কলোনিয়ান চিন্তার গন্ধ আমাদের আশপাশে যে কম তা বলা যাবে না। আমরা আশায় মন,ঘর,দুয়ার বাঁধলেও আমাদের পাশে নিরাশা ছায়ার মতো থাকে।
আমরা অনেক কিছু করতে চাই। ‘করবো‘ বলে দৌড়, লাফ দেই ;শেষ পর্যন্ত ‘করি না‘ বা ‘করা হয়ে ওঠেনা‘ এটাও অনেক ক্ষেত্রে ঠিক আছে।
এইসময়ের তারুণ্যরা শুধু চাকুরি আর সামাজিক পরিচয়কে বড় করে দেখে ডিগ্রী নিচ্ছে -বলেও যে কথাটা চাউর করেন ‘বুদ্ধিভিত্তিক‘ একটি শ্রেণী, সেটাকেও খুব হালকা ভাবে নিলেও উড়িয়ে দিচ্ছি না।
আমরা বলি এক আর করি অন্যটা। বিকাল হলে ‘আন্দোলন-ফান্দোলন‘কারীরা ওই দলকানাদের কথাতেই চলেন এবং দলকানাদের কথাই স্যোসাল মিডিয়ায় প্রচার করেন ইত্যাদি যারা বলে বেড়াতে অভ্যস্থ,ভালোবাসেন; আপনাদের এইসব ‘আবুল-তাবুল কথাবার্তা‘র মোটাদাগে প্রতিবাদ করছিনা এখানে।
আসলে, আমরা সাধারণরা, এখানে কিছুই বলতে চাইছিনা। আমরা আমাদের মতো আছি। আমাদের ভাবনায় আমরা শক্ত,ষ্পষ্ট আছি। আমরা ‘না জেনে‘ , ‘না বুঝে’ উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভাবে করছি না।
এটাও অবলোকনে আছে, সচেতনমহল সহ সবাই স্পষ্টত যার যার অবস্থানেই আছি।
যেমনটি চলছে কয়েক বছর থেকে। আমাদের শিক্ষকরা ভাগ হয়ে আছেন। রাজনীতি,দলনীতি,স্বার্থবাদিতার কারণেই ভাগ হয়ে আছেন। আশ্চর্য হলেও ঠিক, জাতীয় প্রয়োজনে, কোনটা সর্বসাধারণের, কোনটা প্রতিবাদের, কোনটা প্রতিবাদের না- তারা জানেন ভালো করে। সেটা নিয়েও তাঁরা ভাগ হয়ে আছেন।
আমাদের কয়েকজন দেশসেরা ‘স্বপ্ন দেখানো‘ স্যাররাও চুপ হয়ে আছেন। আমার ধারণা, তাদের স্বপ্নগুলো বিক্রি করতে হবে ভেবেই, একুশে বইমেলায় ‘বই এর মোড়কে‘ বিক্রির জন্যই তারা এই তারুণ্যদের জন্য রেখে দিয়েছেন।
আমাদের একটি সুশীল অতিব বোদ্ধাসমাজ আছে। তাদের সাথে আমরা অনেকে সুশীলবান্ধব হয়েই আছি। টিভি টক শো, সংবাদপত্রের কলামেও আমরা এই বিষয়ে কথা বলি না।স্পষ্টত এড়িয়ে চলাই তাদের কাছে যেন ‘বুদ্ধিমানের’ কাজ।
প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়াতে আমাদের শারীরিক অক্ষমতা; হাই প্রেসার-লো প্রেসার-ডায়ালাইসিস-বাইবাস এর অজুহাত দেখিয়ে দিব্যি বিদেশ ঘুরে বিলাতি চামড়া ধারণ করে বেশ ভালোভাবেই বিভিন্ন রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতায় চলা ‘হাফহাতা বুদ্ধিজীবি সমাজ‘।
আমরা অনেকে দলকানা অন্ধ হয়ে আছি। চোখ খোলা অন্ধ চোখে আছি। মুখে-বোধে আঠা লাগিয়েই আছি। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল এর বাংলাদেশের আলো-হাওয়া- অক্সিজেন নিয়েই দিব্যি আছি।
আরেক শ্রেণী আছে, যারা বিশ্বাসে চলে-আমাদের দল ক্ষমতায় আছে, চাটার দল আশপাশে আছে, কালো টাকা আছে, আগাম ক্ষমতার হাতছানি তো আছেই। সমস্যা নাই। রাজনীতির ওয়েট এন সি তত্বতেই থাকি!
