ঢাকা ০৫:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ কেন বন্ধ করলো অন্তর্বর্তী সরকার? সাংবাদিক আনিস আলমগীর ও অভিনেত্রী শাওনসহ চারজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে সরকার সমালোচক সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে আটক ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যা করেনি’  চবি উপ-উপাচার্যের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ঢাবিতে ‘রাজাকার ঘৃণাস্তম্ভ’, জুতা নিক্ষেপ লন্ডনে তারেক রহমানের শেষ কর্মসূচি ১৬ ডিসেম্বর গোলাম আজম ও নিজামীকে দেশপ্রেমিক বলায় পাবনায় প্রতিবাদ মিরপুরের বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল, ঘাতকদের বিচারের দাবি জগন্নাথ হলের সড়কে ছাত্রদের আঁকা গোলাম আজমদের ছবি মুছে দিল প্রশাসন

বিবিসি নিউজ বাংলা’র প্রতিবেদন

বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ কেন বন্ধ করলো অন্তর্বর্তী সরকার?

জান্নাতুল তানভী
  • আপডেট সময় : ০৩:০৭:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
  • / 12

বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ

অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় বিজয় উদযাপন প্রস্তুতি। প্রায় প্রতিবছরই ১৬ই ডিসেম্বর দেশটির বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে সেই উদযাপনেরই একটি অংশ হিসেবে থাকে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান।

গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে আটই অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসার চার মাসের মাথায় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান স্থগিত ঘোষণা করে।

তবে এক বছর পর এ বছরও এই অন্তর্বর্তী সরকার বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান স্থগিত করেছে।

গত ১৯ শে নভেম্বর দেশটির স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, “বিজয় দিবসে অস্থিরতার আশঙ্কা নেই। আগে যেমন ছিল এবারও কর্মসূচি থাকবে। বরং আগের চেয়ে কর্মসূচি বেশি হবে। তবে এবারও প্যারেড কর্মসূচি হবে না।”

কেবল রাজধানী নয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়েও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান হচ্ছে না বলে জানানো হয়।

তবে বিজয় দিবসে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নিজেদের সামরিক শক্তির প্রদর্শন করে এবং এটি ঐতিহাসিক রেওয়াজ বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এদিকে, কুচকাওয়াজ হলে রেওয়াজ অনুযায়ী সামরিক বাহিনীগুলোকে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সালাম দিতে হবে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ‘বিব্রতকর’, এটিকে কুচকাওয়াজ না হওয়ার পেছনে একটি কারণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

এ বিষয়ে কথা বলতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বছরও কুচকাওয়াজ হবে না- নভেম্বরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই তথ্য জানানোর পর গত পাঁচই ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, কুচকাওয়াজ বন্ধ করার কোনো কারণ নেই। প্রস্তুতির সময় না পাওয়ায় কুচকাওয়াজ হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

মি. আলম সাংবাদিকদের বলেন, গত বছর অগাস্টের পাঁচ তারিখের পর থেকে বাংলাদেশের মিলিটারি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় পুরো বাংলাদেশে নিয়োজিত আছে।

“৬০-৭০ হাজার আর্মি ট্রুপস তারা ডিউটি করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদেরকে সাহায্য করার জন্য। সেজন্য একটা কুচকাওয়াজ করার জন্য যে প্রস্তুতি থাকে সেটা তো অনেক ক্ষেত্রেই এই সময়ে আমরা পাচ্ছি না সেজন্য ” বলেন মি. আলম।

তিনি মন্তব্য করেন, কুচকাওয়াজ নিয়ে যারা পরিস্থিতি ঘোলা করতে চাচ্ছেন, তারা সেনাবাহিনী ১৬ মাস বাইরে ডিউটি করছেন এমন বিষয় আমলে নিচ্ছেন না।

তাদের ক্যান্টনমেন্টে থাকার কথা ছিল, কিন্তু তারা টহল দিচ্ছেন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য, বলেন তিনি।

এদিকে, ১০ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন বলেও জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ এবার সর্বাধিক পতাকা উড়িয়ে প্যারাসুটিং করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে স্বাধীনতার ৫৪ বছর উদ্‌যাপনে ৫৪ জন প্যারাট্রুপার পতাকা হাতে স্কাই ডাইভিং করবেন। এটিই হবে বিশ্বের বুকে সর্বাধিক পতাকা হাতে প্যারাস্যুটিং, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়বে।

