এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইরান। পূর্বে একে পার্সিয়া বা পের্সিয়া বলা হলেও পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালের দিকে বিশ্বের বুকে ইরান নামেই দেশটির আতœপ্রকাশ ঘটে। সভ্যতার ইতিহাসে ইরান বেশ প্রাচীন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী স্থান দখল করে আছে। মানব সভ্যতার দিক থেকে সাড়া জাগানো বেশ কিছু প্রাচীন নিদর্শনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বিখ্যাত কবি হাফিজের মাতৃভূমি এই দেশটিতে।
কানাত- এমনই এক প্রাচীন নিদর্শন, যার কথা বিচার-বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় প্রাচীন ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞানে কী পরিমাণ সমৃদ্ধশালী ছিল। প্রায় ৩০০০ বছর আগের ঘটনা সেটি। জেনে রাখা ভাল, ইরান কিন্তু কোনো সমভূমির দেশ নয়। এর ভূপ্রকৃতি রুক্ষ আর বন্ধুর। ইরানের চারপাশে প্রচুর পাহাড়-পর্বত রয়েছে। সেসব পর্বতমালা পারস্য উপসাগর আর ওমান সাগরের তীরে এসে আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে বিরাট মরুভূমির প্রান্তে এসে মিশেছে। ইরানের মরুভূমি শুষ্ক আর দূর্গম। দেশটির মোট আয়তনের মধ্যে মরুভূমি প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। অবাক হওয়ার মত বিষয় হল, এমন দূর্গম মরুভূমি ও পাহাড়-পর্বতের বেষ্টনীর মাঝেও ইরান ছিল বেশ উন্নত ও প্রভাবশালী দেশ। এখনো ইরানের অনেক প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে, যা জাতি হিসেবে তাদেরকে আজও পৃথিবীর বুকে গর্বের আসনে আসীন করে রেখেছে। যার প্রমাণ, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া ইরানের ২১ টি প্রাচীন স্থাপনা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। যার অন্যতম হচ্ছে প্রাচীন ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের আশ্চর্যকর নিদর্শন ‘কানাত’।
কানাত মূলত প্রাচীন পারস্য তথা ইরানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। প্রাচীন ইরানে মরুভূমি সমূহে পানীয় জলের অভাব ছিল ভীষণ। পানির অভাবে জনজীবন ছিল নিদারুণ কষ্টের। আর তাই তৎকালীন শাসক তার সামাজ্র্যের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে বসলেন। যার ফলশ্রুতিতে তৎকালীন শাসকের সহযোগিতা আর বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হল- কানাত। বৈপ্লবিক আবিষ্কার কানাত পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মরুভূমির নিচ দিয়ে খাল খননের মাধ্যমে মূল শহর পর্যন্ত পানির ব্যবস্থা করে পুরো ইরানের চেহারাই পাল্টে দিয়েছিল। তবে পরিকল্পনার পর, পুরো বিষয়টিকে বাস্তবে রুপ দেয়া ছিল বেশ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কারণ ইরানের পাহাড়-পর্বতগুলোর বেশির ভাগই কঠিন শিলা পাথরের। পাথুরে মাটি খনন করা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। আবার পাহাড়ী অঞ্চল থেকে মূল শহরের দূরত্বও ছিল অনেক।
তবে পারস্য সম্রাট সব বাধা উপেক্ষা করে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছিলেন অনড়। আর অতঃপর তাই পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু হল। মরুভূমির বুক চিরে অনেক গভীরে গর্ত করে পরপর নির্দিষ্ট দূরত্বে তৈরী করা হতো একই রকম গর্ত। ইংরেজী ভাষায় এদের পোষাকী নাম হল- চ্যানেল। চ্যানেলগুলোর মধ্যে মানুষ ঢুকে নিচে তলদেশে গিয়ে মাটি খুড়ে একটি সরু খাল খনন করতো। সেই খাল শহরের মধ্যে বিভিন্ন নির্দিষ্ট স্থানে ছড়িয়ে পড়তো। বালু ও নুড়ি পাথরের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো বলে এই পানি ছিল বেশ পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ। পান করা, রান্নাবান্না ছাড়াও কৃষি কাজে ব্যবহার হতো কানাতের পানি। এসব চ্যানেলগুলোতে পানি সরবরাহের পাশাপাশি ধরে রাখার ও ব্যবস্থা ছিল। তবে শঙ্কা ঠিকই ছিল, এই পদ্ধতি কতটা কাজ করবে তা নিয়ে। তবে ভয়কে জয় করা সম্ভব হয়েছিল বলেই তৎকালীন মরুভূমির বুকে গড়ে ওঠা পারস্য সভ্যতার দেশ ইরান আজ দাপটের সাথে বিশ্ব দরবারে দাড়িয়ে আছে।
