৩১শে ডিসেম্বর। রাত এগারোটার বেশি বাজে। চারিদিকে আতশবাজি ফোটানোর শব্দ ভেসে আসছে কানে। ইংরেজি নব বর্ষ ২০২১ কে বরণ করার প্রস্তুতি চলছে। আমাকে বহনকারী এম্বুলেন্স প্রবেশ করছে হোমারটন হাসপাতালে। শরীর ভীষণ দুর্বল। বুকে প্রচন্ড ব্যথা। গায়ে জ্বর। অক্সিজেন লেভেল স্বাভাবিক পর্যায় থেকে অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় নাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। প্যারামেডিক্সরা আমাকে এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়ে একটি রুমে রাখলেন । আমার কি হবে এ ভেবে ভয়ে আমার শরীরে থেকে থেকে কাঁপুনি হচ্ছে। মহান রাব্বুল আল আমিনকে স্মরণ করার পাশাপাশি মনে মনে দোয়া দরূদ পড়ছি। বার বার স্ত্রী আর তিন সন্তানের কথা মনে পড়ছে। দু চোখে কেবলি তাদের চেহারা ভেসে বেড়াচ্ছে। এর আগে এম্বুলেন্সে প্রবেশ করার আগে স্ত্রী আর সন্তানদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় দুঃখভারাক্রান্ত মনটা অবুঝ শিশুর মতো বারংবার কেঁদে উঠছিলো। বড়ো ছেলে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলছিলো “আব্বু আই নীড ইউ”, “উই অল নীড ইউ “। স্ত্রী আর সন্তানদের অশ্রূসজল আটটি চোখ আমাকে ঘিরে রয়েছে। বিশেষ করে আমার ছয় বছরের আদরের কন্যার কথা মনে করে বাঁচার আকুল প্রয়াসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি।
প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। আমি একা একটি রুমে পড়ে আছি। প্যারামেডিক্সরা আমাকে এ রুমে রেখে যাবার পর কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। ভীষণ ক্ষুধা আর তৃষ্ণা পেয়েছে। হাতের কাছে কোনো বেল নেই যা টিপলে লোকজন আসবে। নিজেকে চরম অসহায় মনে হচ্ছে। এরইমধ্যে হৈ চৈ শুনতে পেলাম। মনে হয় রাত বারোটা বেজে গেছে। এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সিতে উপস্থিত সব ডাক্তার আর নার্স একজন আরেকজনকে নব বর্ষের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। “হেল্প প্লিজ, হেল্প প্লিজ” বলে অনেক্ষন চিৎকার করার পর একজন নার্স এলেন। চিৎকার করতে গিয়ে বার বার বুকের উপর খুব চাপ অনুভব করছিলাম। নার্সকে অনেকটা অভিযোগের সাথে বললাম কেনো এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। তার কাছে এক গ্লাস পানি চাইলাম। জানালাম আমার ক্ষুধার কথা। পানি দিয়ে নার্স চলে গেলেন। কিছুক্ষন পর একজন মহিলা ডাক্তার আসলেন। কিছু পরীক্ষা – নিরীক্ষা করলেন। তাকেও আমার ক্ষুধার কথা জানালাম। কিছুক্ষন পর ডাক্তার রোজেটা আমাকে একটি স্যান্ডউইচ এনে দিলেন। আমাকে পাঠানো হলো বুকের এক্সরে করানোর জন্য। এক্সরের পর ফিরে এলাম আবারো সেই রুমে। বুকের ব্যথা আর দুর্বলতা আমাকে একেবারে কাহিল করে ফেলেছে। দীর্ঘক্ষণ পর ডাক্তার রোজেটা এসে আমাকে জানালেন যে তিনি আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে যাচ্ছেন। কারন আমার অবস্থা বেশি ভালো না। তাকে অনুরোধ করলাম আমার বড়ো ছেলে বা স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তির খবর জানিয়ে দেয়ার জন্য। ডাক্তার আরো বললেন, কিছুক্ষন পর আমাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। আনুমানিক ভোর দুটার দিকে আমাকে লয়েডস ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হলো। বেড নম্বর ৫, আমিসহ মোট ৬জন করোনা রোগী এই রুমে। খুব কষ্টে ব্যাগ থেকে নিজের ফোন বের করে স্ত্রী ও ছেলেকে টেক্সট করে কোথায় আছি জানালাম। স্ত্রী ও ছেলে টেক্সটের রিপ্লাই করে আল্লাহকে স্মরণ করার আর মনে সাহস রাখার উপদেশ দিলো। বললো ইনশাআল্লাহ আমার খারাপ কিছু হবে না। তাদের সান্তনা পেয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু চারপাশ থেকে অন্যান্য রোগীদের চিৎকার, আহাজারি আর কাশীর শব্দে কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না।