একইসাথে বিজয় দিবসের দিন সকাল এগারটা থেকে ঢাকার তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী পৃথকভাবে ফ্লাই পাস্ট মহড়া পরিচালনা করবে।

এছাড়া দেশের অন্যান্য শহরেও তিন বাহিনী ফ্লাই-পাস্ট মহড়া পরিচালনা করবে।

সারাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ বাহিনী, বিজিবি, আনসার বাহিনী ও বিএনসিসি’র বাদক দল বাদ্য পরিবেশন করবে।

এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিজয় মেলার পাশাপাশি শিশুদের অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।

এছাড়া বিনা টিকেটে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, জাদুঘর উন্মুক্ত রাখাসহ নানা আয়োজন করবে অন্তর্বর্তী সরকার। কনসার্ট, জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ নানা অনুষ্ঠানও আয়োজন করার কথা বলা হয়েছে।

একইসাথে প্রতিবছরের মতো এবারেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠান, জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে।

চব্বিশে ক্ষমতাচ্যুত ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ কুচকাওয়াজ বাতিল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া একটি পোস্টে।

“এটা আসলে একটি প্রতীকী আত্মসমর্পণ। পাকিস্তান যে দেশটিকে ১৯৭১ সালে হারিয়েছিল, সেই পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা শক্তি এখন বাংলাদেশে ক্ষমতায়। তারা কীভাবে সেই পরাজয়ের দিনটি উদযাপন করবে?” ফেসবুক পোস্টে বলেছে আওয়ামী লীগ।

কুচকাওয়াজে কী থাকে?
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগের বিজয় দিবসগুলোতে দেখা গেছে, শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতারাসহ সাধারণ মানুষের ঢল নামতো সাভারে স্মৃতিসৌধে।

এছাড়া রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দর যেটি জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড, সেখানে সেনা, নৌ ও বিমান এই তিন বাহিনীর এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হতো। এতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা উপস্থিত থাকতেন। তিন বাহিনীর প্রধানও সেখানে উপস্থিত থাকতেন।

২০২৩ সালের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিন বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সালাম গ্রহণ করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

এছাড়া বিমান বাহিনী ফ্লাই পাস্ট এবং অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে করে। আকাশ থেকে নেমে আসেন প্যারা ট্রুপাররা।

বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে সাঁজোয়া যানগুলো এই কুচকাওয়াজে প্রদর্শন করা হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবায়দা নাসরীন মনে করেন, বিজয় দিবসে কুচকাওয়াজ অর্থ হলো একটা রণকৌশল, শৃঙ্খলা এবং এমন একটা উদ্যমের জায়গা যা বহুবছর ধরে এটি বিজয় এবং স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

“সরকারকে খোলাসা করতে হবে কেন কুচকাওয়াজ বন্ধ হলো। গতবছর নিরাপত্তার কারণ দেখিয়েছে, এবার কোনো কারণই দেখায়নি। কিন্তু কুচকাওয়াজ আর অন্যান্য অনুষ্ঠান কোনোভাবেই রিপ্লেসের জায়গা না,” বলেন মিজ নাসরীন।

কেন কুচকাওয়াজ হয়?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, প্রজাতন্ত্র দিবস বা একটি দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কুচকাওয়াজ বা প্যারেড অনুষ্ঠানের রেওয়াজ রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে লেখেন মহিউদ্দিন আহমদ।

তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, ভারত, পাকিস্তান, চীন, উত্তর কোরিয়াসহ এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই সামরিক সক্ষমতার প্রকাশে এই ধরনের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।

মি. আহমদ বলেন, “যেসব দেশে কুচকাওয়াজ হয়, প্রায় প্রতিটি দেশই তাদের সামরিক সক্ষমতার নিদর্শন ডিসপ্লে করে। যেমন- ভারত তাদের মিসাইল ডিসপ্লে করে।”

“আমাদের এখানে রাষ্ট্রবাদের প্রকাশটা দেখি মিলিটারি বাহিনীর কুচকাওয়াজের মাধ্যমে। রাষ্ট্রবাদীরা মনে করে সামরিক সরঞ্জাম, মারণাস্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এটা দিয়েই বুঝি স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়,” বলেন মি. আহমদ।