নিতান্ত ‘নগন্য‘ বলে যাদের পাত্তাই দেয়া হয় না সব সময়। সব যুগে। যারা ঘরে কাজ করে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষালয় ও বাড়ি যাওয়া- আসা করে, টিফিন নিয়ে শ্রমিক গার্মেন্টসে যায়-আসে। ফুটপাতে দোকান দেয়, রিকসা চালায়, অতিসাধারণ জনগণ। সাথে আছে অগণন জনগন যারা কাজ না করেও সরকারকে টেক্স দেয়। তাদেরকে পাত্তা দেওয়ার মতো যাদের কোন যুক্তি মাথায় থাকে না, বোধে আসে না। এমনকি চিন্তা শৈলীর আশপাশেও তারা থাকে না। ‘নাগরিক অধিকার‘ বলে জনগণের জন্য আইনসিদ্ধ অধিকার আছে বলেও যারা ভাবতে চায় না। তাদের সংখ্যা আসলে সতের কোটি বাংলাদেশে কত শতাংশ?
সাথে সাথে আরেকটি তথ্য জানতে ইচ্ছে করে- রাষ্ট পরিচালনায় রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাধারী,পদধারী যারা আছেন, আমলাতন্ত্রে যারা আছেন, আতেল,চাটুকার,দূর্ণীতির প্রশ্রয় যারা দেয়,তাদের হয়ে যারা কাজ করে- তাদের সংখ্যা আসলে কত হবে, সতের কোটির বাংলাদেশে?
যে কাজটা অনেক আগে হবার কথা ছিল, যেসব কাজগুলোতে অনেক আগেই প্রতিনিধিত্বশীল ভুমিকায় যাবার কথা ছিল সেই কাজগুলোতে ‘সৎ সংখ্যাঘরিষ্ট‘দের একটা অংশ মাঝে মাঝে জেগে ওঠছে। আরও আশার খবর হলো- এই জেগে ওঠায় এই ‘সংখ্যাঘরিষ্টরা‘ ধারাবাহিক ভাবেই আছেন। আমাদের চেতনায় লাল রক্ত কণিকাগুলো যে আদর্শিক স্ফোরণ ছড়াচ্ছে বার বার এটা নিয়ে আশংঙ্খা, দ্বিমত, ‘যদি‘, ‘কিন্তু‘ র সুযোগটি স্পষ্টতও নেই।
৫২,৬৯,৭১,৯০ এ এই রকম ভাবেই আমরা জেগেছিলাম। আমরা কষ্ট সইতে সইতে, অধিকার হারাতে হারাতে, বঞ্চিত হতে হতে, অন্যায় না করেও গায়ের কাপড় রক্তলাল হতে হতে, মায়ের মন ও চোখের কষ্ট, আর্তনাদ দেখতে দেখতে, কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের করুন দৃশ্য দেখতে দেখতে, আমরা জেগে ওঠে ছিলাম । আমরা জেগে ছিলাম বলেই ৫২,৬৯,৭২,৯০ বাংলাদেশে হীরন্ময় ইতিহাস। নির্যাতন, অন্যায়, অবিচার ,অত্যাচারিতের কাছে আমরা চক্ষুশুল। আমরা তাদের প্রতিবাদী বারুদ।
আমরা সত্য, ন্যায়ের পথে আছি বলেই- প্রতিবাদে আছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠছি বলেই রাজপথ আমাদের মুক্তির ঠিকানা হয়েছে। আমরা এক আদর্শ চিন্তার বলেই সবার বক্তব্য একই সুরে বাঁধা। হাতগুলো মুষ্টিবদ্ধ,উচ্চশীর, রক্ত গরম করা আমাদের কণ্ঠস্বর।
আমরা আলোর পথ খুঁজছি বলেই সন্তানের মা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে সন্তানদের ভবিষ্যত এর কৃঞ্চচুড়া- রক্ষজবা সৌন্দর্য দেখছেন। আলোর স্ফোরণ এর মতো রাজপথে থাকা অগণিত সন্তানের মা‘দের চোখগুলো সামনে থাকছে আনন্দের ঝিলিক ছড়িয়ে।