প্রথম আমার করোনার লক্ষণ দেখা দিয়েছিলো রোববার ২০শে ডিসেম্বর। আচমকা সারা শরীরে ব্যথা অনুভব করছিলাম। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। গাইস হাসপাতালে আমার ক্যান্সার টিমের সাথে যোগাযোগ করার পর তারা আমাকে কোভিড – ১৯ পরীক্ষা করার উপদেশ দিলেন। পরদিন কোভিড – ১৯ পরীক্ষা করালাম। ২৩ ডিসেম্বর আমাকে টেক্সট করে ফল জানানো হলো আমি কোভিড পজিটিভ। টেক্সট পেয়ে আমার পরিবারের সবার মন খারাপ হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম সব আল্লাহর ইচ্ছা। আমাদের সবাইকে দশদিন আইসোলেশনে থাকতে বলা হলো। ২৭ ডিসেম্বর রোববার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে রাতে বড়ো ছেলে এম্বুলেন্স ডাকলো। প্রায় দুই ঘন্টা পর এম্বুলেন্স এসে প্রাথমিক পরীক্ষা – নিরীক্ষার পর আমাকে হুইপস ক্রস হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো। সেখানে ঢুকতেই অন্যান্য রোগীদের চিৎকার, আর্তনাদ শুনে আর তাদের যেভাবে মেডিক্যাল সরঞ্জাম লাগিয়ে রাখা হয়েছে তা দেখে প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে গেলাম। মনের মাঝে আতঙ্কের ঢেউ বইতে শুরু করলো। সারারাত ধরে নানান পরীক্ষার পর ডাক্তার সাবা আর ডাক্তার আমাল জানালেন, আমার বুকে ইনফেকশান ধরা পড়েছে। এন্টিবায়োটিক্ দিয়ে আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। পরদিন সোমবার ভোর চারটার দিকে বড়ো ছেলে আমাকে বাসায় নিয়ে এলো। আমাকে দেখে পরিবারের বাকী সবাই খুশি। আমিও বাড়িতে ফিরে আসতে পারায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। একই দিন দুপুরে জ্বর বেড়ে গেলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। এম্বুলেন্স আসতে দেরি হবে বিধায় সময় ক্ষেপন না করে বড়ো ছেলে তার গাড়িতে করে আবার হুইপস ক্রস হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো। ইমার্জেন্সিতে লম্বা কিউতে দাঁড়াতে হলো। কেউ কাঁশছেন, কেউ বমি করার চেষ্টা করছেন, কেউ জ্বরে কাতরাচ্ছেন। বিভিন্ন বর্ণের মানুষের ভীড়। থমথমে পরিবেশ। আমি হুইল চেয়ারে বসে আছি। পাশে বড়ো ছেলে বসে আছে। তার কথা ভেবেও দুঃচিন্তা হচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ডাক্তার সাবা এলেন। রক্ত পরীক্ষা করা হলো। শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো হবার পর ডাক্তারের পরামর্শ মতো বাসায় ফিরে এলাম। আমাকে দেখে আবারো সবাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো।
বাড়িতে এক রুমে নিজেকে বন্দি করে রেখেছি। স্ত্রী ও বড়ো ছেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার রুমে এসে আমার দেখাশোনা করছে। ছোট ছেলে ও মেয়েকে কাছে ভীড়তে দিচ্ছি না। মন চাইলে দূর থেকে তাদের দেখছি। তবে দূর থেকে দেখে বুঝতে পারছিলাম আমার মেয়ের মনটা খুব খারাপ। চেহারায় কাঁদো কাঁদো ভাব। এরিমধ্যে ২৯ শে ডিসেম্বর থেকে কফের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকলো, সে সাথে বাড়ছে বুকের ব্যথা। বৃহস্পতিবার ৩১শে ডিসেম্বর, জ্বর বার বার ওঠা নামা করছিলো, অক্সিমিটারে দেখছিলাম যে, অক্সিজেন লেভেল ৯০ এর নিচ থেকে আর উপরে উঠছিলো না। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিলাম না। বড়ো ছেলে কোলে করে কয়েকবার টয়লেটে নিয়ে গেছে। খুবই দুর্বল লাগছিলো। আমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে, অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। স্ত্রী ও বড়ো ছেলে যখন এম্বুলেন্স ডাকার কথা বললো তখন এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলাম। এর আগে দীর্ঘ দিনের সহকর্মী ও আমার বোন সমতুল্য ডাঃ জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার আমার বড়ো ছেলেকে এ বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে দ্রুত হাসপাতালের সেবা পেতে হলে এম্বুলেন্সে যাওয়াই শ্রেয়। তাই তিন ঘন্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করে তৃতীয়বারের মতো সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আবার পরিবারের কাছে আল্লাহর অশেষ কৃপায় ফিরে আসতে পারবো কি পারবো না, সংশয়ের দোলাচলে আমাকে এম্বুলেন্সে তোলা হলো। গন্তব্য হোমারটন হাসপাতাল। আমার লন্ডনের প্রবাস জীবনে এর আগে কখনোই হোমারটন হাসপাতালে যাওয়া হয়ে উঠেনি।