মি. আহমদ মনে করছেন, এ বছর কুচকাওয়াজ না হওয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি আর্থিক এবং অপরটি রাষ্ট্রপতিকে সালাম প্রদান।

রেওয়াজ অনুযায়ী, বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে তিন বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী রাষ্ট্রপতিকে সালাম প্রদান করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে বিব্রত বোধ করে বলে মনে করেন মি. আহমদ।

“কুচকাওয়াজে সালাম নেন রাষ্ট্রপতি। এখন তো সমস্যা হয়ে গেলো যে, এই রাষ্ট্রপতিকে তো অফিসিয়ালি ডিসপ্লে করা যাচ্ছে না। কেননা এটা বিব্রতকর এই সরকারের জন্য এবং অন্য আরো অনেকের জন্য,” বলেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

কেন বিব্রতকর এমন প্রশ্নে মি. আহমদ বলেন, “কারণ তিনি আমাদের পতিত ফ্যাসিস্ট শাসকদের অবশেষে হিসেবে থেকে গেছেন এই রাষ্ট্রপতি। কুচকাওয়াজের সাথে সাথে তো তাকেও ডিসপ্লে করতে হয় যেহেতু তিনি সালাম নেন। তো সেটা খুব বিব্রতকর।”

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য দেশটি প্রস্তুত- এমন বিষয়ও বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের প্রতীকী রূপ।

মিজ নাসরীন অবশ্য মনে করেন, এ বছর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ বন্ধ রাখার পেছনে সরকারের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে।

সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

“কোনো কারণ প্রদর্শন না করে কুচকাওয়াজ বন্ধ হওয়া ইঙ্গিত করে যে অনেক কিছুই বন্ধ হবে। মেলা বা অন্যান্য কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কোনোভাবেই কুচকাওয়াজের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিকভাবে চর্চিত বিষয়কে খারিজ বা প্রতিস্থাপন করে না,” বলেন মিজ নাসরীন।

কুচকাওয়াজ বন্ধের পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের “বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে” বলেও উল্লেখ করেন মিজ নাসরীন।

তিনি বলেন, “কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর চাপ থাকতে পারে সরকারের ওপরে, কিংবা সরকার কোনো না কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য এটা করতে পারে তারা।”

কুচকাওয়াজ হচ্ছে এমন একটি প্রতীকী শক্তি যেটার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, গৌরব, দেশপ্রেমকে আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় বলেও তিনি মনে করেন। “মুক্তিযুদ্ধকে মানুষ যাতে পুনরায় স্মরণ করতে না পারে সেজন্য বাধা দেওয়া, হুমকি তৈরি করাও” উদ্দেশ্য হতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজ নাসরীন।

নিউজটি শেয়ার করুন

বিবিসি নিউজ বাংলা’র প্রতিবেদন

বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ কেন বন্ধ করলো অন্তর্বর্তী সরকার?

আপডেট সময় : ০৩:০৭:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় বিজয় উদযাপন প্রস্তুতি। প্রায় প্রতিবছরই ১৬ই ডিসেম্বর দেশটির বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে সেই উদযাপনেরই একটি অংশ হিসেবে থাকে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান।

গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে আটই অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসার চার মাসের মাথায় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান স্থগিত ঘোষণা করে।

তবে এক বছর পর এ বছরও এই অন্তর্বর্তী সরকার বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান স্থগিত করেছে।

গত ১৯ শে নভেম্বর দেশটির স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, “বিজয় দিবসে অস্থিরতার আশঙ্কা নেই। আগে যেমন ছিল এবারও কর্মসূচি থাকবে। বরং আগের চেয়ে কর্মসূচি বেশি হবে। তবে এবারও প্যারেড কর্মসূচি হবে না।”

কেবল রাজধানী নয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়েও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান হচ্ছে না বলে জানানো হয়।

তবে বিজয় দিবসে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নিজেদের সামরিক শক্তির প্রদর্শন করে এবং এটি ঐতিহাসিক রেওয়াজ বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এদিকে, কুচকাওয়াজ হলে রেওয়াজ অনুযায়ী সামরিক বাহিনীগুলোকে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সালাম দিতে হবে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ‘বিব্রতকর’, এটিকে কুচকাওয়াজ না হওয়ার পেছনে একটি কারণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

