টা করে বলেছিলেন, একটি কুকুর যত প্রকার করেই ঘেউ ঘেউ করুক না কেন সে এটা বোঝাতে পারবে না যে, সে কুকুর হলেও তার মা একজন ভদ্রমহিলা ছিলেন! প্রাণিজগতের অন্য সদস্যদের নিজস্ব ভাষা পদ্ধতি থাকলেও একমাত্র মানুষেরই আছে অত্যন্ত শক্তিশালী ভাষা ব্যবস্থা। ফলত মৌমাছি কোথায় মধুর উৎস আছে তা অন্য মৌমাছিকে গাণিতিক উপায়ে প্রায় নির্ভুলভাবে জানাতে পারলেও সে তার বাচ্চাকে অর্জিত জ্ঞান তো দূরের বিষয়, নাম পর্যন্ত শেখাতে পারে না। মানুষ; একমাত্র মানুষই পারে নিজের অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতে; অনাগত প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে। এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে লিখিত ভাষা আবিস্কারের ফলে।
ভাষা কীভাবে আবিস্কার হয়েছে তা নিয়ে নানা অনুমান আছে। ভাববাদীরা মনে করেন, ভাষা স্বয়ং ঈশ্বর মানুষকে দিয়ে দিয়েছেন। সাথে অন্যরা প্রশ্ন করেছেন, তাহলে তো পৃথিবীতে মাত্র একটিই ভাষা থাকার কথা। এর উত্তরে বাইবেলের গসপেল একটি উচ্চ মিনার তৈরির গল্প আমাদের জানাচ্ছে। বলছে- মানুষরা মিলে এক সময় একটি সুউচ্চ মিনার বানাতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য স্বর্গলোক দখল করা। তারা যখন মিনার বানানো শুরু করল তখন তাদের ঈশ্বর এক মজার চাল চাললেন। তিনি তাদের প্রত্যেকের ভাষা বদলে দিলেন। তাতে একজন আরেকজনের কথা, আদেশ-নির্দেশ বুঝতে পারল না। তারা বিবাদে লিপ্ত হলো আর ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে গেল। সে থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার জন্ম হলো। এ তো ভাষার ভিন্নতা বিষয়ে ভাববাদীদের একটি ব্যাখ্যা গেল। প্রকৃতিবাদীরা বললেন, ভাষা প্রকৃতির বিভিন্ন ধ্বনির ভেতর ছিল। মহাবিশ্বের মহাজাগতিক শব্দরাশির ভেতর, নদীর কুল কুল ধ্বনির ভেতর, পাখির গানের ভেতর মূল ধ্বনিগুলো ছিল। এ জন্য সঙ্গীতজগতের লোকেরা বলে থাকেন, ভাষার আগে এসেছিল সঙ্গীত। ধ্বনিগুলো যেখান থেকেই আসুক; এ কথা সবাই মানেন, ভাষার বর্ণগুলো এসেছিল প্রকৃতির বিভিন্ন আকৃতি ও রঙ থেকে। বর্ণ থেকে বলেই এ জন্য বাংলায়ও বলা হয় বর্ণমালা। প্রাচীন গুহাচিত্রে বা পাথরচিত্রে ভাষার যে লিখন পদ্ধতি আমরা পাই, তা মূলত প্রকৃতির বিভিন্ন চিত্রভিত্তিক। হায়ারোগ্লিফিকস যে লিখন পদ্ধতি, তাও চিত্রভিত্তিক ছিল। এখনও মান্ডারিন ভাষাগুলোর অনেকটা চিত্রভিত্তিক। জাপানি ভাষা তার উদাহরণ। চিত্রগুলো পরে প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং এগুলো এক একটি শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে সূত্রবদ্ধ হয়েছে। এক একটি পদ্ধতি দাঁড়িয়েছে। মানব প্রজাতির জন্য ছিল এ এক মহান আবিস্কার। এ পদ্ধতি আবিস্কারের ফলে মানুষ তার এক প্রজন্মের জ্ঞান অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত করতে পেরেছে। ফলত এখন আমরা আমাদের কয়েক হাজার বছর পূর্বের মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা জানতে পারছি। বাংলাদেশে বসে জানতে পারছি আজ থেকে কয়েক হাজার বৎসর পূর্বে গ্রিসের মহান মনীষীরা কী ভেবেছিলেন। ফলত আমাদের বর্তমান জ্ঞান কয়েক হাজার বৎসর পূর্বের জ্ঞানের সমষ্টি। ভাষার এ শক্তির কারণেই মানুষের পক্ষে প্রাণিজগতের অন্যান্য প্রজাতির ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ভাষা পদ্ধতি তার জনসমষ্টির সামষ্টিকতা নিয়ে গড়ে ওঠে। এর প্রতিটি প্রতীক সংকেত অর্থ সে জনসমষ্টি নিজেরা ঠিক করে নেয়। যেমন ধরুন একটি ভাষাগোষ্ঠী ঠিক করল, তারা কাঁঠাল বলতে গোলাকৃতির একটি ফলকে বোঝাবে। তাহলে সে জনসমষ্টি সেটাই বুঝবে। কিন্তু অপর গোষ্ঠী ঠিক করল, কাঁঠাল বলতে বান্ধবী বোঝাবে, তাহলে সে সমাজে কাঁঠাল চাইলে আগের সমাজের লোকেরা বিরূপ সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। ভাষা মূলত একটি যোগাযোগ পদ্ধতি ও শৃঙ্খলা। এ শৃঙ্খলাকে কেন্দ্র করে এক একটি জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। বাইবেলের গসপেলে সে ধারণাটি আছে। এটিকে ভেঙে দিলে ঈশ্বরের স্বর্গলাভ না হোক অন্তত তাদের ঐক্য ভেঙে পড়তে পারে। ভাষার সাথে জড়িয়ে থাকে সে জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, আচার, সংস্কৃতি, আচার- সবকিছু। ফলত একটি জাতির ভাষায় আঘাত হানা মানে তার সবকিছুর ওপরেই আঘাত হানা। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ কার্জন হলে সে আঘাতটি করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ফলে তিনি শুধু ভাষা নয়; বিকাশমান একটি জাতিসত্তার অস্তিত্বের ওপর আঘাত করেছিলেন। যদি সেদিন এ জাতি তার প্রতিবাদ না করত, আর পরবর্তী সময়ে উর্দু ভাষা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো তাহলে বাংলা জানা একটি পুরো জনগোষ্ঠী রাতারাতি অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতো। তারা পিছিয়ে পড়ত সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুতে। কেননা, তাদের আগে অন্য একটি নতুন ভাষা রপ্ত করতে হতো। এ তো ভাষার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক লড়াই প্রসঙ্গ।
ভাষার ভেতরেও রয়েছে নানান লড়াই, নানান শ্রেণিদ্বন্দ্ব। ভাষার শ্রেণিচেতনা বিষয়ে সে গল্পটি নিশ্চয় সবার মনে আছে?