পহেলা জানুয়ারী, শুক্রবার। লয়েডস ওয়ার্ডের ৫ নম্বর বেডে খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙলো। দুর্বল দেহ। টয়লেটে হেঁটে যাবার শক্তি নেই। মহিলা নার্সদের লজ্জায় কিছু বলতে পারছি না। অনিচ্ছা সত্বেও বেডের পাশে রাখা পাত্রে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হলো। কোনো রকমে টেলিফোন খুলে দেখলাম স্ত্রী, বড়ো ছেলে আর ছোট ভাইয়ের টেক্সট। বুঝতে বাকী থাকলোনা যে, তারা আমাকে নিয়ে দুঃচিন্তা করছে। সবাইকে অনুরোধ করলাম বাংলাদেশে আমার আম্মা ও বাবাকে এখনই কিছু না জানাতে। কারন করোনা পজিটিভ হিসেবে সনাক্ত হবার পর আমি যখন প্রথম হুইপস ক্রস হাসপাতালে যাই, সেই খবর জানার পর আমার আশি বছর বয়সী আম্মা জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছিলেন। এক ঘন্টা পর তাঁর জ্ঞান ফিরে এসেছিলো। তাই আম্মাকে নিয়ে ভীষণ ভয় হচ্ছিলো।
আমার নাক বরাবর সামনের ২ নম্বর বেডে একজন বয়স্কা এশিয়ান মহিলা অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন। বেল টিপ্ দিয়ে কাউকে ডাকার শক্তি নেই তাঁর। একবার তাঁর নাক থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে নিচে পড়ে গেলো। আমি আমার বেল টিপ্ দিয়ে নার্সকে ডাকলাম। নার্স আসতেই বৃদ্ধা মহিলাকে দেখিয়ে দিলাম। তাকে আবারো অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেয়া হলো। আমার ডান পাশে ৬ নম্বর বেডে একজন পাকিস্তানী বয়স্ক করোনা পুরুষ রোগী। সকাল থেকে তিনি ছটফট করছেন। বারবার নার্সকে নাক থেকে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে ফেলতে বলছেন। আমাদের দুজনের মাঝখানে পর্দা থাকায় তাকে দেখতে পারছিলাম না। কিন্তু সব কিছু শুনতে পারছিলাম। এও বুঝতে পারছিলাম তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম ডাক্তার ফোনে তাঁর সন্তানদের তাদের পিতাকে এসে শেষবারের মতো দেখার কথা বলছেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই তাঁর বড়ো ছেলে ও সম্ভবত তার স্ত্রী ওয়ার্ডে ঢুকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। কখনো ইংরেজিতে আবার কখনো উর্দু ভাষায় তারা কথা বলছিলেন। ছেলে বলছিলেন, “আব্বুজী গতকাল আম্মুজিকে আমরা লন্ডনে কবর দিয়ে তার পাশে আপনার জন্য জায়গা রেখেছি। কারণ এ পরিস্থিতিতে আপনাকে পাকিস্তানে নেয়া সম্ভব হবে না। আপনি আল্লাহজির কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হন”। পুত্র বধূ কোরআন থেকে তেলাওয়াত করছিলেন। ছেলে বাবাকে পবিত্র “জমজম” এর পানি পান করানোর চেষ্টা করছিলেন । পালা বদল করে দুজন দুজন করে তার বাকী সন্তানরা বাবার সাথে দেখা করতে আসতে থাকলেন। সবাই কাঁদছেন। তাদের কথা থেকে জানতে পারলাম তাদের মাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। থাকেন লেইটনে। ভদ্রলোকের সাত আটজন ছেলে – মেয়ে। তাদের কান্নায় পুরো ওয়ার্ড ভারী হয়ে উঠলো।