এ বিষয়ে কথা বলতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বছরও কুচকাওয়াজ হবে না- নভেম্বরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই তথ্য জানানোর পর গত পাঁচই ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, কুচকাওয়াজ বন্ধ করার কোনো কারণ নেই। প্রস্তুতির সময় না পাওয়ায় কুচকাওয়াজ হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

মি. আলম সাংবাদিকদের বলেন, গত বছর অগাস্টের পাঁচ তারিখের পর থেকে বাংলাদেশের মিলিটারি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় পুরো বাংলাদেশে নিয়োজিত আছে।

“৬০-৭০ হাজার আর্মি ট্রুপস তারা ডিউটি করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদেরকে সাহায্য করার জন্য। সেজন্য একটা কুচকাওয়াজ করার জন্য যে প্রস্তুতি থাকে সেটা তো অনেক ক্ষেত্রেই এই সময়ে আমরা পাচ্ছি না সেজন্য ” বলেন মি. আলম।

তিনি মন্তব্য করেন, কুচকাওয়াজ নিয়ে যারা পরিস্থিতি ঘোলা করতে চাচ্ছেন, তারা সেনাবাহিনী ১৬ মাস বাইরে ডিউটি করছেন এমন বিষয় আমলে নিচ্ছেন না।

তাদের ক্যান্টনমেন্টে থাকার কথা ছিল, কিন্তু তারা টহল দিচ্ছেন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য, বলেন তিনি।

এদিকে, ১০ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন বলেও জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ এবার সর্বাধিক পতাকা উড়িয়ে প্যারাসুটিং করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে স্বাধীনতার ৫৪ বছর উদ্‌যাপনে ৫৪ জন প্যারাট্রুপার পতাকা হাতে স্কাই ডাইভিং করবেন। এটিই হবে বিশ্বের বুকে সর্বাধিক পতাকা হাতে প্যারাস্যুটিং, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়বে।

একইসাথে বিজয় দিবসের দিন সকাল এগারটা থেকে ঢাকার তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী পৃথকভাবে ফ্লাই পাস্ট মহড়া পরিচালনা করবে।

এছাড়া দেশের অন্যান্য শহরেও তিন বাহিনী ফ্লাই-পাস্ট মহড়া পরিচালনা করবে।

সারাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ বাহিনী, বিজিবি, আনসার বাহিনী ও বিএনসিসি’র বাদক দল বাদ্য পরিবেশন করবে।

এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিজয় মেলার পাশাপাশি শিশুদের অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।

এছাড়া বিনা টিকেটে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, জাদুঘর উন্মুক্ত রাখাসহ নানা আয়োজন করবে অন্তর্বর্তী সরকার। কনসার্ট, জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ নানা অনুষ্ঠানও আয়োজন করার কথা বলা হয়েছে।

একইসাথে প্রতিবছরের মতো এবারেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠান, জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে।

চব্বিশে ক্ষমতাচ্যুত ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ কুচকাওয়াজ বাতিল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া একটি পোস্টে।

“এটা আসলে একটি প্রতীকী আত্মসমর্পণ। পাকিস্তান যে দেশটিকে ১৯৭১ সালে হারিয়েছিল, সেই পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা শক্তি এখন বাংলাদেশে ক্ষমতায়। তারা কীভাবে সেই পরাজয়ের দিনটি উদযাপন করবে?” ফেসবুক পোস্টে বলেছে আওয়ামী লীগ।

কুচকাওয়াজে কী থাকে?
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগের বিজয় দিবসগুলোতে দেখা গেছে, শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতারাসহ সাধারণ মানুষের ঢল নামতো সাভারে স্মৃতিসৌধে।

এছাড়া রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দর যেটি জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড, সেখানে সেনা, নৌ ও বিমান এই তিন বাহিনীর এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হতো। এতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা উপস্থিত থাকতেন। তিন বাহিনীর প্রধানও সেখানে উপস্থিত থাকতেন।

২০২৩ সালের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিন বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সালাম গ্রহণ করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

এছাড়া বিমান বাহিনী ফ্লাই পাস্ট এবং অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে করে। আকাশ থেকে নেমে আসেন প্যারা ট্রুপাররা।

বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে সাঁজোয়া যানগুলো এই কুচকাওয়াজে প্রদর্শন করা হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবায়দা নাসরীন মনে করেন, বিজয় দিবসে কুচকাওয়াজ অর্থ হলো একটা রণকৌশল, শৃঙ্খলা এবং এমন একটা উদ্যমের জায়গা যা বহুবছর ধরে এটি বিজয় এবং স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