আবার দৃশ্যকাব্যের অন্য পাশে আছে আরেক দৃশ্যপট। ‘মেধাবী, কোমলমতি শিক্ষার্থী’, ‘তারুণ্যের হাতেই আমাদের আগামীর বাংলাদেশ’, ‘নতুন প্রজন্মরাই আলোকিত বাংলাদেশ গড়বে‘- বলে যারা বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখায়, সেমিনারে বুলি আওড়িয়ে হাততালি আর খবরের কাগজের শিরোনাম হতে থাকেন; তাদের বোধে সজরে চপেটাঘাত দিয়ে এই ‘তারুণ্য‘ দেখিয়ে দিচ্ছে- মানবিকতার বিষয়টি আসলে বোধের বিষয়, চর্চার বিষয়। প্রথাবদ্ধ ভারী তত্বকথামালার বিষয় নয় মোটেও। পাকনা চুলে, ভারী ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে ধীর লয়ে কথা বলে , বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী, বিশেষজ্ঞ বা বয়েসে ‘বড়‘ হয়ে ওঠার বিষয় নয়। রাজপথে, সংগ্রামে সাহসে যেখানে যেভাবে কথা বলা, জেগে ওঠা, দাঁড়িয়ে থাকা দরকার, সেটা সেখানেই করতে হয়। ইতিহাসের সহজপাঠটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বার বরা করে দেখিয়েছে আর এইসব বর্ণচোরাদের আসল চেহারা স্বচ্ছভাবে বার বার প্রকাশও করেছে এই তারুণ্যদল।
এই তারুণ্যরাই আমাদের স্বপ্ন জাগরণের চালিকা শক্তি। বাংলাদেশ দেখছে শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলন করছে আবার বাড়ী ফেরার পথে রাস্তায় পথে থাকা আবর্জনা ও পথচারিদের জন্য পথ পরিস্কার করছে। ‘আমাকে যেতে দিন,প্লিজ‘ বলে এ্যাম্বুলেনস্ সাইরেন শুনার পরে রাস্তাটা তারাই খালি করে দিচ্ছে। হজ যাত্রীদের গাড়ি গুলো তারাই খুঁজে খুঁজে বিমান বন্দরে যাবার পথ করে দিচ্ছে। চুরাগুপ্তা ও সহিংসদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে শাহবাগ যাচ্ছে সবার সাথে জড়ো হতে। পেটুয়া পুলিশকেও তাদের কাছে আইনভঙ্গের জন্য জবাবদিহি করতে হয়েছে।মন্ত্রীর গাড়ি আটকিয়ে যুক্তিদিয়ে ‘আইন মানতে’ মন্ত্রিকে বাধ্য করেছে আগামীর বাংলাদেশের তারুণ্যরাই।
আবার মায়েরা বোতলে করে পানি এনে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছেন।
হাজার হাজার স্যোসাল একটিভিষ্টরা দিন- রাত স্যোসাল মিডিয়ায় এই তারণ্যদের অনুপ্রেরণায় কাজ করছে। প্রতিবাদের রক্ত , নির্যাতিতদের রক্ত আর সাহস-সংগ্রামের রক্তগুলোর শক্তি কত যে ‘শক্তিশালী‘, চোখ খুললেই রাজপথে দেখা যাচ্ছে দুদিন থেকে।
সতের কোটির বাংলাদেশ এর প্রতিচ্ছবি এই প্রিয় তারুণ্যরা-ই। এই আন্দোলনে সরবে, কাছে দূরে থেকে যারা অনুপ্রেরণা যুগিয়ে আছেন, কাজ করছেন- তারাই বাংলাদেশ।
আমরা জেগে আছি যেমন সত্য, তেমনি আরেকটি সত্যও ভুলা যাবে না, ভুলে থাকা সম্ভব না; বর্ণচোরা সুশীল,স্বার্থান্ধ, বধির,সুবিধাভোগী সমাজপতিদের। যারা বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর হয়ে এই তারণ্যদের শুধু কথার ‘উপদেশ বমি‘ ছাড়ে।
ইতিহাসে তাদেরও আস্তাকুড়ে ফেলার সময় এসেছে।
অভিবাদন তারুণ্য। পাশে আছে ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের কোটি কোটি তারুণ্য। বয়েসে বড় হয়েও যারা বোধ ও মানবিক আলোয় বাংলাদেশকে দেখে তারাও পাশে আছে। আমরাই বাংলাদেশ। মীরজাফর, জিন্নাহ, মুশতাক, গোলাম আযমদের অপছায়ায় আমরা যে বেড়ে ওঠছিনা, লাখো বীর শহীদের রক্তকণিকায় আমরা জেগে আছি –সতের কোটির বাংলাদেশ দেখছে। আর আগামীর প্রত্যয়ে হাসছে…
জাগো বাগে কোনঠে সবায়…
আনোয়ারুল ইসলাম অভি; কবি, সাংবাদিক