মনিব চাকরকে ডেকেছেন। চাকর আসতে খানিকটা দেরি করেছে। চাকর আসার পর মালিক জিজ্ঞাসা করছেন- এতক্ষণ কী করছিলি? বেচারা কাঁচুমাচু হয়ে বলল- আহার করছিলাম, হুজুর! এটা শুনেই মালিক রেগে গিয়ে বললেন, কী? আহার করছিলি? মানে? আরে ভোজন করেন মহারাণি ভিক্টোরিয়া, আহার করেন বর্ধমানের রাজা, আমরা খাই, আর তুই গিলিস। বল- গিলছিলাম!
এটা হচ্ছে ভাষার শ্রেণিচেতনা। উচ্চ শ্রেণি ভোজন করে, গরিব মানুষ গিলে। সর্বনাম পদেও আছে পার্থক্য- উচ্চ শ্রেণির জন্য আপনি আর গরিবের জন্য তুই বরাদ্দ। আর কাছের জনের জন্য তুমি।
ভাষায় মানুষের এ শ্রেণিচেতনা খুব সহজেই চোখে পড়ে। শ্রেণিচেতনার, জাত চেতনার তারচেয়ে আরও গভীরতর রাজনীতিটি চাতুর্যপূর্ণ। এক সময় বাংলা ভাষাকে প্রায় অচ্ছুত ভাষা মনে করা হতো। ঐতিরেয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে- এ অঞ্চলের খাটো মানুষেরা কিচিরমিচির ভাষায় কথা বলে। ধর্মের পবিত্র ভাষা এ ভাষায় লেখা চলে না। হাজার বৎসর আগে চর্যার কবি বলেছেন- তিনি বাঙালি হয়ে জাতচ্যুত হয়েছেন। পাকিস্তান আমলেও পূর্ববঙ্গের অভিজাত শ্রেণি উর্দুতে কথা বলেছে। মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের রীতিমতো সাহস করে ঘোষণা দিয়ে বাংলা ভাষায় লিখতে হয়েছে। উনিশ শতকে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বাংলা গদ্য নির্মাণ করা হয়েছে সংস্কৃত ভাষা অনুসরণ করে। এখনও অনেকে মনে করেন, সংস্কৃত নিয়ম ছাড়া বাংলা ব্যাকরণ অচল। বিশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য চর্চার একটা বড় বাহন ছিল সংস্কৃতবহুল সাধুরীতি। এ রীতির বাইরে মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি চলিত রীতি প্রচলন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীকে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু এ চলিত রীতিটিও গড়ে উঠেছিল মূলত শান্তিনিকেতন, নদীয়ার মানুষের মুখের ভাষাকে ভিত্তি করে। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বাকভঙ্গিটি স্বাভাবিক কারণেই এ রীতিতে আসেনি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে সংসদে প্রস্তাব এনে বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের যে বীজ বহন করেছিলেন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন তা জনতার আকাঙ্ক্ষার পর্যায়ে নিয়ে আসে। ফলে মূলত ভাষাভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের লড়াই ১৯৭১ সালে সাফল্য লাভ করে আত্মদান ও রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলা ভাষাটিতে এ দেশের সাধারণ মানুষের বাকভঙ্গিটিও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির ভাষা রাজনীতির অভীপ্সার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের সাধারণের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই। ভাষা রাজনীতির এ শ্রেণিগত লড়াই এখনও চলমান।
মানুষ চিন্তা করে, এমনকি ঘুমেও স্বপ্ন দেখে মাতৃভাষায়। সকল গবেষণা বলছে, শিশুর শিক্ষাগ্রহণ সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয় মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান করলে। অপর কোনো ভাষা বা কৃত্রিম কোনো ভাষা শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশের অন্তরায় সৃষ্টি করে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মূল সত্যটি ছিল মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই। সুতরাং বর্তমান বাংলাদেশে বাঙালি শিশু যেমন তার মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলবে, লেখাপড়া শিখবে; তেমনি অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুটিও তার মাতৃভাষায় বিকশিত হওয়ার অধিকার লাভ করবে।
আগুনের স্বভাবধর্ম হচ্ছে দহন করা, রক্তের স্বভাবধর্ম বংশধারা বহন করা; আর মানব শিশুর ধর্ম মায়ের মুখের ভাষায় বেড়ে ওঠা, বিকশিত হওয়া। এ স্বভাবধর্মের অন্যথা হওয়ার উপায় নাই।
লেখক: কবি প্রাবন্ধিক