“সরকারকে খোলাসা করতে হবে কেন কুচকাওয়াজ বন্ধ হলো। গতবছর নিরাপত্তার কারণ দেখিয়েছে, এবার কোনো কারণই দেখায়নি। কিন্তু কুচকাওয়াজ আর অন্যান্য অনুষ্ঠান কোনোভাবেই রিপ্লেসের জায়গা না,” বলেন মিজ নাসরীন।

কেন কুচকাওয়াজ হয়?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, প্রজাতন্ত্র দিবস বা একটি দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কুচকাওয়াজ বা প্যারেড অনুষ্ঠানের রেওয়াজ রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে লেখেন মহিউদ্দিন আহমদ।

তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, ভারত, পাকিস্তান, চীন, উত্তর কোরিয়াসহ এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই সামরিক সক্ষমতার প্রকাশে এই ধরনের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।

মি. আহমদ বলেন, “যেসব দেশে কুচকাওয়াজ হয়, প্রায় প্রতিটি দেশই তাদের সামরিক সক্ষমতার নিদর্শন ডিসপ্লে করে। যেমন- ভারত তাদের মিসাইল ডিসপ্লে করে।”

“আমাদের এখানে রাষ্ট্রবাদের প্রকাশটা দেখি মিলিটারি বাহিনীর কুচকাওয়াজের মাধ্যমে। রাষ্ট্রবাদীরা মনে করে সামরিক সরঞ্জাম, মারণাস্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এটা দিয়েই বুঝি স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়,” বলেন মি. আহমদ।

মি. আহমদ মনে করছেন, এ বছর কুচকাওয়াজ না হওয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি আর্থিক এবং অপরটি রাষ্ট্রপতিকে সালাম প্রদান।

রেওয়াজ অনুযায়ী, বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে তিন বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী রাষ্ট্রপতিকে সালাম প্রদান করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে বিব্রত বোধ করে বলে মনে করেন মি. আহমদ।

“কুচকাওয়াজে সালাম নেন রাষ্ট্রপতি। এখন তো সমস্যা হয়ে গেলো যে, এই রাষ্ট্রপতিকে তো অফিসিয়ালি ডিসপ্লে করা যাচ্ছে না। কেননা এটা বিব্রতকর এই সরকারের জন্য এবং অন্য আরো অনেকের জন্য,” বলেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

কেন বিব্রতকর এমন প্রশ্নে মি. আহমদ বলেন, “কারণ তিনি আমাদের পতিত ফ্যাসিস্ট শাসকদের অবশেষে হিসেবে থেকে গেছেন এই রাষ্ট্রপতি। কুচকাওয়াজের সাথে সাথে তো তাকেও ডিসপ্লে করতে হয় যেহেতু তিনি সালাম নেন। তো সেটা খুব বিব্রতকর।”

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য দেশটি প্রস্তুত- এমন বিষয়ও বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের প্রতীকী রূপ।

মিজ নাসরীন অবশ্য মনে করেন, এ বছর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ বন্ধ রাখার পেছনে সরকারের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে।

সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

“কোনো কারণ প্রদর্শন না করে কুচকাওয়াজ বন্ধ হওয়া ইঙ্গিত করে যে অনেক কিছুই বন্ধ হবে। মেলা বা অন্যান্য কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কোনোভাবেই কুচকাওয়াজের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিকভাবে চর্চিত বিষয়কে খারিজ বা প্রতিস্থাপন করে না,” বলেন মিজ নাসরীন।

কুচকাওয়াজ বন্ধের পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের “বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে” বলেও উল্লেখ করেন মিজ নাসরীন।

তিনি বলেন, “কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর চাপ থাকতে পারে সরকারের ওপরে, কিংবা সরকার কোনো না কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য এটা করতে পারে তারা।”

কুচকাওয়াজ হচ্ছে এমন একটি প্রতীকী শক্তি যেটার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, গৌরব, দেশপ্রেমকে আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় বলেও তিনি মনে করেন। “মুক্তিযুদ্ধকে মানুষ যাতে পুনরায় স্মরণ করতে না পারে সেজন্য বাধা দেওয়া, হুমকি তৈরি করাও” উদ্দেশ্য হতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজ নাসরীন।