আমাদের মেরে ফেলা হবে, দেশ পাকিস্তানপন্থিদের হাতে চলে যাচ্ছে : অধ্যাপক কার্জন
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে ক্ষতিপূরণ চাইলেন
- আপডেট সময় : ০৮:৪৭:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ অগাস্ট ২০২৫
- / 265
মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় হামলার শিকার হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের হওয়া মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন অভিযোগ করেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ যে যুক্তি তুলে ধরেছে তা ‘ভিত্তিহীন ও মিথ্যা’।
শুক্রবার (২৯ আগস্ট) ঢাকার হাকিম আদালতে হাজির করা হলে ১৬ আসামিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন জানায় পুলিশ। তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অধ্যাপক কার্জন আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রতিকার চান এবং ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মঞ্চ ৭১’ আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে লতিফ সিদ্দিকীসহ তাদের পুলিশ হেফাজতে নেয়। পরে শাহবাগ থানায় তাদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়, যেখানে অভিযোগ আনা হয়—‘দেশকে অস্থিতিশীল করা ও অন্তবর্তীকালীন সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র’।
ঢাকার মহানগর হাকিম সারাহ ফারজানা হকের আদালতে শুনানির সময় কার্জন বলেন, “অপরাধীরা ধরা না পড়ে উল্টো আমাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
ঢাবির এই শিক্ষক আরও বলেন, “আমরা ভিকটিম। এর প্রতিকার চাই। এখনই আমাদের মুক্তি দিন। যেভাবে অপমান করা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ কোটি টাকা চাই। আমরা কারো দলীয় কর্মী নই।”
লতিফ সিদ্দিকী ও কার্জন ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া বাকি ১৪ জন হলেন: মঞ্জুরুল আলম পান্না (৪৯), কাজী এ টি এম আনিসুর রহমান বুলবুল (৭২), গোলাম মোস্তফা (৮১), মো. মহিউল ইসলাম বাবু (৬৪), মো. জাকির হোসেন (৭৪), মো. তৌছিফুল বারী খান (৭২), মো. আমির হোসেন সুমন (৩৭), মো. আল আমিন (৪০), মো. নাজমুল আহসান (৩৫), সৈয়দ শাহেদ হাসান (৩৬), মো. শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার (৬৪), দেওয়ান মোহাম্মদ আলী (৫০) ও মো. আব্দুল্লাহীল কাইয়ুম (৬১)।
শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, “‘মঞ্চ ৭১’ সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করতে আত্মপ্রকাশ করে। এর অংশ হিসেবে ২৮ অগাস্ট ঢাকার সেগুনবাগিচায় ডিআরইউতে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান চলাকালে একদল ব্যক্তি হট্টগোল করে সভাস্থলে ঢুকে ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে, কয়েকজনকে লাঞ্ছিত করে এবং লতিফ সিদ্দিকী ও অধ্যাপক কার্জনকে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ এসে ১৬ জনকে আটক করে।”
আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, “লতিফ সিদ্দিকী ‘মঞ্চ ৭১’-এর ব্যানার ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য দেন এবং উপস্থিতদের প্ররোচিত করেন। ফলে উপস্থিত লোকজন তাদের ঘেরাও করে ‘আওয়ামী ফ্যাসিস্ট’ স্লোগান দেয়। তদন্তের স্বার্থে তাদের কারাগারে আটক রাখা জরুরি।”
সকাল সাড়ে ১০টায় এজলাসে তোলা হলে আসামিদের হাতে হাতকড়া, মাথায় হেলমেট ও গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছিল। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অধ্যাপক কার্জন পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেন, “ভয়াবহ অবস্থা! বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলি?” এরপর পুলিশ তা খুলে দেয়।
সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী এসময় কাঠগড়ায় হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিলেন। মাঝে পানি পান করেন এবং নীরব থাকেন।
আইনজীবীরা ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিতে চাইলে অধিকাংশ আসামি সই করেন, তবে লতিফ সিদ্দিকী তা প্রত্যাখ্যান করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা সুমন জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, “ওরা ষড়যন্ত্রে জড়িত। মঞ্চ ৭১-এর জন্মদিনই ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত। তাদের উদ্দেশ্য হাসিনাকে ফেরানো। আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ওদের সম্পৃক্ততা ছিল। কারাগারে পাঠানো হোক।”
এসময় অধ্যাপক কার্জন বিচারকের উদ্দেশে বলেন, “আমাদের সঙ্গে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়েছে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধিকার দেওয়া হয়নি। নিজের আইনজীবী বেছে নেওয়ার সুযোগও পাইনি। পিপি যা বলেছেন সব মিথ্যা।”
তিনি আরও বলেন, “ডিআরইউর অনুষ্ঠানটির আহ্বায়ক ছিলেন জেড আই খান পান্না, আর প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ছিল ড. কামাল হোসেনের। মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান নিয়েই আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীরা ঢুকে আমাদের টেনে বের করে দেয়। অথচ আমরা বন্দী, হামলাকারীরা মুক্ত।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কাইয়ুম হোসেন নয়ন বলেন, “১৭ বছর ফ্যাসিস্ট সুবিধাভোগী। এখন আদালতে এসে নাটক করে। এরা চোর-বাটপাড়।”
সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না আদালতের অনুমতি নিয়ে বলেন, “আমরা সন্ত্রাসী? হামলাকারীরা মুক্ত আর আমাদের ধরা হলো কেন?” এতে আদালত কক্ষ কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
আদালত সবাইকে শান্ত হতে বলেন এবং জামিন শুনানি চালান। আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখী জামিনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, “এরা মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেই যদি আক্রমণের শিকার হতে হয়, তবে এটা ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন।”
তবে লতিফ সিদ্দিকী জামিন আবেদন করেননি। তার আইনজীবী জানান, “তিনি বলেছিলেন, যে আদালতের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তার কাছে জামিন চাইব কেন?”
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
শুনানি শেষে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় অধ্যাপক কার্জন বলেন, “আমি তো মারা যাব। আমাদের মেরে ফেলবে। আমরা সন্ত্রাসের শিকার, আমাদের জেলে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ, আদালত আমাদের কোনো বিচায় দেয়নি। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। দেশ এখন পাকিস্তানপন্থিদের হাতে। এটা চলবে না। ইনশাআল্লাহ এ দেশটাকে আমরা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে পরিণত করব।”
আদালত প্রাঙ্গণে সংবিধান উঁচু করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এটা মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ৫ লাখ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া। আমরা এটি রক্ষা করব।”
সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না তখন বলেন, “সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ল না, অথচ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের সন্ত্রাসী বানানো হলো।”
লতিফ সিদ্দিকী নীরব ছিলেন।
শুনানি শেষে আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখী সাংবাদিকদের বলেন, “গ্রেপ্তারের পর তাদের যে অবস্থায় রাখা হয়েছিল, সেখানে ফ্যান পর্যন্ত ছিল না। ধুলোবালির মধ্যে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হয়েছে।”

