তখন আমার চোখে ভেসে উঠলো আমার স্ত্রী, তিন সন্তান, মা – বাবা আর ভাই – বোনের চেহারা। খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখে মন বিচলিত হয়ে উঠলো। এক ভয়ানক আতঙ্ক আমাকে অক্টপাসের মতো ঘিরে ধরলো। নিজেকে সাহসের সঙ্গে সামলে নিয়ে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। শুনতে পেলাম ভদ্র লোকের বড়ো ছেলে ডাক্তারকে অনুরোধ করছেন তাদের বাবাকে অন্যত্র কোনো আলাদা রুমে স্থানান্তর করতে, যাতে করে তারা সবাই কিছু সময় নীরবে তাদের বাবার সাথে কাটাতে পারে। পরে তাদের বাবাকে ৬ নম্বর বেড থেকে সরিয়ে নেয়া হলো। বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি সময়ে আমাকেও বলা হলো তোমাকে অন্য ওয়ার্ডে নেয়া হবে। নার্স জানালেন তুমি যেহেতু ক্যান্সার রোগী তাই তোমাকে যে ওয়ার্ডে কম রোগী আছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। কিছুক্ষন পর আমাকে দোতলায় প্রিস্টলি ওয়ার্ডে নেয়া হলো। বেড নম্বর সি ৬। মাত্র দুটি বেড এ রুমে। সি ৫ এ অন্য একজন রোগী শুয়ে আছেন। পরে তার নাম জানতে পারলাম। মালিক আলী। টার্কিশ ভদ্রলোক। ছেলেকে টেক্সট করে আমার ওয়ার্ড ও বেড নম্বর জানালাম। কোনো রকমে রাত পার হবার পর, শনিবার সকালে কনসালট্যান্ট ডাক্তার জন এন্ডারসন এসে আমাকে জানালেন যে, এক্সরে রিপোর্ট বলছে তোমার কোভিড নিউমোনিয়া হয়েছে। তোমাকে এক থেকে দু সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। তিনি আরো জানালেন, তোমার অক্সিজেন লেভেল স্বাভাবিক পর্যায়ে এলে, হাঁটতে পারলে এবং তোমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত হলে আমরা তোমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবো। তিনি চলে যাবার পর স্ত্রী ও বড়ো ছেলেকে টেক্সট করে সব কিছু জানালাম।
২ থেকে ৬ জানুয়ারী বিকেল পর্যন্ত আমার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দাঁড়াতে চেষ্টা করলেই কফ আর বুকের ব্যথা শুরু হতো। যেহেতু হাঁটার শক্তি ছিল না, তাই বেডের পাশে রাখা মোবাইল টয়লেটে দরকারি কাজ সারতে হতো। তারপর বেডে এসে বসলেই শুরু হতো শ্বাস – প্রশ্বাসের কষ্ট। তখন পাশের বেড থেকে জনাব মালিক আলী আল্লাহকে ডাকতে বলতেন। ৫ জানুয়ারী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত জনাব আলী সব সময় কথাবার্তা বলে আমাকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করতেন। যখনই আমার নার্সের দরকার হতো, তিনি বেড থেকে উঠে নার্সকে নিয়ে আসতেন। বাড়ি থেকে খাবার এলে আমাকে না দিয়ে খেতেন না। আমার বাড়ি থেকে খাবার এলে আমিও তাঁর সাথে শেয়ার করতাম। সত্যি করোনা অপরিচিত মানুষকে কাছের মানুষে পরিণত করতে সাহায্য করেছে তা বলা বাহুল্য।
সমগ্র প্রিস্টলি ওয়ার্ডে নানা বর্ণের করোনা রোগীর সমাগম। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙতো অন্য রুমে থাকা দু জন মহিলা রোগীর চিৎকার শুনে। এছাড়া সারাদিন- সারারাত রোগীদের কফ – কাশির শব্দ লেগেই থাকতো। আমার নাকে অক্সিজেন মাস্ক সর্বক্ষণ লাগানো থাকতো। একনাগাড়ে মাস্ক পরে থাকার ফলে নাক আর কানে ভীষণ ব্যথা করতো। একটু ভালো অনুভব করলে স্ত্রী, বড়ো ছেলে আর আমার ছোট ভাইকে টেক্সট করে আমার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থার কথা জানাতাম। যেহেতু আমাদের রুমে কোনো টেলিভিশন ছিল না, তাই কদাচিৎ সংবাদ শোনার জন্য ফেইসবুকে যেতাম। দেখতাম এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও পরিচিতদের অনেকেই সামাজিক দূরত্বকে অবহেলা করে বাড়িতে পার্টির আয়োজন করে তার ছবি পোস্ট করছে, ইংরেজি নব বর্ষ উৎযাপনের ছবি শেয়ার করছে, গানের আসরের আয়োজন করছে, একে ওপরের সমালোচনা করে মুখরোচক খবর পরিবেশন করছে, একই পরিবারে কারোর করোনায় মৃত্যুর ত্রিশ দিন পার না হতেই আরেক সদস্যের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের খবর – এসব দেখে, পড়ে মনে মনে ভাবতাম যারা এসব করছেন, তাদের মনে কি মৃত্যুর কোনো ভয় নেই? তারা কি টিভির সংবাদে বা ফেইসবুকে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মিছিল যে দীর্ঘায়িত হচ্ছে তা শোনেননি, দেখেননি? সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার কথা কি তারা ভুলে গেছেন? তীব্র মহামারীর স্রোতের আবর্তে আমাদের পরিচিত এবং আপনজনেরা কে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেন সে খবর কি তারা রাখেন? আদতেই মানুষ বিচিত্র প্রাণী!
৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর আমার অক্সিজেন লেভেলের মাত্রা কিছুটা কমিয়ে দেয়া হলো। ৭ জানুয়ারী সকালে ডাক্তার ওসামা এসে নাক থেকে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে নিলেন। বললেন যদি অক্সিজেন ছাড়া সারাদিন পার করতে পারি তাহলে আমাকে দু – এক দিনের মধ্যে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। শুনে মনটা ভালো হয়ে গেলো। উল্লেখ্য বয়সে তরুণ ডাক্তার ওসামা প্রতিদিন এসে আমার খোঁজ – খবর নিতেন। আমাকে সাহস যোগাতেন পজিটিভ থাকার জন্য। এছাড়া প্রচন্ড চাপের মুখেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রিস্টলি ওয়ার্ডের সব ডাক্তার আর নার্স ২৪ ঘন্টা আমাদের সবাইকে সেবা দিতে কোনো রকম কার্পণ্য করেননি। বিশেষ করে রাশান বংশোদ্ভূত নার্স গালিয়া হুকা, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নার্স পারভীন বেগম আর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত নার্স রেবেকা আমার যথেষ্ট দেখাশোনা করেছেন। বার বার এসে আমি কেমন অনুভব করছি, আমার কি দরকার তা জানতে চাইতেন। তাদের সবার কাছে আমি চির ঋণী হয়ে আছি। মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের মঙ্গল করুন। ৮ জানুয়ারী শুক্রবার, ডাক্তার জন এন্ডারসন আর ডাক্তার ওসামা আমাকে দেখতে এসে বললেন, “যেহেতু তোমার অক্সিজেন লেভেলের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে এবং গত চব্বিশ ঘন্টায় তোমার অক্সিজেন মাস্ক দরকার হয়নি, তাই আমরা সিদ্বান্ত নিয়েছি যে, তুমি আজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে”। শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। ডাক্তার ও নার্সদের ধন্যবাদ জানালাম। ডাক্তার এন্ডারসন বললেন, “ধন্যবাদ আমাদের দিও না, ইশারায় আঙ্গুল উপরের দিকে তুলে বললেন গডকে ধন্যবাদ জানাতে”। পরে টেক্সট করে স্ত্রী, বড়ো ছেলে এবং আমার ছোটো ভাইকে সুসংবাদ দিলাম। যেহেতু আমি ক্যান্সার রোগী, তার উপর নিউমোনিয়া হয়েছিল, তাই ডাক্তার আমাকে সাবধানে চলাফেরা করার পরামর্শ দিলেন। বললেন সম্পূর্ণ সুস্থ হতে তিন থেকে চার সপ্তাহ লাগবে। সবকিছু গুছিয়ে নেবার পর দুপুর আড়াইটার দিকে আমাকে হাসপাতালের রিসেপশনে আনা হলো। হাসপাতালের ট্রান্সপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা করলে অনেক বিলম্ব হবে বলে আমার বড়ো ছেলের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তাদের অনুরোধ করলাম। হুইল চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছি। বিশ মিনিটের মধ্যেই আমার বড়ো ছেলে এসে হাজির। বাবা – ছেলে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলাম। দুজনের চোখ থেকে অজর ধারায় পানি ঝরছে। ছেলে আমাকে গাড়িতে নিয়ে তুললো। নয়দিন পর আকাশ দেখতে পেরে মনে মনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বাড়িতে আসার পর স্ত্রী, ছোটো ছেলে আর মেয়েকে দেখে মহান রাব্বুল আল আমিনের কাছে আবারো শুকরিয়া আদায় করলাম। স্ত্রী, সন্তানরা আমাকে পেয়ে মহা খুশি। তাদের চোখে – মুখে স্বস্তি আর আনন্দের বন্যা বইতে দেখলাম। এ যেনো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!