তবে কাজ শুরু করার প্রথম ধাপটি ছিল বেশ কঠিন। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে মাটি খনন করতে হতো, তৈরী করা হতো সুড়ঙ্গ। যতক্ষণ না পানির দেখা মিলছে, ততক্ষণ পাথুরে মাটি খনন চালিয়ে যেতে হতো। স্বাভাবিক ভাবেই প্রাচীন কালে এখনকার মতো আধুনিক ড্রেজিং যন্ত্রপাতির চিন্তাই করা যেত না। তাই প্রাচীন হাতুড়ি শাবল ছিল বলা চলে একমাত্র সম্বল। খনন করা সুড়ঙ্গ দিয়ে নিচে নামার জন্য ব্যবহার করা হতো একটি বাঁশের কাঠের তৈরী চড়কার চাকার মতো প্রযুক্তি। তাতে করে শ্রমিকদেরকে সুড়ঙ্গে নামানো হতো, আবার নিচ থেকে মাটিও তুলে আনা হতো। পানির সন্ধান পাওয়ার পর আরেকটি সুড়ঙ্গ কাটা হতো, যেটি চলে যেত পাহাড়ের ঠিক অপর পাশে। আড়াআড়ি সুড়ঙ্গটি এমনভাবে তৈরী করা হতো, যাতে করে পানি মাটির নিচের দিকে ভাল ভাবে প্রবাহিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকে। আর মাঝের চ্যানেলগুলোর কাজ ছিল, পানি প্রবাহের ধারায় বাতাসের পর্যাপ্ত চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
চ্যানেলগুলোর গভীরতা এতোই থাকতো যে, কোনো প্রকার দূষণের ভয় থাকতো না। এমনকি উপরের মরু তাপের কারণে নিচে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকতো না। কঠোর পরিশ্রমে নির্মিত কানাতগুলো ঠিকঠাক রাখার জন্য নিয়মিত দেখভালের পাশাপাশি বছরে বছরে মেরামত করতে হতো। এই পানি এতোটাই পরিষ্কার এবং বিশুদ্ধ ছিল যে, লোকজন নিঃসঙ্কোচে পানি পান করতো এবং পানিবাহিত কোনো রোগ বালাইয়ের ভয়ও ছিল না। মাটির নিচে প্রবাহমান খালগুলোর শেষ মাথায় পানি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকতো। লোকজন চাইলেই তাদের প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহার করতে পারতো। পানি নিয়ে শাসকশ্রেণী থেকে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। তবে পানির অপচয় রোধে সবাই যথেষ্ঠ সচেষ্ঠ ছিল। যা হাজার হাজার পরও এই সভ্যযুগে শিক্ষণীয়। প্রাচীনকালে কৃষিই ছিল মানুষের প্রধানতম পেশা। এই পানি ব্যবহার করে ইরানের কৃষি খাতের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ফলে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়।
সবচেয়ে প্রাচীন ও দীর্ঘতম কানাতের অবস্থান ইরানের কেন্দ্রে অবস্থিত খোরাসান প্রদেশের যার্ক শহরে। তবে গোনাবাদের কানাত সবচাইতে প্রসিদ্ধ, যেটি ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে অর্ন্তভুক্ত হয় ২০০৭ সালে। আর ২০১৬ সালে আরো দশটি কানাতকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে ঘোষনা করা হয়। তাই এই সংখ্যা এখন ১১ টি। অন্য দশটি কানাত হলো- হাসাম আবাদ-ই মশির, বালাদেহ, জারচ, ইবরাহিম আবাদ, ভাজভান, মোজদ আবাদ, দি মুন, গোওহারিজ, কাসেম আবাদ এবং আকবর আবাদ।
তবে কানাতের শুরু প্রাচীন ইরানে হলেও পরবর্তীতে আরো কয়েকটি দেশ পানির চাহিদা মেটাতে এই যুগান্তকারী পদ্ধতি অনুসরণ করে। যার মধ্যে ছিল বর্তমান মরক্কো, স্পেন, আলজেরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্থানের মতো মরু ও পার্বত্য বেষ্টিত দেশ। কানাতের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর সিল্ক রোড থেকে শুরু করে মুসলিম বিজিত অঞ্চল সমূহে। আর এর মাধ্যমেই আন্দাজ করা যায়, কানাতের আবিষ্কার কতটা বৈপ্লবিক ও ফলপ্রসু ছিল, যা সাড়া জাগিয়ে ছিল দেশ থেকে দেশান্তরে, রাজ্য থেকে সামাজ্র্যে।
লেখক : ভ্রমণ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক এবং ব্যাংক কর্মকর্তা।